বৃহস্পতিবার, ২০ জুন, ২০১৯ ০০:০০ টা

অগ্রিম করের হুমকিতে শিল্প খাত

নিজস্ব প্রতিবেদক

অগ্রিম করের হুমকিতে শিল্প খাত

২০১৯-২০ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে শিল্পের মূলধনী যন্ত্রপাতি ও কাঁচামালের ওপর ৫ শতাংশ অগ্রিম কর (এটি) আরোপ করায় হুমকিতে পড়েছে দেশীয় শিল্প খাত। ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, এভাবে অযৌক্তিক অগ্রিম কর আরোপে ব্যবসায়ীরা বেশি হয়রানির শিকার হবেন। বাধাগ্রস্ত হবে নতুন বিনিয়োগ ও শিল্প খাত। নেতিবাচক প্রভাব পড়বে ব্যবসা-বাণিজ্য ও শিল্পে। অর্থনীতির জন্যও বড় ক্ষতির কারণ হবে। তাই চূড়ান্ত বাজেটে ৫ শতাংশ অগ্রিম কর বাতিলের দাবি করছেন ব্যবসায়ী ও অর্থনীতিবিদরা। ক্ষুব্ধ ব্যবসায়ীরা বলেছেন, এবারের বাজেটে বিনিয়োগ বৃদ্ধির পদক্ষেপের বদলে শিল্প উদ্যোক্তাদের ঘাড়ে অগ্রিম করের বোঝা চাপানো হয়েছে। এতে নতুন বিনিয়োগে বাধা সৃষ্টি হবে। শিল্প সম্প্রসারণ সংকুচিত হবে এবং উৎপাদন খরচ অনেকাংশে বাড়বে। এটা সরকারের ব্যবসা সহজকরণ নীতির পরিপন্থী। দেশে শিল্পবান্ধব পরিবেশের স্বার্থে এ ধরনের কর আরোপ করা উচিত হবে না। জানা যায়, প্রস্তাবিত বাজেটে অর্থ আইনের মাধ্যমে নতুন ভ্যাট আইনের ৩১ ধারা সংশোধন করে সব ধরনের আমদানি পণ্যের ওপর ৫ শতাংশ হারে অগ্রিম কর আরোপ করা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, করযোগ্য আমদানির ওপর ৫ শতাংশ আগাম কর আদায় করতে হবে। প্রত্যেক নিবন্ধিত আমদানিকারক নির্ধারিত পদ্ধতিতে সংশ্লিষ্ট কর মেয়াদে মূল্য সংযোজন কর-মূসক বা ভ্যাট দাখিলপত্রে পরিশোধিত আগাম করের সমপরিমাণ অর্থ সমন্বয় করতে পারবেন। যারা নিবন্ধিত নন, তারা কমিশনারের কাছে আগাম কর ফেরত পাওয়ার জন্য আবেদন করতে পারবেন। শিল্পের মূলধনী যন্ত্রপাতি ও কাঁচামালের পাশাপাশি খাদ্যদ্রব্য হিসেবে ডাল, গম, পিয়াজ, ভোজ্যতেল, সার-বীজ আমদানিতেও অগ্রিম কর আরোপ করা হয়েছে। ফলে নিত্যপ্রয়োজনীয় ভোগ্যপণ্যের দাম বাড়ার আশঙ্কা করছেন ব্যবসায়ীরা। এদিকে সংসদে বাজেট পেশের পরই সারা দেশের কাস্টম হাউসগুলোয় এই অগ্রিম কর আদায় শুরু হয়েছে। এ ক্ষেত্রেও তৈরি হয়েছে নানান বিভ্রান্তি। ব্যবসায়ী-শিল্পপতিদের শীর্ষ সংগঠন বাংলাদেশ শিল্প ও বণিক সমিতি ফেডারেশন-এফবিসিসিআই সভাপতি শেখ ফজলে ফাহিম গতকাল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, আমরা যেখানে ব্যবসা সহজকরণের কথা বলছি, সেখানে শিল্পের মূলধনী যন্ত্রপাতি ও কাঁচামালের ওপর অগ্রিম কর আরোপ করায় ব্যবসায়ীদের নিরুৎসাহিত করবে। শিল্পের নতুন বিনিয়োগ ও সম্প্রসারণে জটিলতা তৈরি করবে। অন্যদিকে এই অগ্রিম কর ফেরত নেওয়ার ক্ষেত্রেও জটিলতা বাড়াবে। চূড়ান্ত বাজেটে ৫ শতাংশ অগ্রিম কর বাতিলের দাবি করছে এফবিসিসিআই।

পোশাকশিল্প মালিকদের শীর্ষ সংগঠন বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুত ও রপ্তানিকারক সমিতি-বিজিএমইএ সভাপতি ড. রুবানা হক বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, প্রস্তাবিত বাজেটে এ ধরনের অগ্রিম কর শিল্পের জন্য উদ্বেগজনক। এটা শিল্পবান্ধব পদক্ষেপ নয়। বরং আমাদের উদ্যোক্তারা নিরুৎসাহিত হবেন। যেখানে আমরা প্রণোদনা চাই, সেখানে অগ্রিম কর আরোপ অযৌক্তিক। এটা শিল্পের জন্য ক্ষতির কারণ হবে। বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্ড স্ট্রাটেজিক স্টাডিজ-বিআইআইএসএসের গবেষণা পরিচালক অর্থনীতিবিদ ড. মাহফুজ কবির বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, অগ্রিম কর ফেরতের নামে ভয়ঙ্কর হয়রানি হবে। আসলে ব্যবসায়ীরা কখনো সরকারি কোষাগারে টাকা দিয়ে ফেরত পান না। ফলে মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানিতে অগ্রিম কর আরোপ করায় ব্যবসা-বাণিজ্য ও শিল্পে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। নতুন বিনিয়োগ ও শিল্প খাত বাধাগ্রস্ত হবে। অর্থনীতির জন্যও বড় ক্ষতির কারণ হবে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড-এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, শিল্পের মূলধনী যন্ত্রপাতি ও কাঁচামালের ওপর এভাবে অগ্রিম কর আরোপ যৌক্তিক নয়। এতে ব্যবসায়ীরা আরও বেশি হয়রানির শিকার হবেন। এই কর সমন্বয় করতে গেলে টেকনিক্যাল সমস্যা হবে। জটিলতা বাড়বে। এবার যে কর ফেরত দেওয়া হবে, সেই কর অগ্রিম হিসেবে কেন নিতে হবে? এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ-ইএবি সভাপতি আবদুস সালাম মুর্শেদী বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, নতুন ভ্যাট আইনের সুষ্ঠু ব্যবহার ও বাস্তবায়ন প্রত্যাশা করছি। রপ্তানি খাতকে সম্পূর্ণ ভ্যাট আওতামুক্ত রাখার দাবি করছি। আর শিল্পের মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানির ওপর আরোপিত ৫ শতাংশ অগ্রিম কর বাতিলের জন্য বিশেষভাবে অনুরোধ করছি। বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশন-বিটিএমএ সভাপতি মোহাম্মদ আলী খোকন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, মূলধনী যন্ত্রপাতি ও কাঁচামালের ওপর অগ্রিম কর নিলে শিল্প খাতের বিকাশ হবে না। দেশেরও কোনো উপকার হবে না। আমাদের অর্থনীতিকে শিল্পবান্ধব করতে এ ধরনের কর আরোপ করা যাবে না। জানা গেছে, পুরনো ভ্যাট আইনের আওতায় শুধু বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে আমদানি হওয়া ৬ হাজার ৫৪২টি পণ্যের ওপর ৫ শতাংশ অগ্রিম ট্রেড ভ্যাট (এটিভি) আরোপিত ছিল। মূলধনী যন্ত্রপাতি ও শূন্য শুল্ক আরোপিত পণ্যে এটিভি দিতে হতো না। নতুন আইনের আওতায় অগ্রিম ট্রেড ভ্যাটের (এটিভি) পরিবর্তে একই হারে আমদানি পর্যায়ে অগ্রিম কর আরোপ করা হয়। কিন্তু নতুন আইনে অগ্রিম করের আওতা ব্যাপকভাবে বিস্তৃত করে মূলধনী যন্ত্রপাতি ও ভোগ্যপণ্যের ওপরও ৫ শতাংশ অগ্রিম কর আরোপ করা হয়েছে। মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানিসংক্রান্ত কাস্টমসের একটি প্রজ্ঞাপনে দেওয়া এইচএস কোডের তালিকা অনুযায়ী স্থানীয় উদ্যোক্তারা ১ শতাংশ শুল্ক দিয়ে ৬৫৯ ধরনের যন্ত্রপাতি আমদানি করতে পারতেন। এর বাইরে অন্য কোনো কর দিতে হতো না। কিন্তু এখন আমদানি পর্যায়ে সব আইটেমের ওপর অগ্রিম কর আরোপ করায় স্থানীয় উদ্যোক্তাদের মূলধনী যন্ত্রপাতি আনতে বিদ্যমান ১ শতাংশ শুল্কের সঙ্গে বাড়তি ৫ শতাংশ অগ্রিম কর দিতে হবে। এ ছাড়া শিল্পে ব্যবহৃত শূন্য শুল্কে আমদানি হওয়া কাঁচামাল যেমন কাঁচা তুলা, ভিসকস ফাইবার, পলিয়েস্টার আমদানিতে ৫ শতাংশ অগ্রিম কর আরোপ করা হয়েছে। ফলে আগে ১ কোটি টাকার মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানি করতে একজন শিল্প উদ্যোক্তাকে যেখানে ১ লাখ টাকা শুল্ক দিতে হতো, সেখানে প্রস্তাবিত বাজেট অনুযায়ী ১ শতাংশ আমদানি শুল্কের সঙ্গে অতিরিক্ত ৫ শতাংশ অগ্রিম করসহ মোট ৬ শতাংশ কর দিতে হবে। ফলে ১ কোটি টাকার মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানিতে একজন আমদানিকারককে বিদ্যমান ১ লাখ টাকার সঙ্গে অতিরিক্ত আরও ৫ লাখ টাকা কর প্রদান করতে হবে।

সর্বশেষ খবর