জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ইভিএম (ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন) ব্যবহারের লক্ষ্যে গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) সংশোধনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। তবে এ সিদ্ধান্তে ভিন্নমত পোষণ করে (নোট অব ডিসেন্ট) কমিশন সভা থেকে ওয়াকআউট (বর্জন) করেন অন্যতম নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার। পাঁচ সদস্যবিশিষ্ট নির্বাচন কমিশনের একজন কমিশনারের বর্জনের মধ্য দিয়ে গতকাল আগারগাঁওয়ে নির্বাচন ভবনে কমিশন সভায় আরপিও সংশোধনের সিদ্ধান্ত হয়। এ প্রসঙ্গে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কে এম নূরুল হুদা সাংবাদিকদের বলেন, উনি (মাহবুব তালুকদার) ভিন্নমত পোষণ করেছেন। আমরা চারজন সম্মত হয়েছি। তবে তিনি এও বলেন, আগামী একাদশ সংসদ নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহারের সিদ্ধান্ত এখনো তারা নেননি। গতকাল বেলা ১১টায় কমিশন সভা শুরুর আধা ঘণ্টার মধ্যে রাজনৈতিক দলগুলোর সমঝোতা ছাড়া ইভিএম ব্যবহারের এ উদ্যোগ নিয়ে প্রশ্ন তুলে সভা থেকে বেরিয়ে আসেন নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার। এরপর মাঝখানে আধা ঘণ্টা বিরতি দিয়ে বিকাল ৫টায় শেষ হয় এ সভা। পরে তিন নির্বাচন কমিশনার মো. রফিকুল ইসলাম, কবিতা খানম ও শাহাদাত হোসেন চৌধুরী এবং ইসি সচিব হেলালুদ্দীন আহমদকে নিয়ে সাংবাদিকদের কাছে ব্রিফ করেন সিইসি। সিইসি বলেন, আরপিও সংশোধনী যদি সংসদে পাস হয়, আমরা প্রদর্শনী করব। তাতে স্টেকহোল্ডারদের সম্মতি থাকলে কমিশন বসবে। যদি পরিবেশ অনুকূলে থাকে তখন (ইভিএম) হবে। আইন পাস হলে ১০০ আসনে ইভিএম ব্যবহার সম্ভব হবে কিনা— প্রশ্নে সিইসি বলেন, অবশ্যই সম্ভব হবে। তবে রাজনৈতিক দলগুলো সম্মতি না দিলে কী করবেন— জানতে চাইলে সিইসি বলেন, তখন কমিশনে বসে সিদ্ধান্ত নেব। তিনি বলেন, ২০১০ সালে চালুর পর এতদিন স্থানীয় সরকারের বিভিন্ন নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহূত হলেও সংসদ নির্বাচনে তা ব্যবহার হয়নি। সংসদ নির্বাচনে যন্ত্রের মাধ্যমে ভোট গ্রহণের জন্য গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ বা নির্বাচন আইন সংশোধন প্রয়োজন।
সিইসি বলেন, ইভিএম বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করে আরপিও সংশোধনের সিদ্ধান্ত নিয়েছি আমরা। অল্প কয়েকদিনের মধ্যে তা মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হবে। মন্ত্রণালয়ের সম্মতি পেলে পরবর্তী প্রক্রিয়া শেষে সংসদে উপস্থাপন করা হতে পারে। সাংবাদিকদের প্রশ্নে তিনি বলেন, আরপিও সংশোধনে অনেক প্রস্তাব এলেও মূলত ইভিএমের বিষয়টি ছিল মুখ্য।
আমি তো মূর্তি হয়ে বসে থাকতে পারি না : ইসির ঘোষিত ‘রোডম্যাপের’ বাইরে গিয়ে সংসদ নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহারের সুযোগ তৈরিতে হঠাৎ করে আরপিও সংশোধনের উদ্যোগ নেওয়ায় কমিশন সভা বর্জন করেছেন বলে জানিয়েছেন নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার। গতকাল বিকালে কমিশন সভা শেষ হওয়ার পর সন্ধ্যায় নিজ কার্যালয়ে তিনি এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, আগামী নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহারের জন্য উনারা (সিইসি ও তিন নির্বাচন কমিশনার) বসে বসে আরপিও সংশোধন করবেন; আর আমি সেখানে মূর্তির মতো বসে থাকব, তা তো হয় না। এজন্য বের হয়ে এসেছি। তিনি বলেন, সভা থেকে বেরিয়েছি, কারণ আরপিও সংশোধনের বিষয় সভার কার্যপত্রে ছিল। আমি মোটেও চাই না আরপিও সংশোধন হোক। আমি মনে করি, একাদশ সংসদ নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার করা ঠিক হবে না। কারণ, অধিকাংশ রাজনৈতিক দল ইভিএম চায় না। তিনি বলেন, প্রথম থেকেই বলে আসছি, সব দল না চাইলে ইভিএম ব্যবহার করা হবে না। রোডম্যাপের কোথাও ইভিএম নেই। বিরোধিতা সত্ত্বেও ইভিএমের পক্ষে কমিশন অবস্থান নিলে তখন পরিস্থিতি দেখে নিজের করণীয় ঠিক করবেন বলে জানান মাহবুব তালুকদার। তিনি বলেন, আমি পাঁচ টুকরোর এক টুকরো। আমি সংখ্যাগরিষ্ঠ নই, সংখ্যালঘিষ্ঠ। আমি এখনো মনে করি, সংসদ নির্বাচনের অনেক সময় বাকি। আমি তো গণতন্ত্রমনা মানুষ। সংসদ নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার করলে তখন নির্ধারণ করব। তখনকার অবস্থা কী হবে, তা তো এখন বলতে পারি না। কমিশনের সিদ্ধান্তে ভিন্নমত থাকলেও ইসির ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করতে চান না মাহবুব তালুকদার।নোট অব ডিসেন্টে যা আছে : নোট অব ডিসেন্টে মাহবুব তালুকদার লিখেছেন— বিগত ২৬ আগস্ট নির্বাচন কমিশনে আরপিও সংশোধনে তিন ধরনের প্রস্তাব উপস্থাপন করা হয়। এর মধ্যে প্রথমটি হচ্ছে বাংলা ভাষায় রূপান্তর, যা একজন পরামর্শক তৈরি করে দিয়েছেন। দ্বিতীয়টি হচ্ছে ইংরেজি আরপিওতে সুনির্দিষ্ট কিছু সংশোধন, সংযোজন বা পরিমার্জন। আর সর্বশেষ প্রস্তাবটি ছিল একাদশ সংসদ নির্বাচনে সময়স্বল্পতার কারণে ইভিএম ব্যবহারের জন্য প্রয়োজনীয় সংশোধন। কমিশন সভায় অন্য দুটি প্রস্তাব বাদ দিয়ে কেবল ইভিএম ব্যবহারের বিষয়টি আলোচনায় সীমাবদ্ধ রাখা হয়, যা ৩০ আগস্টের সভায় আলোচনার জন্য মুলতবি করা হয়। মাহবুব তালুকদার লিখেছেন, সরকারি দলের পক্ষ থেকে ইভিএম ব্যবহারকে স্বাগত জানানো হলেও প্রধান বিরোধী দলসহ অন্যান্য রাজনৈতিক দল এর বিরোধিতা করে আসছে। এ অবস্থায় একাদশ সংসদ নির্বাচনে রাজনৈতিক দলগুলোর সমঝোতার মাধ্যমে ইভিএম ব্যবহারের কোনো সম্ভাবনা নেই। রাজনৈতিক দলগুলোর সংলাপে ইভিএম নিয়ে সরকারি ও বিরোধী দলের অবস্থান ছিল পরস্পরবিরোধী। আর সিইসি প্রথম থেকেই বলে এসেছেন, রাজনৈতিক দলগুলো সম্মত হলেই কেবল জাতীয় নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার করা হবে। সে কথা মনে করিয়ে দিয়ে বিদ্যমান পরিস্থিতিতে আরও আলোচনা করার পরামর্শ দিয়েছেন নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার। তিনি লিখেছেন, শুরুতে স্থানীয়ভাবে পরীক্ষামূলকভাবে ইভিএম ব্যবহূত হয়েছিল। এজন্য প্রায় ৫০ কোটি টাকার ইভিএম কেনায় আমি ভিন্নমত পোষণ করেছিলাম। সম্প্রতি ৩ হাজার ৮২১ কোটি টাকার প্রকল্প তৈরি করা হয়েছে। কোনো কোনো রাজনৈতিক দলের বিরোধিতার মুখে জাতীয় নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার যেখানে অনিশ্চিত, সেখানে এ বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় করে ইভিএম কেনা কতটা যৌক্তিক? মাহবুব তালুকদার বলেন, পরিকল্পনা কমিশন এখন পর্যন্ত প্রকল্পটির সম্ভাব্যতা যাচাই করেনি। যে ইভিএম বাংলাদেশ মেশিন টুলস ফ্যাক্টরি থেকে বিনা টেন্ডারে কেনা হচ্ছে, তার কারিগরি বিষয় বুয়েট বা অনুরূপ কোনো সংস্থা থেকে যাচাই করা হয়নি। কারিগরি দিক থেকে এ যন্ত্র সম্পূর্ণ ত্রুটিমুক্ত কিনা তা পরীক্ষা করা হয়নি। আরপিওতে শুধু ইভিএম ব্যবহারের যে সংশোধনী প্রস্তাব আনা হয়েছে তা ইতোমধ্যে কমিশন সভায় নানা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে বলেও মন্তব্য করেন এই নির্বাচন কমিশনার। তিনি লিখেছেন, আমি ধারণা করি, জনমত বা সর্বসম্মত রাজনৈতিক মতের বিরুদ্ধে ইভিএম ব্যবহার হলে তা নিয়ে আদালতে অসংখ্য মামলার সূত্রপাত হবে। অন্য কারণ ছাড়া কেবল ইভিএম ব্যবহারের কারণেই সংসদ নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ হওয়ার শঙ্কা রয়েছে। বর্তমান ইসির পক্ষে এ ঝুঁকি নেওয়া সংগত হবে না। যন্ত্রের অগ্রগতির এ যুগে ইভিএম ব্যবহারের ‘বিরোধী নন’ জানিয়ে মাহবুব তালুকদার বলেন, স্বল্প সময়ে এত বিশাল জনবলের প্রশিক্ষণের অপর্যাপ্ততা ও ভোটারদের অজ্ঞতার কারণে ইভিএম নিয়ে অনীহাও থাকবে। সম্প্রতি সিটি নির্বাচনে কিছু বিশৃঙ্খলা এবং কেন্দ্র দখল করে ইভিএমে একটি দলের পক্ষে ভোট প্রদানের অভিযোগের কথাও নোট অব ডিসেন্টে তুলে ধরেন তিনি।