রবিবার, ১৯ মার্চ, ২০১৭ ০০:০০ টা

এত বিস্ফোরক আসে কোথা থেকে

সাঈদুর রহমান রিমন

বিস্ফোরকদ্রব্য দেশে আবার সহজলভ্য হয়ে উঠেছে। কেমিক্যাল ব্যবসায়ীরা অবাধে ব্যবসা শুরু করায় যারতার হাতে চলে যাচ্ছে বিস্ফোরকদ্রব্য। ভ্রাম্যমাণ আদালত মাঝেমধ্যে অভিযান পরিচালনা করলেও বিস্ফোরকদ্রব্যের অবাধ বেচাকেনা ও মজুদ বন্ধ হয়নি।

গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে, নাশকতায় ব্যবহূত বিস্ফোরকের জোগান আসছে ঢাকার কয়েকটি ম্যাচ ফ্যাক্টরি, অসাধু বিস্ফোরক ব্যবসায়ী ও সীমান্তের অস্ত্র-গোলাবারুদ চোরাকারবারিদের কাছ থেকে। বিস্ফোরক ব্যবসায়ীদের অধিকাংশই আড়ালে সন্ত্রাসীদের কাছে মোটা টাকায় বিস্ফোরক বিক্রি করছেন বলে অভিযোগ। একই সঙ্গে পাকিস্তান, আফগানিস্তান ও ভারতীয় জঙ্গিদের মাধ্যমে আসাম, ত্রিপুরা ও মিজোরাম স্থলসীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে ঢুকছে উচ্চমাত্রার বিস্ফোরক। ঢাকা ও বিভিন্ন স্থান থেকে সংগৃহীত বিস্ফোরক দিয়ে তৈরি হচ্ছে ককটেল আর হ্যান্ডগ্রেনেড।

পুলিশ সূত্রে জানা যায়, বিস্ফোরকের ৮০ ভাগ সীমান্ত এলাকা দিয়ে বাংলাদেশে ঢুকছে। সীমান্তবর্তী এলাকার পেশাদার সন্ত্রাসীরাই এগুলো জঙ্গি-সন্ত্রাসীদের কাছে বিক্রি করছে। সীমান্ত অতিক্রম করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের ফাঁকি দিয়ে কীভাবে এত বিস্ফোরক দেশে আসছে তা নিয়ে সচেতন মহলে প্রশ্ন উঠেছে।

ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশের এক অভিযানেও উদ্বেগজনক তথ্য জানা গেছে। দুর্ধর্ষ জঙ্গি ক্যাডারদের জিজ্ঞাসাবাদের ভিত্তিতে ডিবি পুলিশ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ল্যাবরেটরি সহকারীসহ চারজনকে গ্রেফতার করে। তারা বিশ্ববিদ্যালয় ল্যাবরেটরির নানা কেমিক্যাল জঙ্গিদের সরবরাহ করতেন বলে স্বীকারোক্তিমূলক বক্তব্য দেন। দেশের অন্য বিশ্ববিদ্যালয়সহ উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ল্যাবরেটরি থেকে একইভাবে জঙ্গিদের কেমিক্যালসহ বিস্ফোরকদ্রব্য সরবরাহ করা হয় কিনা, তা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। জঙ্গিগোষ্ঠীগুলো ছুরি-বন্দুক ব্যবহারের পরিবর্তে বিকট শব্দযুক্ত বিস্ফোরণ ঘটিয়ে আতঙ্ক ছড়াতেই বেশি উৎসাহ দেখাচ্ছে। তা ছাড়া অস্ত্রশস্ত্রের তুলনায় বিস্ফোরকদ্রব্য সহজভাবেই এক স্থান থেকে অন্য স্থানে বহন করা যায়। ফলে ভয়ঙ্কর জঙ্গি সদস্যরা বিস্ফোরকের দিকেই বেশি ঝুঁকছে। বোমা তৈরির কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহূত হচ্ছে সালফার ডাইঅক্সাইড, ফসফরাস, অ্যামোনিয়াম নাইট্রেট, ডিডিটি, টিএনপি, লেডঅক্সাইড, লেড অ্যাজাইড, মারকারি, গন্ধক ও পটাশিয়াম সালফাইড। গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে, ঢাকায় বৈধ বিস্ফোরকদ্রব্য বিক্রির দোকানের সংখ্যা ৫৯। এসব দোকানের অধিকাংশই বংশাল, টিকাটুলী, সুরিটোলা, করাতিটোলা, লালবাগ, কোতোয়ালি, মিটফোর্ডসহ আশপাশের এলাকায় অবস্থিত। দোকানগুলো কী পরিমাণ বিস্ফোরক আমদানি ও বিক্রি করে তা নজরদারির দায়িত্বে আছে বিস্ফোরক অধিদফতর। প্রতি মাসেই নির্দিষ্ট এলাকার দায়িত্বরত পরিদর্শকের বিস্ফোরক দোকানগুলো পরিদর্শন করার কথা। তারা কত বিস্ফোরক এনেছেন এবং বিক্রি করেছেন তার হিসাব বিস্ফোরক অধিদফতরে জমা দেওয়ার নিয়ম। অবিক্রীত বিস্ফোরক সম্পর্কেও ব্যবসায়ী ও পরিদর্শকের প্রতিবেদন দাখিল করার কথা। তবে তা কেবল কাগজে-কলমে। বাস্তবায়ন নেই। সূত্র বলছে, বাংলাদেশের বৈধ দোকানগুলোয় যেসব বিস্ফোরকদ্রব্য বিক্রি হয় তা সার উৎপাদন ও দিয়াশলাই (ম্যাচ) তৈরির কাজে ব্যবহূত হয়। ম্যাচ তৈরি করতে যে রেড সালফার ব্যবহূত হয় তা ককটেল বা হাতবোমা তৈরির কাজেও ব্যবহূত হয়। ভুয়া ভাউচারে অসাধু বিস্ফোরক ব্যবসায়ীরা বিভিন্ন সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর কাছে এসব বিস্ফোরকদ্রব্য বিক্রি করেন। আবার সন্ত্রাসী গোষ্ঠীও মোটা টাকা দিয়ে বিস্ফোরক ব্যবসায়ীদের মাধ্যমে বিস্ফোরক আমদানি করে। এ ছাড়া বিভিন্ন ম্যাচ ফ্যাক্টরির মাধ্যমেও বিস্ফোরক সংগ্রহ করে সন্ত্রাসী গোষ্ঠী। পুরান ঢাকার স্থানীয় বাসিন্দারা অভিযোগ করে জানান, অবৈধ কারখানাগুলোকে কেন্দ্র করে অবাধে বিক্রি হচ্ছে মারাত্মক সব দাহ্য ও রাসায়নিক পদার্থ। সালফার, পটাশ, ফসফরাস, সালফিউরিক অ্যাসিড, নাইট্রিক অ্যাসিড, ইথানল, মিথাইল, রেকটিফায়েড স্পিরিট, ফরমালডিহাইড, অ্যাডহেসিভ বা সলিউশন, তারপিনসহ নানা ধরনের গানপাউডার যত্রতত্র বিক্রি হয়। পুরান ঢাকায় আতশবাজির আড়ালেও বিক্রি হচ্ছে বিস্ফোরকদ্রব্য। লাইসেন্সবিহীন মুদি দোকানে বিস্ফোরকদ্রব্য রাখা না রাখা নিয়ে কোনো নজরদারি নেই। বেশির ভাগ ব্যবসায়ীই সাধারণ ব্যবসার লাইসেন্স নিয়ে এসব ব্যবসা করছেন। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা জানান, তারা কেবল ট্রেড লাইসেন্স দেন সাধারণ ব্যবসার জন্য। কোনো কেমিক্যাল বিক্রির লাইসেন্স তারা দেন না। এ লাইসেন্স পেতে হলে ফায়ার ব্রিগেড, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, পরিবেশ অধিদফতর, স্বাস্থ্য বিভাগ ও বিস্ফোরক অধিদফতরের অনুমোদন লাগে। কিন্তু বেশির ভাগ ব্যবসায়ী ডিসিসির ট্রেড লাইসেন্স নিয়েই ধুমছে বিস্ফোরকদ্রব্যের ব্যবসা ফেঁদে বসেছেন।

গানপাউডারের সহজলভ্যতা : গানপাউডার বিক্রি নিষিদ্ধ হলেও সন্ত্রাসীরা বিভিন্ন উৎস থেকে এ মরণঘাতী পাউডার সংগ্রহ করছে। রাজনৈতিক সহিংসতায় যে গানপাউডার ব্যবহূত হচ্ছে তা বিভিন্ন শিল্প কারখানা থেকে সংগ্রহ করছে নাশকতাকারীরা। দেশে বৈধ ও অবৈধ দুইভাবেই গানপাউডার আমদানি করা হয়। তবে সহিংসতায় ব্যবহূত গানপাউডারের সিংহভাগ আসে চোরাচালানের মাধ্যমে। গানপাউডার দহনের তীব্রতা বাড়ায়। বিস্ফোরক অধিদফতরের দেওয়া তথ্যমতে, সালফার (গন্ধক), চারকোল (কাঠ কয়লা) ও পটাশিয়াম নাইট্রেটের (সল্ট পিটার) মিশ্রণে গানপাউডার তৈরি হয়। এর রং কালো। গানপাউডার ধোঁয়া উৎপাদন ও আগুনের দহনক্ষমতা বাড়িয়ে দেয়। উপকরণের পরিমাণ কম-বেশিতেই এর দাহ্যক্ষমতা নির্ধারিত হয়। অনুসন্ধানে জানা গেছে, মিথ্যা ঘোষণায় আমদানি করা সালফার ইতিপূর্বে চট্টগ্রামের সদরঘাট, মাঝিরঘাট, মাদারবাড়ী, চাক্তাই, খাতুনগঞ্জ, কোরবানীগঞ্জ, বকশির হাট এলাকার শতাধিক গুদামে মজুদ রেখে তা খোলা বাজারে বিক্রি করা হতো। বর্তমানে বাকলিয়া, আমবাগান, নিউ মনসুরাবাদ, পানওয়ালাপাড়া, সুপারিওয়ালাপাড়া, মতিঝর্ণা, কর্নেল হাট, রুবি গেট, কাঠগড়সহ বিভিন্ন ঘনবসতিপূর্ণ এলাকাতেই গড়ে উঠছে বিস্ফোরকের গুদাম। জানা গেছে, চক্রটি নিজেদের নেটওয়ার্কের ক্রেতা ছাড়া অন্য কারও কাছে তা বিক্রি করে না। চট্টগ্রামের চক্রটির সঙ্গে ঢাকার একটি চক্রের যোগাযোগ রয়েছে।

জামায়াত কর্মীর বিস্ফোরকের গুদাম : চট্টগ্রাম নগরীর ডবলমুরিং থানার পানওয়ালাপাড়ায় ঘনবসতিপূর্ণ লোকালয়ে গুদাম বানিয়ে বিপুল বিপজ্জনক বিস্ফোরক মজুদ ঘটনার প্রকৃত রহস্য এখনো উদ্ঘাটন হয়নি। মজুদ বিস্ফোরকের মালিক ছিলেন ছাগির হোসেন (২৫) নামে জামায়াতের এক সক্রিয় কর্মী। বিস্ফোরক আমদানি কিংবা মজুদের ক্ষেত্রে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও বিস্ফোরক অধিদফতরের অনুমোদন লাগলেও ছাগিরের ছিল না কিছুই। হাতবোমা, ককটেল, সালফিউরিক অ্যাসিড তৈরির কাজে ব্যবহূত এসব রাসায়নিক সালফার ওই গুদাম থেকে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন জনের কাছে বিতরণ করা হতো। রহস্যজনক ওই গুদামটিতে অভিযান চালিয়ে র‍্যাব সদস্যরা ২১ বস্তা বিস্ফোরক উদ্ধার করেন। প্রায় ১ মেট্রিক টন বিস্ফোরকের মজুদকারী ছাগিরকে আটক করা যায়নি। ফলে তার কাছ থেকে আরও কী পরিমাণ বিস্ফোরক কারা কোথায় কীভাবে নিয়েছেন সেসব তথ্যও জানা সম্ভব হয়নি। র‍্যাবের কমান্ডার সাহেদ করিম জানান, গুদামটিতে অভিযানের পর তারা এ বিষয়ে বিস্ফোরক বিশেষজ্ঞদের মতামত নেন। বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, উদ্ধার করা সালফারগুলোয় প্রায় ৯৭ ভাগ রাসায়নিক উপাদান আছে। এগুলো প্রধানত ম্যাচ ফ্যাক্টরিতে ও সালফিউরিক অ্যাসিড তৈরির কাজে ব্যবহূত হয়। তবে ককটেল ও হাতবোমা বানাতেও এসব সালফার মূল রাসায়নিক কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহূত হয়।

বিস্ফোরক মজুদে আইন মানা হচ্ছে না : নয় শ্রেণির বিপজ্জনক পদার্থ এ দেশে আমদানি করা হয়। এর প্রথম তিন শ্রেণির বিপজ্জনক পদার্থ মজুদ, পরিবহন, ক্রয়-বিক্রয়ে নীতিমালা রয়েছে। বাকি ছয় প্রকার অধিক বিপজ্জনক বস্তু মজুদের ক্ষেত্রে কোনো নীতিমালাই নেই। বিপজ্জনক জ্বালানিযোগ্য কঠিন পদার্থের একটি ক্যালসিয়াম কার্বাইড। কার্বাইড মজুদাগারের প্রস্তাবিত প্রাঙ্গণের পরিসীমার চারপাশে কমপক্ষে ১০০ মিটারের মধ্যে স্থায়ী স্থাপনার চিত্র, মজুদাগারের অবস্থান ও নির্মাণ নকশা পর্যবেক্ষণের নীতিমালা থাকলেও তা মানা হয় না। পরিবেশ নিয়ন্ত্রণ আইন, ১৯৯৫-এ মহাপরিচালকের ক্ষমতা ও কার্যাবলির ধারা ৪ (গ)-এ বলা হয়েছে, বিপজ্জনক পদার্থ বা তার উপাদানের পরিবেশসম্মত ব্যবহার, সংরক্ষণ, পরিবহন, আমদানি ও রফতানিসংক্রান্ত বিষয়ে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে পরামর্শ বা ক্ষেত্রমত নির্দেশ দেবেন বিস্ফোরক পরিদফতরের মহাপরিচালক। কিন্তু বিপজ্জনক পদার্থের বিষয়ে মহাপরিচালকের পক্ষে আজ পর্যন্ত কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার নজির নেই।

সর্বশেষ খবর