মঙ্গলবার, ২২ আগস্ট, ২০১৭ ০০:০০ টা

সেই জজ মিয়া এখন...

সাখাওয়াত কাওসার

কষ্টের শেষ নেই ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলার বহুল আলোচিত চরিত্র জজ মিয়ার। নৃশংস ওই গ্রেনেড হামলার সঙ্গে জড়িত না হয়েও ২০০৪ সালে রাজধানীর মতিঝিলের এই ফল ব্যবসায়ীকে সহ্য করতে হয়েছে অমানুষিক পুলিশি নির্যাতন। হারিয়েছেন নিজের ভিটেমাটি। চাঞ্চল্যকর ওই মামলায় সংশ্লিষ্টতার বিষয়টি গোপন রেখে বিয়েও করেছিলেন জজ। তবে বিয়ের তিন মাসের মাথায় তা প্রকাশ পেয়ে যাওয়ায় স্ত্রীকে নিয়ে গেছে তার শ্বশুরবাড়ির লোকজন। এদিকে মায়ের দুটি কিডনিই বিকল হয়ে যাওয়ায় তার চিকিৎসা খরচ চালাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে বর্তমানে পেশায় গাড়িচালক এই মানুষটির। জজ মিয়ার সঙ্গে গতকাল সন্ধ্যায় বাংলাদেশ প্রতিদিনের সঙ্গে কথোপকথনে এসব বিষয় উঠে আসে। জজ মিয়ার আক্ষেপ, সবাই শুধু আশ্বাসই দিয়েছে। আশ্বাস শুনে শুনেই আমার সময় পার হচ্ছে। নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জ এলাকায় বর্তমানে বসবাস জজ মিয়ার। গ্রামের বাড়ি নোয়াখালীর সেনবাগে হলেও জেল থেকে বের হওয়ার পর রাজধানীর কদমতলীর রায়েরবাগ এলাকায় থাকতেন। জজ মিয়া বলেন, গ্রেফতারের পর সিআইডির (পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ) স্যাররা আমারে অনেক মারছিল। জীবনের ডরে আমি তাগো কথায় রাজি হইছিলাম। হেরা কইছিল, আমারে রাজসাক্ষী বানাইব, জেল থেকে বাইর হইলে পরিবারসহ দেশের বাইরে পাঠাইয়া দিব। গ্রেফতারের পর কয়েকমাস আমার মায়ের কাছে তারা ৪-৫ হাজার কইরা টাকা দিছিল। এইড্যাই...।’ নিজের দুর্দশার কথা জানিয়ে তিনি বলেন, বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আওনের পর কয়েকজন মন্ত্রীই কইছিলেন, আমারে চাকরি দিব। আমার নাকি কোনো চিন্তা করতে হইব না। ভাই, সবাই শুধু আশ্বাস দেয়। পরে কোনো খবর নেয় না। এহন আমার মায়ের পেছনে প্রতি সপ্তাহে সাড়ে তিন থেকে চার হাজার টাকা লাগে। মা খুবই অসুস্থ। মায়ের দুইট্যা কিডনিই নষ্ট হইয়্যা গেছে। টাকার অভাবে ছোট বোনডারে (খোরশেদা, ১৯) বিয়া দিতে পারতাছি না। আমি কই যামু কন?’ একটা চাকরির প্রত্যাশা জানিয়ে জজ মিয়া বলেন, ভাই কয়েক বছর আগে ঋণ করে ও কিস্তিতে সাড়ে তিন লাখ টাকায় একটি পুরনো প্রাইভেটকার কিনছিলাম। গাড়িটার অবস্থা এহন খুব খারাপ। সরকারের কাছে আমার একটাই চাওয়া, আমারে একটা চাকরি দেন। আমি আর পারতাছি না। চার ভাই ও এক  বোনের মধ্যে আমি মেজ। বড় দুই ভাই আলাদা থাকে। চারজনের সংসার আমার চালাতে হয়। মামলায় জড়িইয়্যা যাওয়ায় মা আমার জন্য গ্রামের ভিটেমাটি বিক্রি কইর‍্যা দিছিল। প্রায় ৪-৫ লাখ টাকা খরচ করছে। এর লাইগ্যা বড় দুই ভাই আমার লগে এহনো কথা কয় না।

৮ মাস আগে স্ত্রী তাকে ছেড়ে চলে গেছে জানিয়ে জজ মিয়া বলেন, ‘আমার পরিচয় জানার পর কেউ-ই আমার কাছে মেয়ে বিয়ে দিতে রাজি হয় নাই। সবাই মনে করে, সরকার বদল হলে আমারে আবার জেলে যাইতে হইব। বছরখানেক আগে পরিচয় গোপন কইর‍্যা চাঁদপুরে বিয়া করছিলাম। গ্রেনেড হামলা মামলার বিষয়টি জানার পর শ্বশুরবাড়ির লোকজন আমার স্ত্রী’রে লইয়্যা গেছে।’ ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের সমাবেশ চলাকালে ভয়াবহ গ্রেনেড হামলায় অল্পের জন্য প্রাণে বেঁচে যান ওই সময়ের বিরোধীদলীয় নেত্রী বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। হামলায় আওয়ামী লীগের মহিলাবিষয়ক সম্পাদক ও সাবেক রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের স্ত্রী আইভি রহমানসহ ২৪ জন নিহত হন। আহত হন দলের তিন শতাধিক কর্মী। এ ঘটনা ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করতে নাটক সাজায় সিআইডি। ২০০৫ সালের ৯ জুন গ্রামের বাড়ি নোয়াখালীর  সেনবাগ থেকে গ্রেফতার করা হয় জজ মিয়াকে। এরপর ১৭ দিন রিমান্ডে রেখে জজ মিয়াকে দিয়েই গ্রেনেড হামলার ঘটনায় ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি আদায় করা হয়। জবানবন্দিতে জজ মিয়া বলেছিলেন, ‘পাঁচ হাজার টাকার বিনিময়ে বড় ভাইদের নির্দেশে আমি অন্যদের সঙ্গে গ্রেনেড হামলায় অংশ নিই। বড় ভাইয়েরা হচ্ছেন সন্ত্রাসী সুব্রত বাইন, জয়, মোল্লা মাসুদ ও মুকুল।’ ২০০৬ সালে এ নাটক ফাঁস করে  দেন জজ মিয়ার বোন ও মা। তখন তারা জানিয়েছিলেন, জজ মিয়াকে গ্রেফতারের পর থেকেই সিআইডি তাদের ভরণ- পোষণের জন্য টাকা দিচ্ছে। নাটকের কারিগর হিসেবে সিআইডির তৎকালীন বিশেষ পুলিশ সুপার রুহুল আমিন, সহকারী পুলিশ সুপার মুন্সি আতিক ও আবদুর রশীদের নাম উল্লেখ করেন জজ মিয়ার মা ও বোন। সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতায় আসার পর দ্রুত পরিস্থিতি পাল্টে যায়। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর ওই বছরের ২৬ জুলাই জেল থেকে মুক্তি পান জজ মিয়া।  জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার পর জজ মিয়া বেসরকারি একটি টিভি চ্যানেলে গাড়িচালক হিসেবে যোগ দেন। তবে কিছুদিন পর চাকরিটি ছেড়ে দেন। এ বিষয়ে জজ মিয়ার বক্তব্য, ‘ভাই, আমি মাসে সাত হাজার টাকা পাইতাম। ওই টেহায় সংসার চলত না। বাসা ভাড়াও ঠিকমতো দিতে পারতাম না।’ জজ মিয়াকে বিভিন্ন সময়ে দেওয়া চাকরির আশ্বাস ও তার মায়ের চিকিৎসার বিষয়ে জানতে চাইলে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের পরিচালক (স্বাস্থ্য) ডা. জুলফিকার লেনিন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে  বলেন, আমি চাকরির বিষয়টি বলতে পারব না। তবে জজ মিয়ার মায়ের অসুস্থতার বিষয়টি আমার জানা নেই। আমার সঙ্গে যোগাযোগ করলে আমি এ ব্যাপারে ব্যবস্থা নিব।

 

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর