শনিবার, ১৫ জুন, ২০১৯ ০০:০০ টা

বাজেটের যত ভালোমন্দ

রুকনুজ্জামান অঞ্জন

বাজেটের যত ভালোমন্দ

প্রস্তাবিত বাজেটে বেশ কিছু ইতিবাচক দিক রয়েছে। বিশেষ করে দেশীয় শিল্পের বিকাশে ব্যবহৃত বিভিন্ন উপকরণের শুল্ক হ্রাস ও মওকুফ করা হয়েছে। কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও রপ্তানি বাড়াতে বিভিন্ন শিল্পে কর অবকাশ সুবিধা অব্যাহত রাখার পাশাপাশি নতুন ১০টি খাত- কৃষি যন্ত্রপাতি, আসবাবপত্র, গৃহস্থালি সরঞ্জাম-রাইস কুকার, ব্লেন্ডার, ওয়াশিং মেশিন, মোবাইল ফোন, খেলনা, চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য, এলইডি টেলিভিশন এবং প্লাস্টিক রি-সাইক্লিং শিল্প কর অবকাশ সুবিধার আওতায় আনা হয়েছে। এ ছাড়াও স্থানীয় লিফট, রেফ্রিজারেটর, এয়ার কন্ডিশনার, মোটর, মোল্ড এবং পাদুকা শিল্পকে সুরক্ষায় এ খাতে ব্যবহৃত বিভিন্ন উপকরণের আমদানি শুল্ক কমানো হয়েছে। স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত মোটরসাইকেল ও সেলুলার ফোনকে সুবিধা দিতে বিদেশ থেকে আমদানি মোটরসাইকেল ও স্মার্ট ফোনের শুল্ক বাড়ানো হয়েছে।

এসব উদ্যোগের ফলে দেশীয় শিল্পগুলো নিজেদের পণ্যের মান বাড়ানোর পাশাপাশি উৎপাদন বৃদ্ধির উদ্যোগ নিতে পারবে। রাজধানী ঢাকার পাশাপাশি নগর সম্প্রসারণেও বাজেটে নজর দেওয়া  হয়েছে। পূর্বাচল নতুন শহরে পিপিপি পদ্ধতিতে ৬০ হাজার ফ্ল্যাট নির্মাণের পরিকল্পনার কথা রয়েছে বাজেটে।  বিদ্যমান আইনে বার্ষিক ৩৬ লাখ টাকা পর্যন্ত টার্নওভার হলে ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাকে (এসএমই) আয়কর দিতে হয় না। এবার এটি বাড়িয়ে ৫০ লাখ টাকায় উন্নীত করা হয়েছে। এতে এসএমই খাত কিছুটা সুবিধা পাবে। এ ছাড়া ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক ব্যবসায়ীদের ৫০ লাখ পর্যন্ত টার্নওভার ভ্যাটের আওতামুক্ত রাখা হয়েছে। পোল্ট্রি, ডেইরি ও ফিশ শিল্পে ব্যবহৃত উপকরণ শুল্ক কমানো হয়েছে। ফলে এ শিল্পের ব্যবসায়ীরা কিছুটা সুবিধা পাবেন। লিফট ও কম্প্রেসার প্রস্তুতকারী এবং পাদুকা শিল্পে ব্যবহৃত উপকরণের রেগুলেটরি ডিউটি ও সম্পূরক শুল্ক মওকুফ করা হয়েছে। স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত মোল্ড শিল্প প্রতিষ্ঠানে ব্যবহৃত উপকরণ ব্রাস ওইয়ার এবং কপার প্লেটের বিদ্যমান শুল্ক ১০ শতাংশ থেকে ১ শতাংশে নামিয়ে আনা হয়েছে। কৃষি খাতে প্রণোদনা হিসেবে কৃষি যন্ত্রপাতি পাওয়ার টিলার অপারেটর সিডার, পাওয়ার রিপার, কম্বাইন্ড হার্ভেস্টার, লিফট পাম্প, রোটারি টিলারের ওপর স্থানীয় ও উৎপাদন পর্যায়ে মূসক অব্যাহতি রয়েছে। এ ছাড়া নারী উদ্যোক্তা কর্তৃক পরিচালিত শোরুমের ওপর ভ্যাট অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। ভ্যাট অব্যাহতির ঘোষণা রয়েছে পিপিপি প্রকল্পে বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান, কনসালটেন্সি ও সুপারভাইজরি ফার্ম, যোগানদার ও আইন পরামর্শক সেবার ওপর এবং হাইটেক পার্কে বিদ্যুৎ বিতরণ সেবার ওপর। এতে পিপিপি প্রকল্পে বিনিয়োগে আগ্রহী হবে বেসরকারি খাত।  কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে বিশেষ জনগোষ্ঠীর প্রশিক্ষণ ও দক্ষতা বাড়াতে ১০০ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে। যুবকদের ব্যবসা উদ্যোগ শুরু করতে বাজেটে আরও ১০০ কোটি টাকার তহবিল বরাদ্দের ঘোষণা রয়েছে। বৈদেশিক মুদ্রার মজুদ বাড়াতে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্সের ওপর ২ শতাংশ প্রণোদনা দেওয়া হবে। এর ফলে বৈধ পথে রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়বে, হুন্ডি ব্যবসা নিরুৎসাহিত হবে। প্রবাসী কর্মীদের জন্য বীমা সুবিধার প্রতিশ্রুতি রয়েছে। নদী ভাঙন কবলিত এলাকার ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের জন্য ১০০ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। কৃষকদের ফসল কাটা ও তার পরবর্তী কার্যক্রমে ব্যবহৃত যন্ত্রপাতি ক্রয়ে কৃষককে ভর্তুকির ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। পাইলট ভিত্তিতে শস্যবীমার প্রতিশ্রুতি রয়েছে বাজেটে। গবাদিপশু বীমা ও দরিদ্র নারীদের জন্য ক্ষুদ্র বীমার প্রতিশ্রুতি রয়েছে। এ ছাড়া কারখানা শ্রমিকদের দুর্ঘটনাজনিত বীমা এবং সরকারি কর্মকর্তাদের গ্রুপ বীমার আওতায় আনার কথাও বলা হয়েছে।  পেনশনারদের হয়রানি কমাতে আগামী অর্থবছরের মধ্যে সব পেনশনারকে ব্যাংক অ্যাকাউন্টে স্বয়ংক্রিয়ভাবে পেনশন পাঠিয়ে দেওয়ার ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। এতে বয়স্ক পেনশনাররা সহজেই পেনশনের টাকা তুলতে পারবেন। সরকারি পেনশনের পাশাপাশি প্রাতিষ্ঠানিক ও অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে সর্বজনীন পেনশনের লক্ষ্যে ইউনিভার্সেল পেনশন অথরিটি গঠনের ঘোষণা রয়েছে। যে কোনো প্রতিষ্ঠানে মোট জনবলের ১০ শতাংশ প্রতিবন্ধী জনগোষ্ঠীকে নিয়োগ দিলে সে প্রতিষ্ঠানের প্রদেয় করের ৫ শতাংশ রেয়াত প্রদানের প্রস্তাব করা হয়েছে। বর্তমানে তৈরি পোশাক রপ্তানিতে চারটি খাতে প্রণোদনা রয়েছে। আগামী অর্থবছরে তৈরি পোশাকের অবশিষ্ট খাতগুলোতেও ১ শতাংশ হারে রপ্তানি প্রণোদনা দেওয়ার কথা রয়েছে। এতে পোশাক রপ্তানি থেকে আয় বাড়বে। উৎপাদনশীলতা বাড়াতে বাজেটে গবেষণায় গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। এ জন্য গবেষণা ও উন্নয়ন খাতে আগামী অর্থবছরে অতিরিক্ত ৫০ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। বিনিয়োগ বাড়াতে ৬৪ জেলায় ওয়ান স্টপ সার্ভিসের কথা বলা হয়েছে। শিক্ষা খাতের মান উন্নয়নে শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ ও বিদেশ থেকে শিক্ষক আনার পরিকল্পনা রয়েছে। নতুন করে স্কুল এমপিওভুক্তিরও প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে। স্বাস্থ্য খাতেও বেশ কিছু ভালো উদ্যোগ রয়েছে। ক্যান্সার চিকিৎসার উন্নয়নে ২০১৯-২০ অর্থবছরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি বিশ্বমানের বোন ম্যারো ট্রান্সপ্লান্ট ইউনিট স্থাপন করা; তিনটি নার্সিং কলেজ ও পাঁচটি নার্সিং বয়েজ হোস্টেল স্থাপন করা; এ ছাড়া আগামী অর্থবছরে দেশের ৮টি মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ক্যাম্পাসে ইনস্টিটিউট অব নিউক্লিয়ার মেডিসিন অ্যান্ড অ্যালায়েড সায়েন্সেস স্থাপন করার ঘোষণা দেওয়া হয়েছে।

 ব্যাংকিং খাতে সংস্কারের পাশাপাশি ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থার কথা বলা হয়েছে। পুঁজিবাজারেও রয়েছে নানা প্রণোদনা। এ ছাড়া মুক্তিযোদ্ধাদের ভাতা ১০ হাজার টাকা থেকে ১২ হাজার টাকায় উন্নীত করা হয়েছে। বেড়েছে সামাজিক নিরাপত্তাভোগীদের সংখ্যা ও ভাতার হার।

বাজেটে এসব উদ্যোগের পাশাপাশি রয়েছে বেশ কিছু নেতিবাচক দিকও। সঞ্চয়পত্রে উৎসে কর বাড়িয়ে ৫ শতাংশ  থেকে ১০ শতাংশে উন্নীত করা হয়েছে। এর ফলে অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা ছাড়াও দেশের যেসব সিনিয়র সিটিজেন ও নারী যারা সঞ্চয়পত্রের আয়ের ওপর নির্ভরশীল, তাদের আয় কমে যাবে। গুঁড়ো দুধ, ভোজ্যতেল ও চিনির ওপর শুল্ক বাড়ানোর ফলে মধ্যবিত্তের ওপর চাপ বাড়বে। সিম/রিম কার্ড ব্যবহারে প্রদত্ত সেবার বিপরীতে ৫ শতাংশ শুল্ক ১০ শতাংশে উন্নীত করায় মোবাইল ফোনে কথা বলায় ব্যয় বাড়বে। এটিও মধ্যবিত্তের খরচ বাড়িয়ে দেবে। এ ছাড়া স্মার্ট ফোনের শুল্ক বাড়ায় তরুণ প্রজন্মের খরচ বাড়বে। টেলিভিশন বা অনলাইনের মাধ্যমে অনুষ্ঠান সরবরাহকারীদের ভ্যাটের আওতায় আনা হয়েছে। এর ফলে বিনোদনে ব্যয় বাড়বে। ক্ষতিগ্রস্ত হবে বাংলাদেশের বেসরকারি টেলিভিশন শিল্প।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর