রবিবার, ১৮ আগস্ট, ২০১৯ ০০:০০ টা

দ্রুত বিচার মামলায়ও ধীরগতি

৯ ট্রাইব্যুনালে বিচারাধীন ৩ হাজার মামলা, ১২০ দিনে নিষ্পত্তির বিধান থাকলেও ঝুলছে বছরের পর বছর

আরাফাত মুন্না

দ্রুত বিচার মামলায়ও ধীরগতি

২০০৫ সালের ২৭ জানুয়ারি। হবিগঞ্জের বৈদ্যেরবাজারে আওয়ামী লীগের জনসভায় গ্রেনেড হামলা হয়। এ হামলায় সাবেক অর্থমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ নেতা শাহ এ এম এস কিবরিয়াসহ পাঁচজন নিহত হন। হত্যাকান্ডের ১০ বছর পর ২০১৫ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর অভিযোগ গঠনের মধ্য দিয়ে এ হত্যাকান্ডের বিচার শুরু করে সিলেটের দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল। আইন অনুযায়ী ১২০ কার্যদিবসের মধ্যে মামলা নিষ্পত্তির বিধান থাকলেও বিচার শুরুর চার বছরেও নিষ্পত্তি হয়নি চাঞ্চল্যকর এ মামলাটি। শুধু এ মামলাই নয়, সারা দেশে নয়টি দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে ঝুলে আছে এমন তিন হাজারের বেশি মামলা। আইনজ্ঞরা বলেন, বিচারে দীর্ঘসূত্রতা দেশের বিচার বিভাগের জন্য বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। আইনশৃঙ্খলা বিঘ্নকারী অপরাধের মামলাগুলো দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল করা হলেও সাক্ষী না আসা, প্রয়োজনের তুলনায় কম ট্রাইব্যুনাল থাকাসহ নানা কারণে এখানেও মামলা নিষ্পত্তির গতি কম। ফলে সাধারণ মানুষ আইনের প্রকৃত সুফল থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। তারা আরও বলেন, বিচার প্রার্থীদের জন্য দ্রুত ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে সমস্যাগুলো খুঁজে বের করে সমাধান করতে হবে। এক্ষেত্রে নজরদারি বাড়াতে হবে। সুপ্রিম কোর্টের সর্বশেষ পরিসংখ্যান অনুযায়ী, চলতি বছরের ৩১ মার্চ পর্যন্ত দেশের নয়টি দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে দ্রুত বিচার আইনে করা ৩ হাজার ৫১টি মামলা বিচারাধীন। এর মধ্যে ঢাকার চারটি ট্রাইব্যুনালে ঝুলে আছে ২ হাজার ১৩৯টি মামলা। চট্টগ্রামে ৪৬, রাজশাহীতে ১৮১, খুলনায় ৩১৮, বরিশালে ৩৩৮ এবং সিলেটে নিষ্পত্তির অপেক্ষা রয়েছে ২৯টি মামলা। পাঁচ বছরের অধিক সময় ধরে বিচারাধীন ২৮৭টি মামলা। আর উচ্চ আদালতের নির্দেশে স্থগিত রয়েছে ৫৬টি মামলা। আইনশৃঙ্খলা বিঘ্নকারী অপরাধ নিয়ন্ত্রণে ২০০২ সালে প্রণয়ন করা হয় ‘আইনশৃঙ্খলা বিঘ্নকারী অপরাধ (দ্রুত বিচার) আইন’। আর এ আইনের অধীনে মামলাগুলো দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য একই বছর দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল আইনও প্রণয়ন করে তৎকালীন সরকার। দ্রুত বিচার আইন প্রণয়নের সময় দুই বছরের জন্য আইনটি করা হলেও বিভিন্ন সময়ে এর মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে। সম্প্রতি এ আইনের মেয়াদ আরও পাঁচ বছর বাড়িয়েছে সরকার। সংশোধিত আইনে মামলা নিষ্পত্তিতে বেঁধে দেওয়া হয়েছে ১২০ দিন। এই সময়ের মধ্যে নিষ্পত্তি করা না গেলে কারণ উল্লেখ করে বিচারক আরও ৬০ দিন সময় বৃদ্ধি করতে পারবেন বলেও সংশোধিত আইনে উল্লেখ রয়েছে। দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালের বিচার প্রক্রিয়া সম্পর্কে জানতে চাইলে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার এ কে এম এহসানুর রহমান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, মূলত দ্রুত বিচার আইনের মামলাগুলোই দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে বিচার হয়। তবে সরকার চাইলে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ মামলা দ্রুত নিষ্পত্তির জন্যও এ ট্রাইব্যুনালে আনতে পারে। এ বিষয়ে দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল আইনের ৬ নম্বর ধারায় বলা হয়েছে, ‘সরকার, সরকারি গেজেটে প্রজ্ঞাপন দ্বারা, জনস্বার্থে, হত্যা, ধর্ষণ, আগ্নেয়াস্ত্র, বিস্ফোরক দ্রব্য এবং মাদকদ্রব্য সংক্রান্ত অপরাধের বিচারাধীন কোনো মামলা উহার যে কোন পর্যায়ে ক্ষেত্রমত, দায়রা আদালত বা বিশেষ আদালত বা ম্যাজিস্ট্রেট আদালত হইতে বিচারের জন্য দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে স্থানান্তর করিতে পারিবে।’ তিনি বলেন, আইনশৃঙ্খলা বিঘ্নকারী অপরাধ (দ্রুত বিচার) আইনটিই মূলত ‘দ্রুত বিচার আইন’ হিসেবেই পরিচিত। দ্রুত বিচার আইন ও দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল আইন নামে দুটি পৃথক আইন থাকায় মাঝে মাঝে বিভ্রান্তি দেখা দেয়। তিনি বলেন, দ্রুত বিচার আইন হিসেবে পরিচিত আইনটি হচ্ছে মাদার ল’। এ আইনের অধীনেই দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল আইন প্রণয়ন করা হয়েছে। ট্রাইব্যুনাল আইনে মূলত বিচার পরিচালনার পদ্ধতিগুলো রয়েছে।

কীভাবে সমাধান : দ্রুত বিচারের মামলায় দীর্ঘসূত্রতার বিষয়ে জানতে চাইলে সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, বিচার বিলম্ব আমাদের বিচার বিভাগের অন্যতম একটি সমস্যা। মামলা নিষ্পত্তিতে দীর্ঘসূত্রতার কারণে যেমনভাবে বিচার প্রার্থীরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, তেমনি সরকারও কিন্তু ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তাই যেসব কারণে মামলার দীর্ঘসূত্রতা হচ্ছে তা নির্ণয় করে সমাধান করা উচিত। তাহলে বিচার প্রার্থীরা সুবিচার পাবে। তিনি আরও বলেন, বিচারে দীর্ঘসূত্রতার জন্য মূলত সাক্ষী না আসা এবং বিচার কাজ মুলতবি হওয়া প্রধানত দায়ী। রাষ্ট্রপক্ষের কাজ হবে যে কোনোভাবে সাক্ষী হাজির করা এবং মুলতবি ঠেকানো। তাহলেই মামলা দ্রুত নিষ্পত্তি করা সম্ভব হবে।

এ বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার এ বি এম আলতাফ হোসেন মনে করেন, এসব মামলা দ্রুত নিষ্পত্তিতে সরকারের মনিটরিং খুব জরুরি। তিনি বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, আমাদের বিচারক স্বল্পতা রয়েছে এটা অস্বীকার করা যাবে না। একই সঙ্গে বিচার চলাকালে বার বার সমন দিয়েও সাক্ষীদের হাজির করা যায় না। সে ক্ষেত্রে বিচারক চাইলেও মামলাটি দ্রুত নিষ্পত্তি করতে পারেন না। এ জন্য এসব সমস্যা সমাধানে দ্রুত বিচারের মামলাগুলোর ওপর সরকারের মনিটরিং আরও বাড়াতে হবে। সব মিলিয়ে আইনের সুফল পেতে হলে সবাইকে আন্তরিকতার সঙ্গে কাজ করতে হবে বলেও মত তার।

সর্বশেষ খবর