শনিবার, ৭ সেপ্টেম্বর, ২০১৯ ০০:০০ টা

লুটপাটে বিপর্যস্ত বিআরটিসি

মন্ত্রীর ক্ষোভ, কর্মীদের বেতন বন্ধ ১৪ মাস, চেয়ারম্যান বদল

শিমুল মাহমুদ ও শামীম আহমেদ

লুটপাটে বিপর্যস্ত বিআরটিসি

সরকারি সড়ক পরিবহন সংস্থা বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন করপোরেশন (বিআরটিসি) নজিরবিহীন অনিয়ম, লুটপাট আর দুর্নীতির আখড়ায় পরিণত হয়েছে। আওয়ামী লীগ সরকারের গত এক দশকে নতুন বাস-ট্রাক কেনায় বিআরটিসিকে দেওয়া হয়েছে ১ হাজার ৬১২ কোটি টাকা। যাত্রীবাহী বাসের বহর দাঁড়িয়েছে প্রায় ১৪০০টিতে। তারপরও দুর্নীতি-লুটপাটে বিপর্যস্ত বিআরটিসি তার কর্মীদের বেতন দিতে পারছে না। সংস্থাটির কোনো কোনো ডিপোতে ১৪ মাস পর্যন্ত বেতন বন্ধ রয়েছে। রাজধানীর জোয়ারসাহারা ডিপোতে বকেয়া বেতনের দাবিতে দুই দফা তালা দিয়েছে কর্মীরা। এমনকি চেয়ারম্যানের অফিসেও তালা দিয়ে অবরুদ্ধ করে রাখে কর্মীরা। বিআরটিসির অনিয়ম-দুর্নীতি নিয়ে সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়ে অভিযুক্ত চেয়ারম্যানকে সরিয়ে দিয়েছেন। সীমাহীন দুর্নীতি, কমিশন বাণিজ্য ও স্বেচ্ছাচারিতার দায় নিয়ে সংস্থাটির চেয়ারম্যান ফরিদ আহমেদ ভূঁইয়া এ সপ্তাহে বিদায় নিয়েছেন। মঙ্গলবার নতুন চেয়ারম্যান এহছানে এলাহী দায়িত্বে যোগ দিয়েই চলমান অচলাবস্থার অবসান ঘটানোর আশ্বাস দিয়ে বলেছেন, এখন থেকে নিয়মিত বেতন-ভাতা হবে। আমি চেয়ারম্যান হিসেবে যতদিন আছি ততদিন আমার সন্তানরা না খেয়ে থাকবে না। জানা গেছে, অব্যবস্থাপনা ও ধারাবাহিক অনিয়ম-দুর্নীতির কারণে বিপুলসংখ্যক যাত্রীবাহী বাসের বহর নিয়েও লোকসানের ঘানি টানছে বিআরটিসি। এরই মধ্যে ভারতীয় ঋণের টাকায় ভারত থেকে কেনা হচ্ছে একের পর এক নিম্নমানের বাস। বছর না যেতেই সেগুলো অচল হয়ে পড়ে থাকছে ডিপোতে। বাড়ছে মেরামত খরচ, গুনতে হচ্ছে লোকসান। বিআরটিসির বহরে বর্তমানে বাস রয়েছে ১ হাজার ৩৮৯টি। এর মধ্যে কমবেশি ৫২৫টিই অচল হয়ে বিভিন্ন ডিপোতে পড়ে আছে। এ হিসাবে বিআরটিসির বহরে থাকা বাসগুলোর ৩৮ শতাংশ অচল অবস্থায় রয়েছে। এসব অচল বাসের অধিকাংশই গত ১০ বছরে কেনা। সূত্র জানায়, গত এক দশকে নতুন বাস-ট্রাক কেনায় বিআরটিসির মাধ্যমে সরকার ১ হাজার ৬১২ কোটি টাকা খরচ করলেও লোকসান কাটিয়ে উঠতে পারেনি বিআরটিসি। বাড়েনি যাত্রীসেবার মানও। অতিরিক্ত ভাড়া আদায়েরও অভিযোগ রয়েছে ইজারাদারদের বিরুদ্ধে। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে বিআরটিসি লোকসান গুনেছে ২ কোটি ৯২ লাখ টাকা। অথচ প্রায় ১৪০০ বাসের বহর নিয়ে সংস্থাটির লোকসান হওয়ার কোনো কারণ ছিল না। সূত্র জানিয়েছে, বাস কেনা ও পরিচালনায় সীমাহীন অনিয়মের কারণেই বিআরটিসি ডুবতে বসেছে। ২০১০ সালে ১১৩ কোটি টাকায় চীন থেকে ২৭৫টি বাস কেনে বিআরটিসি। অভিযোগ রয়েছে, টাকার অঙ্ক বেশি দেখানো হলেও কম টাকায় কেনা নিম্নমানের বাসগুলোর বেশির ভাগই নষ্ট হয়ে বিভিন্ন ডিপোতে পড়ে আছে। চীনের পর ২০১১-১২ অর্থবছরে দক্ষিণ কোরিয়া থেকে ২৮১ কোটি টাকায় কেনা হয় আরও ২৫৫টি বাস। এগুলোও বেশির ভাগ নষ্ট হয়ে পড়ে আছে বিভিন্ন ডিপোতে। বিআরটিসির প্রতিটি ক্রয় চুক্তি, বাস সংগ্রহ ও রক্ষণাবেক্ষণে অনিয়মের অভিযোগ রয়েছে। গত ১০ বছরে আর্টিকুলেটেড বাস, ডাবল ডেকার, এসি বাস ও ট্রাক মিলিয়ে ২ হাজার ৫৮টি বাস-ট্রাক কিনতে ১ হাজার ৬১২ কোটি টাকা ব্যয় করেছে সংস্থাটি। সংস্থাটির হিসাব শাখার তথ্যমতে, ২০১৭-১৮ অর্থবছর স্টাফদের বেতন-ভাতাসহ পরিচালন ব্যয় হয়েছে ২৫৬ কোটি ১০ লাখ টাকা। এ সময়ে সংস্থাটি আয় করেছে ২৫৩ কোটি ১৭ লাখ টাকা। সর্বশেষ গত দুই বছর বিআরটিসি পরিচালনার দায়িত্বে ছিলেন চেয়ারম্যান ফরিদ আহমেদ ভূঁইয়া। তিনি ২০১৭ সালের আগস্টে যোগ দিয়ে নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ মাথায় নিয়ে ৩ সেপ্টেম্বর দায়িত্ব ছাড়েন। অবশ্য তাকে বদলি করা হয়েছিল আরও দেড় মাস আগে ২১ জুলাই। এই দুই বছরে বিআরটিসির পরিচালন বিশৃঙ্খলা দৃশ্যমান হয়ে ওঠে। তার বিরুদ্ধে সংস্থাটির ডিপো ম্যানেজারদের মাধ্যমে ২০ মাসে ১২ কোটি ৪৪ লাখ টাকা অবৈধ আয়ের অভিযোগ তুলে সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরকে চিঠি দিয়েছে সংস্থাটির কর্মীরা। তারা বলেছেন, সারা দেশের ২১টি ডিপো থেকে মাসোহারা আদায় করেছেন চেয়ারম্যান। অন্যদিকে ডিপোর শ্রমিক-কর্মচারীরা তাদের বকেয়া বেতনের দাবিতে গত এক বছরে দুবার জোয়ারসাহারা ডিপোতে তালা দেন। সম্প্রতি বিক্ষোভ হয় নারায়ণগঞ্জ ডিপোতে। ২১ জুলাই চেয়ারম্যানের বদলির আদেশ আসে। তার পরদিন ২২ জুলাই বকেয়া বেতন পরিশোধের দাবিতে দিলকুশায় বিআরটিসির প্রধান কার্যালয়ে চেয়ারম্যান ফরিদ আহমদ ভূঁইয়াকে অবরুদ্ধ করে বিক্ষোভ করেন চালক-শ্রমিকরা। একপর্যায়ে তারা চেয়ারম্যানের কক্ষে তালা ঝুলিয়ে চেয়ারম্যানের গাড়ির হাওয়া ছেড়ে দেন। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, চালক-শ্রমিকদের বেতন বকেয়া পড়েছে সর্বোচ্চ চট্টগ্রাম ডিপোতে ১৪ মাস, রংপুরে ১৩ মাস এবং জোয়ারসাহারাতে ১০ মাস। অন্যান্য ডিপোতেও কমবেশি বেতন বাকি পড়েছে। জোয়ারসাহারা ডিপোর একজন চালক বলেন, আমরা যে টাকা আয় করি তাতে বেতন বকেয়া পড়ার কথা নয়। কর্মকর্তারা টাকা খেয়ে ফেলেন। চুরি ধরা পড়ার পরও কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেননি চেয়ারম্যান। তিনিও ডিপো ম্যানেজারসহ চোরদের সঙ্গী হয়েছেন।

অভিযোগ রয়েছে, বদলির আদেশ পাওয়ার পরও চেয়ারম্যান দুর্নীতি, অনিয়ম ও অর্থ আত্মসাতের দায়ে অভিযুক্ত কয়েকজন কর্মকর্তার সাজা লঘু করেছেন ও অব্যাহতি দিয়েছেন। সরকারি সিদ্ধান্ত লঙ্ঘন করে বিআরটিসির জমি ইজারার উদ্যোগ নিয়েছেন। চট্টগ্রামের একজন সিএনজি ফিলিং স্টেশনের মালিককে ‘দেখা’ না করলে ইজারা বাতিলের হুমকি দিয়েছেন। এসব বিষয় নিয়ে নালিশ গেছে সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রীর কাছে। এসব ব্যাপারে বিআরটিসির সদ্য সাবেক চেয়ারম্যান ফরিদ আহমেদ ভূঁইয়ার সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তিনি ফোন ধরেননি।

এ ব্যাপারে পরিবহন বিশেষজ্ঞ ও বিআরটিসির সাবেক পরিচালক ড. এস এম সালেহ উদ্দিন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, বিআরটিসির লোকসানী প্রতিষ্ঠান হওয়ার কোনো সুযোগই নেই। যাত্রীর তো অভাব নেই। বরং রাষ্ট্রীয় সম্পত্তি হওয়ায় এই গাড়ির প্রতি মানুষের দরদ বেশি। আয়ের পাশাপাশি দৃষ্টান্তমূলক সেবা দিয়ে বেসরকারি পরিবহনগুলোর সেবা বাড়ানোর উদ্দেশ্যে সংস্থাটি প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল। আমি যখন পরিচালক ছিলাম তখনও বিআরটিসির কোনো কর্মীর বেতন-ভাতা বকেয়া ছিল না। নিয়মিত সব গাড়ি মেরামত করে রাস্তায় চালিয়েছি। যতদূর মনে পড়ে সরকারকেও আয়ের কিছু টাকা দিতে পেরেছিলাম। তিনি বলেন, প্রতিষ্ঠানটিকে লাভজনক করা খুবই সহজ। বিআরটিসির মতো ওয়ার্কশপ ও ডিপো কোনো বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের নেই। এগুলোকে আধুনিক সরঞ্জাম দিয়ে পুরোদমে চালু করে সব গাড়ি নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ করতে হবে। আমি থাকাকালীন ২৪ ঘণ্টা ওয়ার্কশপগুলো চলত। ২/৩ মাস সময় নিয়ে একসঙ্গে ২০০ গাড়ি মেরামত করেছি। এখন গাড়ি বেড়েছে। নতুন কারিগর নিয়োগ দিতে হবে। পর্যাপ্ত স্পেয়ার পার্টস রাখতে হবে। গাড়ি কোম্পানির বেঁধে দেওয়া সময়ানুযায়ী পার্টস বদলাতে হবে। এ ছাড়া নিজস্ব জনবল নিয়োগ দিয়ে গাড়িগুলো চালাতে হবে। গাড়ি লিজ দিয়ে বিআরটিসিকে লাভজনক করা যাবে না। লিজ নিয়ে কেউ গাড়ির সঠিক রক্ষণাবেক্ষণ করে না। এ কারণেই গাড়িগুলো দ্রুত বিকল হয়। একই সঙ্গে গাড়ি থেকে যে আয় হয় তা সব আদায়ের ব্যবস্থা করতে হবে। কোনো রুটে বেসরকারি গাড়িগুলো দৈনিক কত আয় করছে সেটা দেখলেই বোঝা যায় ওই রুটের আয় কেমন। অন্য গাড়ি লাভ করতে পারলে বিআরটিসি কেন পারবে না?

সর্বশেষ খবর