বুধবার, ১৩ নভেম্বর, ২০১৯ ০০:০০ টা

তবু থামছে না রেল দুর্ঘটনা

বারবার দুর্ঘটনা বারবার তদন্ত কমিটি

সাঈদুর রহমান রিমন

রেল-সংশ্লিষ্টদের অবহেলা আর যাত্রীদের অসচেতনতায় ট্রেন দুর্ঘটনা বেড়েই চলেছে। দুর্ঘটনা ঘটলেই তদন্ত কমিটি হয়, তদন্ত প্রতিবেদনও দাখিল হয়। কিন্তু তদন্ত প্রতিবেদনের দেওয়া সুপারিশের কোনো কিছুই বাস্তবায়ন হয় না, সমাধান হয় না ত্রুটি-বিচ্যুতির। ফলে অভিন্ন সমস্যায় ট্রেন দুর্ঘটনা বেড়েই চলে জ্যামিতিক হারে। রেলওয়ের প্রতিটি দুর্ঘটনার পর তদন্ত কমিটি গঠিত হলেও দায়ীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার নজির নেই। বরং অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দুর্ঘটনার জন্য দায়ীদের সাময়িক বরখাস্ত কিংবা তিরস্কারের মধ্যেই শাস্তি নিষ্পত্তি করা হয়েছে। এতে রেল-সংশ্লিষ্টদের অবহেলায় ঘটছে দুর্ঘটনার পুনরাবৃত্তি। ট্রেন চালকসহ রেল বিভাগের একাধিক কর্মকর্তা ক্ষোভ প্রকাশ  করে জানান, দুর্ঘটনা-পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন তদন্ত কমিটি গঠন হলেও তাদের প্রতিবেদনে শুধু ট্রেনচালক, স্টেশন মাস্টার ও পরিবহন কাজ-সংশ্লিষ্টদের ওপর দোষ চাপিয়ে দেওয়া হয়। লুপ, শাখা ও মেইন লাইনের ত্রুটির কারণে দুর্ঘটনা ঘটলেও দায় চাপানো হয় পরিবহন বিভাগের ওপর। লাইনের ত্রুটির জন্য ব্যবস্থা নেওয়ার কথা সংশ্লিষ্ট প্রকৌশল দফতরের বিরুদ্ধে। এভাবেই পরিবহন ও প্রকৌশল বিভাগের একে অন্যের ওপর দোষ চাপানোর প্রতিযোগিতায় আড়াল হয়ে পড়ে প্রকৃত ঘটনা। সূত্র জানায়, গত ২০ বছরে রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলে ৫৭০টিরও বেশি দুর্ঘটনা ঘটেছে। যার অধিকাংশই ঘটেছে অবৈধ লেভেল ক্রসিংয়ে। এ ছাড়া সিগন্যাল ও লাইনের ত্রুটি, চালকের ভুল ও যাত্রী অসাবধানতায়ও বিপুলসংখ্যক দুর্ঘটনা ঘটে। এসব দুর্ঘটনা ও ক্ষয়ক্ষতির পরও সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থার নিয়ন্ত্রণে থাকায় অবৈধ লেভের ক্রসিংয়ের ব্যাপারে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে পারেনি রেল বিভাগ। টঙ্গী থেকে গে ারিয়া পর্যন্ত প্রায় ২৬ কিলোমিটার রেললাইন যেন মৃত্যুফাঁদ। মগবাজার, বনানী, কুড়িল রেলক্রসিং পারাপারে অসতর্ক পথচারী মারা যাওয়ার সর্বাধিক ঘটনা ঘটে বলেও রেলওয়ে সূত্র জানায়।

রেলওয়ে পুলিশ জানায়, অপরিকল্পিতভাবে যত্রতত্র অনুমোদন ছাড়াই রেললাইনের ওপর দিয়ে সংযোগ সড়ক নির্মাণ করা হচ্ছে। এ কারণে সচেতনতা বাড়ানোর উদ্যোগ সত্ত্বেও নাগরিকদের রেললাইনের ওপর দিয়ে বেপরোয়া চলাচল বন্ধ করা যাচ্ছে না। গত তিন বছরে প্রায় এক হাজার রেল দুর্ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে দুই ট্রেনের মুখোমুখি সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে ১৭টি। বাকি অধিকাংশই লেভেল ক্রসিংয়ের দুর্ঘটনা। বাংলাদেশ রেলওয়ে পুলিশের (জিআরপি) তথ্যে জানা যায়, ২০১৫ সালে রেল দুর্ঘটনায় মারা গেছেন ২৯২ জন। অপমৃত্যু (ইউডি) মামলাসহ মোট মামলা হয়েছে ২৮৫টি। ২০১৬ সালে রেল দুর্ঘটনায় মারা যান ৩০৫ জন। গত এপ্রিলের আগের ১৫ মাসে মারা গেছে ২৭৮ জন। শুধু গে ারিয়া থেকে টঙ্গী পর্যন্ত ঢাকা সিটিতে দুর্ঘটনায় মারা গেছেন ৯৩ জন। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অরক্ষিত লেভেল ক্রসিং, অপরিকল্পিত সংযোগ সড়ক এবং সচেতনতার অভাবের পাশাপাশি রেলে দুর্ঘটনার পেছনে সংশ্লিষ্ট দফতরগুলোর অব্যবস্থাপনাও দায়ী। গত বছরের ১১ আগস্ট শায়েস্তাগঞ্জ-রশিদপুর সেকশনে বি-স্পেশাল-২ নামের ট্রেনটি লাইনচ্যুত হয়। মূলত লাইন সম্প্রসারণের ফলে ট্রেনটি দুর্ঘটনায় পড়ে বলে রেলের প্রাথমিক তদন্তে উঠে আসে। ২০ আগস্ট দুর্ঘটনায় পড়ে আখাউড়া সেকশনের ৯৫১ নম্বর ট্রেন। দীর্ঘদিন ধরে ট্র্যাক মেরামত না করায় এ দুর্ঘটনা ঘটেছে বলে প্রমাণ পায় রেলের পরিবহন বিভাগ। এ ছাড়া ১১ আগস্ট নাথেরপেটুয়া-সোনাইমুড়ি সেকশনে ব্যক্তি মালিকানাধীন একটি মাইক্রোবাসের সঙ্গে সংঘর্ষ ঘটে ৮৮ নম্বর ডেমু ট্রেনের। মূলত অবৈধ লেভেল ক্রসিংয়ের কারণেই এ দুর্ঘটনা ঘটে। এ ছাড়া টঙ্গী স্টেশনের কাছে ট্রেন লাইনচ্যুতির ঘটনায় আতঙ্কিত লোকজনের লাফালাফিতে অন্তত চারজন নিহত ও ২০ জনেরও বেশি আহত হওয়ার ঘটনা ঘটে। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, ‘ট্রেনটির পেছনের চারটি বগি লাইনচ্যুত হলেও গতির কারণে ওই অবস্থায় ট্রেনটি কয়েক শ গজ এগিয়ে যায়। এক পর্যায়ে দুটি বগি কাত হয়ে দুর্ঘটনায় পড়ে। সর্বশেষ গতকাল ভোরে চালকের ভুলে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবার মন্দবাগে দুই ট্রেনের মুখোমুখি সংঘর্ষে অন্তত ১৬ জন নিহত ও অর্ধশতাধিক যাত্রী আহত হয়েছেন। দুর্ঘটনার ব্যাপারে বাংলাদেশ রেলওয়ের মহাপরিচালক (অপারেশন) হাবিবুর রহমান বলেন, রেল এখনো নিরাপদ বাহন হিসেবে জনপ্রিয়। বেশকিছু উন্নয়ন কর্মকা  শেষ হলেও ইঞ্জিন-কোচ সংকটের পাশাপাশি লুপ ও শাখা লাইনগুলোর নাজুক অবস্থার কারণে প্রকৃত সেবা দিতে পারছে না রেলওয়ে। বর্তমানে দীর্ঘদিনের পুরনো রেললাইনগুলো পুনর্বাসনের কাজ শুরু হয়েছে। এসব প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে রেলওয়ের সেবার মান আরও বাড়বে, কমে যাবে দুর্ঘটনাও।

সর্বশেষ খবর