বুধবার, ১৩ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯ ০০:০০ টা

ঝিমিয়ে কেন্দ্র, তৃণমূল বিএনপি চায় পুনর্গঠন

মাহমুদ আজহার

ঝিমিয়ে কেন্দ্র, তৃণমূল বিএনপি চায় পুনর্গঠন

‘বিএনপির কেন্দ্র থেকে তৃণমূল পর্যন্ত সর্বত্র কাউন্সিলের মাধ্যমে নতুন নেতৃত্ব নির্বাচন করতে হবে। এতে দলের চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার মুক্তি ও গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার আন্দোলন ত্বরান্বিত হবে।’ কথাগুলো বলছিলেন কক্সবাজার জেলা বিএনপির সভাপতি সাবেক এমপি লুৎফর রহমান কাজল। শুধু তিনিই নন, তৃণমূল বিএনপির অধিকাংশ নেতারই অভিমত এমন। তারা মনে করেন, দল এখন ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে। চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া জেলে। ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান দেশের বাইরে। সর্বশেষ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে যেভাবেই হোক ভয়াবহ বিপর্যয় ঘটেছে। এ মুহূর্তে বিএনপিকে ঘুরে দাঁড়াতে হলে দল গোছানোর বিকল্প নেই।

নেতারা মনে করেন, খালেদা জিয়াকে মুক্ত করতে শক্তিশালী আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। নতুন নির্বাচনের দাবি আদায়েও আন্দোলনের বিকল্প নেই। মাঠ পর্যায়ের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে দায়ের হওয়া মামলা থেকে পরিত্রাণ পেতে সহায়তার হাত আরও বাড়াতে হবে। তৃণমূলের কেউ কেউ বলেন, বিএনপির এ মুহূর্তে দলের নির্বাহী কমিটির সদস্যদের নিয়ে একটি বর্ধিত সভাও ডাকা উচিত। সেখানে আসা মতামতের ভিত্তিতেই দল গোছানো জরুরি। দল পুনর্গঠন প্রসঙ্গে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘এই নির্বাচনে জনগণের ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটেনি। সেজন্য আমাদের যা প্রয়োজন, জনগণের ইচ্ছার পুনর্বাসন করতে হবে। এর একমাত্র উপায় দল পুনর্গঠন করা। এ কাজ আগামী কয়েক মাসের মধ্যে করতে হবে।’ বিএনপির যুগ্মমহাসচিব সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল বলেন, ‘নেতা নির্বাচিত হতে হবে বিএনপির তৃণমূল থেকে। ওয়ার্ড, ইউনিয়ন, থানা, উপজেলা, পৌর, জেলা-মহানগরে কাউন্সিলের মাধ্যমে নির্বাচিত কমিটি হতে হবে। এরপর তারাই বিএনপির কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য নির্বাচিত করবেন। অঙ্গসংগঠনগুলোও একইভাবে নির্বাচিত হওয়া উচিত। কিন্তু আমরা চলছি উল্টোপথে।’ তিনি বলেন, ‘আমাদের চেয়ারপাসন বেগম খালেদা জিয়াকে মুক্ত করতে হলে শক্ত আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। নেতা-কর্মীদের জেল থেকে বের করতে হবে। তাদের মামলাগুলো প্রত্যাহার করাতে হবে। প্রশ্নবিদ্ধ ও অগ্রহণযোগ্য নির্বাচনের বার্তা জনগণের কাছে ব্যাপকভাবে তুলে ধরে নতুন নির্বাচনের দাবিতে আমাদের কাজ করতে হবে।’ জানা যায়, খালেদা জিয়ার মুক্তির আগে দল পুনর্গঠন নিয়ে দুই ভাগে বিভক্ত বিএনপি। দলের স্থায়ী কমিটির একটি অংশ বলছে, বেগম জিয়ার অনুমতি নিয়ে এখনই বিএনপিকে গোছাতে হবে। দল পুনর্গঠন করেই তাঁর মুক্তি আন্দোলন ত্বরান্বিত করতে হবে। নতুন নির্বাচনের দাবিও আদায় করা সহজ হবে। স্থায়ী কমিটির আরেকাংশ বলছে, বেগম জিয়ার মুক্তির পর বিএনপি গোছাতে হবে। নইলে যে কোনো ধরনের বিপর্যয় ঘটে যেতে পারে। এতে দল পুনর্গঠন করতে গিয়ে আরও ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তবে বিএনপির নীতিনির্ধারক পর্যায়ের একাধিক নেতা বলছেন, দল গোছাতে আরও কিছুদিন লাগবে। বিএনপি নেতা-কর্মীদের আইনের স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় জামিনে মুক্ত করাতে হবে। বেগম জিয়ার মুক্তিও জরুরি। এর আগে তৃণমূলের পাশাপাশি বিএনপির অঙ্গসংগঠনের কিছু কমিটি হতে পারে। এরপর বিএনপির জেলা কমিটি পুনর্গঠনে হাত দেওয়া হবে। বেগম জিয়ার মুক্তির আগে কাউন্সিল না হলে নির্বাহী কমিটির শূন্য পদগুলো পূরণ করা হবে। স্থায়ী কমিটির শূন্য পাঁচটি পদে পূরণ করা হবে। জানা যায়, চিকিৎসার জন্য সিঙ্গাপুরে গেছেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। সেখান থেকে তিনি যান আমেরিকা। যে কোনো দিন যাবেন লন্ডন। সেখানে ঢাকা থেকে যাওয়া আরও দুই নেতা অবস্থান করছেন। তারা বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সঙ্গে বৈঠক করবেন। চলমান রাজনীতি, সদ্যসমাপ্ত নির্বাচন এবং সাংগঠনিক ভবিষ্যৎসহ নানা বিষয়ে কথা বলবেন তারা। তারেক রহমানের মতামত নিয়ে দেশে ফিরে চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গে কারাগারে সাক্ষাৎ করবেন বিএনপি মহাসচিব। বেগম জিয়া অনুমতি দিলেই দলের পুনর্গঠন নিয়ে চিন্তাভাবনা করা হবে। তবে দলের মেয়াদোত্তীর্ণ অঙ্গসংগঠনগুলো ঢেলে সাজানোর অনুমতি নেওয়া আছে বলে জানা গেছে। সিলেট বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক ডা. সাখাওয়াত হোসেন জীবন বলেন, ‘জেলে যাওয়ার আগে থেকেই ম্যাডাম (খালেদা জিয়া) দল পুনর্গঠনে হাত দিয়েছিলেন। পরে আর সেই ধারাবাহিকতা থাকেনি। এরপর নির্বাচন চলে আসে। আমরা নির্বাচনে অংশগ্রহণ করি। এখন চেয়ারপারসনের কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে দল গোছানো উচিত। একই সঙ্গে তাঁর মুক্তি দাবিতে সরকারকে চাপ প্রয়োগ করতে হবে এবং কথাও বলতে হবে। তৃণমূলে নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে দায়ের হওয়া সব মামলা প্রত্যাহার করাতে কেন্দ্রীয় কমিটিকে বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করতে হবে।’ বিএনপির চট্টগ্রাম বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক মাহবুবুর রহমান শামীম বলেন, ‘কাউন্সিলের মাধ্যমে বিএনপি পুনর্গঠনের কোনো বিকল্প নেই। একইভাবে বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার মুক্তি আন্দোলনও জোরদার করতে হবে। নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকারের দাবি আদায় করে নতুন ভোটের উদ্যোগ নিতে সর্বত্রই চাপ প্রয়োগ করতে হবে।’ খুলনা জেলা বিএনপি সভাপতি অ্যাডভোকেট শফিকুল আলম মনা বলেন, ‘তৃণমূল বিএনপি যাকে চায়, তাকেই কাউন্সিলের মাধ্যমে নেতা বানাতে হবে। এটাই প্রাধান্য দেওয়া উচিত।’

নির্বাহী কমিটির শূন্যপদ পূরণের চিন্তা : কাউন্সিল দেরিতে হলে বিএনপির নির্বাহী কমিটির কিছু শূন্যপদ পূরণ করার চিন্তাভাবনা করা হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে শুধু স্থায়ী কমিটি নয়, দলের চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা পরিষদ, জাতীয় নির্বাহী কমিটির কর্মকর্তা ও সদস্যের শূন্যপদ পূরণেরও উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। এক মাসের মধ্যেই শূন্যপদে নতুন নেতাদের অন্তর্ভুক্ত করা হতে পারে।

সূত্র জানান, দলটির ৭৩ সদস্যের উপদেষ্টা কমিটির বেগম সরোয়ারী রহমান, হারুনুর রশিদ খান মুন্নু, ফজলুর রহমান পটলসহ সাতজন মারা গেছেন। ৩৭ জন ভাইস চেয়ারম্যানের মধ্যে কমিটি ঘোষণার পরপরই পদত্যাগ করেন মোসাদ্দেক আলী ফালু। ইনাম আহমেদ চৌধুরী দলত্যাগ করে আওয়ামী লীগে যোগ দিয়েছেন। নির্বাহী কমিটির গুরুত্বপূর্ণ ছাত্র ও সহছাত্রবিষয়ক সম্পাদক পদ দুটি কমিটি ঘোষণার পরই ফাঁকা। নির্বাহী কমিটির সাতটি আন্তর্জাতিক সম্পাদকের মধ্যে দুটি ফাঁকা। সহযুববিষয়ক সম্পাদকের নাম ঘোষণা করা হলেও যুববিষয়ক সম্পাদকের পদটি এখনো ফাঁকা। এ ছাড়া নির্বাহী কমিটির সদস্যদের মধ্যে মারা গেছেন চারজন। নির্বাহী কমিটির সদস্য নুর মোহাম্মদ ম ল দলত্যাগ করে আওয়ামী লীগে যোগ দিয়েছেন। এসব ফাঁকা পদে নেতাদের অন্তর্ভুক্ত করা হবে।

ভোটে নির্বাচিত হবে অঙ্গসংগঠনের কমিটি : ছাত্রদলসহ মেয়াদোত্তীর্ণ অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠন ঢেলে সাজানোর উদ্যোগ নিয়েছে বিএনপি। পর্যায়ক্রমে তাদের নতুন কমিটি গঠন করা হবে। এসব কমিটি আর প্রেস বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে ‘সুপার ফাইভ’ বা ‘সুপার সেভেন’ নামে হবে না। কাউন্সিলের মাধ্যমে সরাসরি ভোটে নেতা নির্বাচন হবে। জানা গেছে, ছাত্রদলের কমিটির মেয়াদ শেষ হয়েছে দুই বছর আগেই। যুবদলের পূর্ণাঙ্গ কমিটি ঝুলে আছে দীর্ঘদিন ধরে। স্বেচ্ছাসেবক দলেরও একই অবস্থা। কৃষক দল, শ্রমিক দল, তাঁতী দল ও মৎস্যজীবী দলের অবস্থা আরও বেহাল। নির্বাচিত নেতাদের মাধ্যমেই এসব কমিটি পুনর্গঠন করা হবে।

সর্বশেষ খবর