বৃহস্পতিবার, ৭ ডিসেম্বর, ২০১৭ ০০:০০ টা
গো য়ে ন্দা কা হি নী ৯৬

তোর হায়াত শেষ বলেই গুলি

মির্জা মেহেদী তমাল

তোর হায়াত শেষ বলেই গুলি

পরিবারে নতুন অতিথি এসেছে। হাবিবের পরিবারে খুশির অন্ত নেই। কিন্তু সেই খুশি ধরে রাখতে পারছেন না তিনি। যখনই মনে পড়ে, তিনি রয়েছেন সন্ত্রাসীদের বন্দুকের নিশানায়। জীবনের নিরাপত্তা নিয়ে সব সময় আতঙ্কে থাকতে হচ্ছে তাকে। এই বুঝি সন্ত্রাসীদের অস্ত্রের নল থেকে বেরিয়ে আসা গুলি তার মাথা এফোঁড়-ওফোঁড় করে দেবে। এমন সব দুশ্চিন্তায় দিন কাটছে তার। এসব বিষয় তিনি স্ত্রী দিবাকে জানাতে চান না। মাত্র দেড় বছর হলো তাদের বিয়ে হয়েছে। এক মাসের ফুটফুটে সন্তান কোলে নিয়ে দারুণ সুখী দিবা। তার এই সুখ ভরা জীবনে এসব কথা বলে আতঙ্কিত করতে চান না হাবিব। কিন্তু হাবিবের কপালের চিন্তার রেখা দুই বছরে ভালোভাবেই রপ্ত করেছেন দিবা। সেটি তার চোখ এড়ায় না। ‘কী ব্যাপার! কী হয়েছে তোমার? কী চিন্তা করছ। কোনো সমস্যা হচ্ছে? শরীর খারাপ?’ বেশ কদিন ধরেই দিবার এমন সব নানা প্রশ্নের জবাব দিতে গিয়ে রীতিমতো হয়রান হয়ে গেছে হাবিব। আমাদের সন্তান নিয়ে কি তুমি খুশি নও?-সেই রাতে হাবিবের চোখে চোখ রেখে সরাসরি প্রশ্নটা রেখেছিল দিবা। স্ত্রীর এমন অদ্ভুত প্রশ্নে অপ্রস্তুত হয় হাবিব। ‘আরে ধুর! কী বলছ এসব’—কপালে চোখ তুলে বলে হাবিব। ‘তাহলে যে তোমাকে দেখছি মনমরা হয়ে থাকছ। বেশ কদিন ধরেই তোমাকে চিনতে কষ্ট হচ্ছে আমার।’ অভিমানের সুরে কথাগুলো বলে দিবা। তাকে থামিয়ে দিয়ে হাবিব বলেন— ‘আসলে আমি কিছু বাজে লোকের নিশানায় পড়ে গেছি। জানি না, কী হবে। হুমকি-ধমকি দিয়ে যাচ্ছে। বাসার সামনে অপরিচিত লোকজনের আনাগোনা দেখি। আমাকে নাকি ওরা মেরে ফেলবে।’ স্বামীর এমন কথা শুনে ভয় পায় দিবা। বলেন, ‘চল আমরা এখান থেকে চলে যাই। বাসা বদলিয়ে ফেলি’। ‘আর বাসা বদলিয়ে কী হবে—হাবিব বলে তার স্ত্রীকে। গত দুই বছরে এই কারণেই পাঁচবার বাসা বদল করতে হলো। লাভ কি হয়েছে। অপরিচিত লোকজনকে দেখছি বাসার সামনে। তবে সে যাই হোক, কোনো চিন্তা কর না। সব ঠিক হয়ে যাবে। চিন্তা করবে বলেই তোমাকে এতদিন কিছু বলতে চাইনি। আস ঘুমিয়ে পড়ি। সকালে কোর্টে যেতে হবে।’ পরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠেই পাশের বাড়ি বড় বোনের কাছে বাচ্চাকে রেখে আসে হাবিব। তার স্ত্রী দিবা কলেজে যাবে মার্কশিট তুলতে। বাচ্চাকে রেখে এসে হাবিব আর দিবা এক সঙ্গে নাস্তা খায়। সকাল ৯টায় বাসা থেকে বেরিয়ে যায়। বেরোনোর আগে হাবিব তার স্ত্রীকে বলে, কোনো চিন্তা কর না। আমি ঠিকঠাক থাকব। দোয়া কর আমার জন্য।’ দরজায় দাঁড়িয়ে হাবিবকে বিদায় দেন দিবা। হাবিবের সহকারী আসাদ ভেসপা নিয়ে অপেক্ষা করছিলেন ভেসপায় চড়ে বসতেই দিবার দিকে ঘুরে তাকায় হাবিব। দিবা হাত তুলে বিদায় জানায়। দরজা বন্ধ করে ভিতরের রুমে সবে ঢুকেছে দিবা, অমনি ঠাটা। গুলির বিকট শব্দ। দিবার শরীর কেঁপে ওঠে। ভীষণ ভয় পায়। কী ব্যাপার! গুলির শব্দ মনে হচ্ছে! ভাবে দিবা। কী মনে করে সে আবারও দরজার দিকে ছুটে যাবে, তখন আবারও গুলির শব্দ। এবার অনবরত। মানুষের হৈচৈ শোনা যাচ্ছে। দরজা খুলে দিবা। গুলির শব্দ থেমে গেছে। এখন শুধু মানুষের চিত্কার শোনা যাচ্ছে। ধর! ধর! ধর! এমন নানা ধরনের চিত্কারের মধ্যেই হাবিব ভাইরে গুলি করছে। এমন একটা লাইন কানে এলো দিবার। পড়িমড়ি করে দৌড়ে যায় রাস্তায়। দূর থেকে দেখতে পায় রক্তাক্ত হাবিবকে কয়েকজন মিলে বেবি ট্যাক্সিতে তুলছে। দিবার আর্তচিত্কারে তখন আকাশ বাতাস ভারি হয়ে আসে। হাসপাতালে নেওয়া হয় হাবিবকে। কিন্তু ততক্ষণে তার প্রাণ ভোমরা দেহে নেই। হাবিবের পুরো নাম হাবিবুর রহমান মণ্ডল ওরফে হাবিব মণ্ডল। ২০০০ সালের ২০ আগস্ট পুরান ঢাকার বনগ্রামের নিজ বাসার সামনেই তিনি খুন হন। বাসা থেকে বেরিয়ে কর্মস্থল আদালতপাড়ায় যাওয়ার উদ্দেশে রওনা দিতেই দুর্বৃত্তদের হামলার শিকার হন। এতে ঘটনাস্থলেই তিনি মারা যান। হাবিব মণ্ডল ছিলেন ঢাকা মহানগর বিএনপির যুগ্ম সম্পাদক এবং বিএনপি সমর্থিত আইনজীবী সমিতির নেতা। তত্কালীন সময়ে হাবিব মণ্ডল হত্যাকাণ্ডটি সারা দেশে আলোচিত ঘটনায় পরিণত হয়। বিএনপির মহানগর নেতা বলেই নয়, এই খুনে আন্ডারওয়ার্ল্ডের ভয়ঙ্কর সব কিলার সরাসরি অংশ নেয়। খুনের সঙ্গে সন্ত্রাসীদের গডফাদার শহীদ কমিশনার, তনাই মোল্লা, অদৃশ্য সন্ত্রাসী কালা জাহাঙ্গীর, পিচ্চি হান্নানসহ ভয়ঙ্কর সব খুনির নাম উঠে আসে। আলোচিত এই খুনের ঘটনার পর পুলিশ ও গোয়েন্দারা মাঠে নামে। তাদের তদন্তে বেরিয়ে আসে সেই দিনের খুনের ঘটনাটি। গোয়েন্দারা জানতে পারে, খুনের এই মিশনে অন্তত আটজন কিলার অংশ নেয়। এদের চারজন ছিল সরাসরি খুনে। অপর চারজন ছিল তাদের ব্যাকআপ দেওয়ার জন্য। আইনজীবী হাবিব মণ্ডল ১০/২ চন্দ্রমোহন বসাক স্ট্রিটের ‘লাইলি কটেজ’ থেকে বেরিয়ে তার ভেসপায় চড়ে বসেন। ভেসপার চালকের আসনে ছিলেন তার সহকারী আসাদুজ্জামান। তাদের ভেসপা স্টার্ট করে একটু সামনে এগোনোর সঙ্গে সঙ্গেই চার যুবক তাদের সামনে এসে দাঁড়ায়। এদের চারজনের হাতে ছিল রিভলবার আর কাটা রাইফেল। ভেসপা থেমে যায়। এক যুবক হাবিব মণ্ডলকে উদ্দেশ করে বলে, ‘ওই তোর হায়াত শেষ। তোরে দুনিয়া থেকে সরিয়ে দেওয়ার নির্দেশ আসছে।’ এ কথা বলেই যুবকটি হাবিব মণ্ডলের মাথায় রিভলবার ঠেকায়। হাবিব কিছুই বলার সময় পায়নি। অস্ত্রধারীর আঙ্গুল তখন ট্রিগারে চাপ দেওয়া। গুলি হাবিবের মাথায় ঢুকে যায়। ভেসপা থেকে পড়ে যায় হাবিব। আসাদ এ সময় ভেসপা নিয়ে হাওয়া। অস্ত্রধারীরা হাবিবের বুকে এলোপাতাড়ি গুলি চালাতে থাকে। অস্ত্রধারীদের একজন সেলফোনে উচ্চস্বরে কথা বলতে থাকে। সে বলে, ‘ভাই, অপারেশন সাকসেস’। দুই মিনিটেই মিশন শেষে অস্ত্রধারীরা চারদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পালিয়ে যায়। হাবিব মণ্ডলকে কেন খুন করা হলো? এমন প্রশ্নের জবাব খুঁজতে গিয়ে পুলিশ হিমশিম খায়। পুলিশ এটা নিশ্চিত যে, খুনে পেশাদার খুনিরা অংশ নেয়। আশপাশে অবস্থান নিয়ে থাকে কালা জাহাঙ্গীর পিচ্চি হান্ননানসহ অন্যরা। কিন্তু এই খুনের পেছনে এমন কেউ রয়েছে তার ব্যাপারে পর্যাপ্ত কোনো তথ্য প্রমাণাদি নেই। শহীদ কমিশনারও খুনের ঘটনার সময় ছিল বিদেশে। যে কারণে খুনের ঘটনার এক বছর পর পুলিশ এই খুনের মামলায় ফাইনাল রিপোর্ট দেয়। আদালতে দেওয়া প্রতিবেদনে বলা হয়, খুনের কারণ বের করা সম্ভব হয়নি। হাবিব মণ্ডলের পরিবার এই রিপোর্টের বিরুদ্ধে নারাজি দেয়। নতুন করে তদন্ত শুরু হয়। পরবর্তীতে মামলার তদন্ত শুরু করে সিআইডি। সিআইডির ওই তদন্তে শহীদ কমিশনারের সঙ্গে হাবিব মণ্ডলের দ্বন্দ্ব খুঁজে পাওয়া যায়। শহীদ কমিশনারের ক্যাডারদের বিভিন্ন মামলায় তাদের বিরোধিতা করতেন হাবিব মণ্ডল। এ কারণে দ্বন্দ্ব আরও প্রকট হয়। তাই তাকে দুনিয়া থেকে সরিয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা আঁটে। পরিকল্পনা অনুযায়ী সন্ত্রাসী জোগাড়ের দায়িত্ব দেওয়া হয় তনাই মোল্লাকে। এরপরই শহীদ কমিশনার বিদেশ পাড়ি দেন। তনাই মোল্লা নিজে এই খুনের ঘটনা ঘটায় কিলারদের দিয়ে। সিআইডি পুলিশ তাদের বিরুদ্ধে চার্জশিট প্রদান করে। অবশেষে ঢাকা এক নম্বর দ্রুত বিচার আদালত গত ২০০৩ সালের ২৯ মে মামলার রায় ঘোষণা করে। রায়ে শহীদ কমিশনার ও কালা জাহাঙ্গীরকে মৃত্যুদণ্ড এবং তনাই মোল্লা, পিচ্চি হান্নানসহ ১৩ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত করে। ১০ বছর সাজা খাটার পর আপিল বিভাগের এক রায়ে শহীদ কমিশনার ও তনাই মোল্লা খালাস পায়। তাদের বিরুদ্ধে আদালতে তথ্য প্রমাণ উপস্থাপনে ঘাটতি ছিল বলে জানা গেছে। অপর একটি সূত্র জানায়, খুনের এই ঘটনার বেশ কয়েক বছর পর শহীদ কমিশনারের লোকজন প্রভাব বিস্তার করে হাবিবের স্ত্রীর ওপর। যে কারণে খুনিরাও বেঁচে যায় বলে জানা গেছে।

গোয়েন্দারা জানায়, শহীদ কমিশনার ১৯৮০-এর দশকে ব্যাংক কলোনিতে প্রথমে খুন করেন ৮৩ নম্বর ওয়ার্ডের কমিশনার প্রার্থী সেলিমকে। কয়েক বছর পলাতক থাকার পর ফিরে এসে জাতীয় পার্টির ছত্রছায়া পেয়ে পঙ্গু করে দেন সন্ত্রাসী কালাবাবুকে। পোস্তগোলার শাহাদাৎ কমিশনার ও তার ভাই সুমন, ঢালকানগরের সেলিম, ভাট্টিখানার মাহবুব, সূত্রাপুরের নাসির, মিল ব্যারাকের বুংগা বাবু, ফরিদাবাদের আনু, পিন্টু, পিন্টুর ভাই সেন্টু, মিল ব্যারাকের মাইকেল, ফরিদাবাদ আলমগঞ্জের বাদল এবং কেবি রোডের সেলিম হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে শহীদ কমিশনারের। বিভিন্ন হত্যাকাণ্ডে তিনি ব্যবহার করতেন কালা জাহাঙ্গীর আর ডাকাত শহীদ থেকে শুরু করে বিভিন্ন শীর্ষ সন্ত্রাসীকে।

 

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর