রবিবার, ২১ এপ্রিল, ২০১৯ ০০:০০ টা

বঙ্গবন্ধুবিদ্বেষী অভিনেতাকে ৩৫ লাখ টাকা, অসুখটা কী?

পীর হাবিবুর রহমান

বঙ্গবন্ধুবিদ্বেষী অভিনেতাকে ৩৫ লাখ টাকা, অসুখটা কী?

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা গরিব, অসহায়, দুস্থ অভিনেতা-অভিনেত্রী, এককথায় শিল্পী, কবি, লেখক, সাহিত্যিক, সাংবাদিকদের বিভিন্ন সময় মানবিক হৃদয় নিয়ে অর্থ সাহায্য দিয়ে থাকেন। এমনকি দলের ত্যাগী অনেক নেতা-কর্মীর চিকিৎসাও করিয়েছেন। বিভিন্ন রাজনৈতিক কারণে প্রতিপক্ষের হামলার শিকার দলের নিবেদিতপ্রাণ কর্মীরা যখন আহত হয়েছেন, পঙ্গু হয়েছেন তখনো তাদের নিরাপদ আশ্রয় দিয়েছেন। তার মানবিক হৃদয়ের সামনে যখন যারা নিজেদের অসহায় অবস্থা তুলে ধরেছেন তখনই তিনি সেই অসহায়ের পাশে দাঁড়িয়েছেন। আর্থিক অনুদান দিয়েছেন। দিয়েছেন চিকিৎসা সাহায্য। ’৯৬ সালে ক্ষমতায় থাকাকালে তিনি শিল্পী সুবীর নন্দীর চিকিৎসার জন্য যেমন সহযোগিতার হাত বাড়িয়েছেন তেমনি এবারও এই দেশবরেণ্য সংগীতশিল্পীর পাশেই শুধু দাঁড়াননি, উন্নত চিকিৎসার জন্য সিঙ্গাপুরে কাগজপত্রও পাঠাতে বলেছেন। সুবীর নন্দী এখন মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছেন। সিএমএইচে তার চিকিৎসা চলছে। একসময়ে পর্দা কাঁপানো চলচ্চিত্র, নাটক, যাত্রা ও সংগীতশিল্পীদের মধ্যে রানী সরকার, আমজাদ হোসেন, প্রবীর মিত্র, ফরিদ আলী, আনোয়ারা, খালেদা আক্তার কল্পনা, শুভ্রা দে, শহীদুল ইসলাম খোকন, মায়া ঘোষ, মঞ্জুর হোসেন, নূতন, সাত্তার, বনশ্রী, টেলি সামাদ, ড্যানিরাজ, আফজাল শরীফ, মিনু মমতাজ, সংগীতজ্ঞ আলাউদ্দিন আলী, লাকী আখন্দ, কাঙ্গালিনী সুফিয়া ইত্যাদি খ্যাত কণ্ঠশিল্পী আকবর, শঙ্কর হাজারী, রেহানা জলিসহ অনেককে আর্থিক সাহায্য ও চিকিৎসা সহায়তা দিয়েছেন। এদের কেউ কেউ ইন্তেকালও করেছেন। সম্প্রতি এককালের খলনায়ক ও চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতির সাবেক সভাপতি আহমেদ শরীফকে তার স্ত্রীসহ চিকিৎসার জন্য ৩৫ লাখ টাকার চেক দিয়েছেন। আহমেদ শরীফ সেই চেক নিয়ে সেদিন রাতেই চলচ্চিত্র প্রযোজক শফি বিক্রমপুরীর ৫০তম বিয়েবার্ষিকীর আনন্দ অনুষ্ঠানে যোগ দেন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমসহ শিল্পী কলাকুশলীদের মধ্যেও প্রশ্ন উঠেছে- আহমেদ শরীফের অসুখটা কী? তার আর্থিক অভাব-অনটন আসলে কোন পর্যায়ে? শিল্পী সমিতি থেকে কয়েকদিন আগে তিনি ৫০ হাজার টাকা সাহায্য নিয়েছেন। উত্তরায় তার নিজস্ব বাসভবন রয়েছে। হাউজিং ব্যবসার সঙ্গে জড়িত আছেন এমন খবরও ছবিসহ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দেখা যায়। শিল্পী সমিতির মাধ্যমে বা পরিচালক প্রযোজক সমিতির মাধ্যমেও তাকে আর্থিক সাহায্য দিতে প্রধানমন্ত্রীর কাছে আবেদন করা হয়নি। তাহলে প্রধানমন্ত্রীর কাছে আহমেদ শরীফের জন্য এই আর্থিক অনুদানপ্রাপ্তির নেপথ্যে কে বা কারা ছিলেন? আসলেও আহমেদ শরীফ চিকিৎসার জন্য ৩৫ লাখ টাকা প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে একজন অসহায় মানুষ হিসেবে পাওয়ার যোগ্য কিনা তা কি খতিয়ে দেখা হয়েছে? এ প্রশ্নও উঠেছে।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার শাসনামলে বিএনপিমনা অনেকেই চিকিৎসা সাহায্য পেয়েছেন। অনেকে রাষ্ট্রীয় পদকও পেয়েছেন। এটা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মহানুভবতা। তিনি লেখক, শিল্পী, সাহিত্যিকদের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দলীয় দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দেখেননি। আহমেদ শরীফ বিএনপি ও এরশাদের জাতীয় পার্টি করে আসা একজন খলনায়কই নন। অভিযোগ আছে, ২০০৩ সালে খুলনা সরকারি মহিলা কলেজের ছাত্রী সংসদ নির্বাচনে ছাত্রদল বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছিল। সেই ছাত্রী সংসদের অভিষেক অনুষ্ঠানে জিয়াভক্ত আহমেদ শরীফকে অতিথি করে নেওয়া হয়। সেখানে তিনি মঞ্চে উঠেই বক্তৃতায় বলেছিলেন, ‘মুজিব যদি জাতির পিতা হন তাহলে আমি কার সন্তান? একাত্তরে মুজিব ছিলেন পাকিস্তানের এয়ারকন্ডিশন ঘরে। সেখানে তিনি আপেল-আঙ্গুর খেয়েছেন আর আমার নেতা শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান যুদ্ধ করে দেশকে স্বাধীন করেছেন’। এ ধরনের ইতিহাস বিকৃতকারী বঙ্গবন্ধুবিদ্বেষী মানুষকেও প্রধানমন্ত্রীর আর্থিক অনুদান তার মহান হৃদয়ের পরিচয় দেয়। কিন্তু সবার মনে এই প্রশ্ন আজ সত্যিই জেগেছে- সুস্থ সবল, হাঁটাচলা করা আহমেদ শরীফের অসুখটা কী, যার জন্য তাকে ৩৫ লাখ টাকা চিকিৎসা অনুদান দেওয়া হলো? প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে বা আহমেদ শরীফের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে একটি বক্তব্য বা ব্যাখ্যা জনগণের সামনে আসা উচিত। এ দেশে এখনো অনেক মুক্তিযোদ্ধা করুণ জীবন যাপন করছেন। এ দেশে অনেক নিবেদিতপ্রাণ আওয়ামী পরিবারের সদস্য অসহায় জীবন যাপন করছেন। চরম দারিদ্র্যের মুখোমুখি আছেন। মুক্তিযুদ্ধের অনেক অনন্যসাধারণ সংগঠক থেকে অসংখ্য অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক এবং বিভিন্ন পেশার মানুষ অসুখ-বিসুখে অর্থকষ্টে ভিটেমাটি বিক্রি করে নিঃস্ব হচ্ছেন। তাদের কথা কেউ প্রধানমন্ত্রীর কাছে নিয়ে যান না। বহু আগে আমি একবার লিখেছিলাম, সুনামগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক মরহুম অ্যাডভোকেট আকমল আলীর সন্তানরা চরম দারিদ্র্যের সঙ্গে লড়াই করছেন। তার সন্তানরা দলের দুঃসময়ে ভূমিকা রেখেছেন। তাদের খবর কেউ প্রধানমন্ত্রীর কাছে নিয়ে যান না। সুনামগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের আরেক নেতা ও মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক মরহুম সৈয়দ দেলওয়ার হোসেনের সন্তানরা রাস্তায় রাস্তায় ঘোরেন। তাদের করুণ চিত্র একজন জেলা আওয়ামী লীগের নেতাও প্রধানমন্ত্রীর কাছে পৌঁছান না। এ ধরনের অবস্থা সারা দেশে অনেক রয়েছে। অথচ নানা পথ দিয়ে বঙ্গবন্ধুকে আওয়ামী লীগের দুঃসময়ে কটাক্ষ করা ব্যক্তিরাও মুজিবকন্যার হাত থেকে ৩৫ লাখ টাকার আর্থিক অনুদান বাগিয়ে নেন! এককালের দাপুটে খল অভিনেতা বাবর, নির্মাতা ছটকু আহমেদ, অভিনেতা জ্যাকি আলমগীর, সুরুজ বাঙ্গালী, জনপ্রিয় টিভি সিরিজ সকাল-সন্ধ্যার মাখনা ভাই খ্যাত হাবিবুল হাসান মাখনা, প্রযোজক সৈয়দ মোজাফফর হোসেন, অভিনেতা কালা আজিজ, জামিলুর রহমান শাখা অসহায়, অসুস্থ জীবন যাপন করছেন। তাদের কথা কেউ প্রধানমন্ত্রীর কাছে নিয়ে যান না। জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত মেকআপম্যান হারুন ভিক্ষা করেন, রহমান অন্ধ হয়ে বস্তিতে জীবন কাটান- তাদের খবরও কেউ নেন না। অথচ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে প্রকৃত দুস্থ-অসহায় শিল্পী, লেখক, রাজনৈতিক কর্মী ও বীর মুক্তিযোদ্ধাদের প্রকৃত করুণ চিত্র তুলে ধরলে তিনি ফিরিয়ে দেন না। অনেক দুস্থ সাংবাদিকই নন প্রখ্যাত কবি নির্মলেন্দু গুণের পাশেও তিনি দাঁড়িয়েছেন। সাংবাদিকদের কল্যাণে ২০ কোটি টাকার তহবিলও দিয়েছেন। সমাজে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার অনেক মানুষ রয়েছেন যারা অর্থকষ্টে চিকিৎসার ব্যয়ভার বহন করতে পারছেন না। পরিবার-পরিজন নিয়ে আর্থিক চরম অভাব-অনটনে জীবন কাটাচ্ছেন। অথচ কারও কাছে হাত পাততেও পারেন না। অন্তহীন বেদনা নিয়ে জীবনের যুদ্ধ করে যাচ্ছেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মানবিক হৃদয় নিয়ে অসহায়ের পাশে দাঁড়ানোর এ উদ্যোগ অব্যাহত থাকুক আমরা চাই। প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে প্রকৃত অসহায়, অসুস্থ ও বিপদগ্রস্ত মানুষরা এ সাহায্য নিরন্তর পেয়ে যাক এটাই প্রত্যাশা করি। প্রকৃত দুস্থ, অসহায়, সহায়সম্বলহীন মানুষরাই যেন এ সাহায্য-অনুদান পেয়ে থাকেন।

সর্বশেষ খবর