শুক্রবার, ১৫ নভেম্বর, ২০১৯ ০০:০০ টা

খণ্ড বিখণ্ড হচ্ছে জোট-ফ্রন্ট শরিকরা

মাহমুদ আজহার

খণ্ড বিখণ্ড হচ্ছে জোট-ফ্রন্ট শরিকরা

খন্ড বিখন্ড হচ্ছে বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০-দলীয় জোট ও জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট। বিএনপি-জামায়াত বাদে জোট-ফ্রন্টের শরিক দলগুলো ক্রমেই ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর হয়ে ভগ্নাংশে রূপ নিচ্ছে। দলের সিনিয়র দুই নেতার পদত্যাগে এমনিতেই অস্বস্তিতে বিএনপির নীতি নির্ধারকরা। এর মধ্যে জোট-ফ্রন্টের শরিক দলগুলোর বেহাল অবস্থায়ও উদ্বিগ্ন দলটি। সর্বশেষ ঐক্যফ্রন্টের শরিক দল জেএসডি সাধারণ সম্পাদক আবদুল মালেক রতন দল থেকে বেরিয়ে পৃথক কনভেনশন ডেকেছেন ১১ জানুয়ারি। তিনি বাংলাদেশ প্রতিদিনকে জানান, আঙ্গুল কেটে শপথ করে ঐক্যফ্রন্টের গণস্বাক্ষরের পক্ষে থাকবেন না তারা। তবে মুক্তিযুদ্ধ ও প্রগতিশীলতা ও জাতীয় স্বার্থের পক্ষেই তাদের অবস্থান থাকবে। সম্প্রতি ২০ দল ছেড়েছে আন্দালিব রহমান পার্থের দল বিজেপি। জাতীয় মুক্তিমঞ্চ ইস্যুতে মতবিরোধকে কেন্দ্র করে এলডিপি থেকে বিএনপির রাজনীতিতে ফিরছেন জাতীয় সংসদের সাবেক হুইপ ও সাবেক এমপি আবদুল করিম আব্বাসী, সাবেক এমপি আবদুল্লাহ ও সাবেক এমপি আবদুল গণি ছাড়াও দলটির সাবেক সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব শাহাদাত হোসেন সেলিম। অবশ্য এক সময় তারা সবাই বিএনপিতেই ছিলেন। এদিকে ঐক্যফ্রন্ট ছেড়েছে বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকীর নেতৃত্বাধীন কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ। ঐক্যফ্রন্টের অন্যতম শরিক গণফোরামের সাধারণ সম্পাদক মোস্তফা মহসীন মন্টুসহ কয়েকজন নেতা চলে যাওয়ার পর এ দলটিও এখন প্রাণহীন। ঐক্যফ্রন্টেও নিষ্ক্রিয় গণফোরাম। এ প্রসঙ্গে বিএনপি মহাসচিব ও ঐক্যফ্রন্টের অন্যতম শীর্ষনেতা মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, জোট ও ফ্রন্ট নিষ্ক্রিয় এটা বলা যাবে না। নানা প্রতিকূলতার মধ্যে চলছে সরকারবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো। আমরা ২০-দলীয় জোট ও জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গঠন করেছি জাতীয় বৃহত্তর স্বার্থে। দেশের গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা ও আইনের শাসন এবং জনগণের জবাবদিহিতামূলক সরকারই মূল লক্ষ্য। এক্ষেত্রে সরকারবিরোধী এ দলগুলো ক্ষমতাসীনদের রোষানলে পড়াটাই স্বাভাবিক। বিএনপি নানা সমস্যা মোকাবিলা করতে সক্ষম হলেও অন্যদলগুলো হয়তো তা পারছে না। জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের আরেক নেতা ও নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, সরকারবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোতে ভাঙাগড়া হয় সরকারের চাপে বা লোভে পড়ে। আবার শীর্ষ নেতাদের পক্ষ থেকে অবমূল্যায়নসহ নানা কারণেও দলগুলো ভাঙে। যেসব দল ভাঙছে তার কোনো একটা হতে পারে বলে আমি মনে করি।

রবের জেএসডিতে ভাঙন : এবার ভাঙনের কবলে পড়েছে আ স ম আবদুর রবের নেতৃত্বাধীন জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জেএসডি)। দলের কাউন্সিল প্রত্যাখ্যান করে ১১ জানুয়ারি কনভেনশন ডেকেছেন জেএসডির সাধারণ সম্পাদক আবদুল মালেক রতন। এর আগে ২০০১ সালে জাসদ থেকে বেরিয়ে এসে জেএসডি গঠন করেন আ স ম আবদুর রব। এ প্রসঙ্গে আবদুল মালেক রতন বাংলাদেশ প্রতিদিনের কাছে দাবি করেন তার সঙ্গে দলের সিনিয়র সহসভাপতি এম এ গোফরান, সিনিয়র যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আতাউল করীম ফারুক, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আবদুল খালেক, সাংগঠনিক সম্পাদক দেলোয়ার হোসেন দিয়া খোন্দকার, শিল্প ও বাণিজ্য সম্পাদক জাহাঙ্গীর আলম, শ্রমিক ফ্রন্টের সাধারণ সম্পাদক মোশাররফ হোসেনসহ কেন্দ্রীয় ও সারা দেশের জেলা-উপজেলা পর্যায়ের নেতা-কর্মীদের বড় অংশই রয়েছেন। তিনি বলেন, দলের গঠনতন্ত্র না থাকায় কাউন্সিলের কোনো বৈধতা থাকে না। আমরা বলেছিলাম, আগে গঠনতন্ত্র তৈরি হোক, এরপর কাউন্সিল করা যাবে। কিন্তু আ স ম রব ভাই তা মানলেন না। ফলে আমরা নতুন করে আগে কনভেনশন করব। সেখানে গঠনতন্ত্র, মেনিফেস্টো নিয়ে আলোচনার মাধ্যমে সবকিছু চূড়ান্ত করে কাউন্সিল করব। আগের গঠনতন্ত্রকে অনুমোদন দিয়েও কাউন্সিল করা যেত। কোনোটিই করতে রাজি নন রব ভাই। ফলে ২৮ ডিসেম্বরের কাউন্সিল অবৈধ।

বিএনপিতে এলডিপির চার নেতা : জাতীয় মুক্তিমঞ্চ ইস্যুতে মতবিরোধকে কেন্দ্র করে লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি-এলডিপি ছেড়ে বিএনপিতে ফিরছেন চার প্রভাবশালী নেতা। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানসহ দলটির নীতিনির্ধারকরা এ বিষয়ে সবুজ সংকেত দিয়েছেন। যে কোনো সময় আনুষ্ঠানিকভাবে তাদের বিএনপিতে ফিরিয়ে নেওয়া হবে। সূত্র জানায়, এলডিপির শীর্ষ নেতার ওপর ক্ষুব্ধ হয়ে গত ২৬ জুন পদত্যাগ করা জাতীয় সংসদের সাবেক হুইপ ও সাবেক এমপি আবদুল করিম আব্বাসী, সাবেক এমপি আবদুল্লাহ ও সাবেক এমপি আবদুল গণি ছাড়াও দলটির সাবেক সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব শাহাদাত হোসেন সেলিম বিএনপিতে ফিরছেন। তাদের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে বিএনপির হাইকমান্ড তাদের বিষয়টি গুরুত্ব দিচ্ছেন। এর মধ্যে শাহাদাত হোসেন সেলিমের অতীত কর্মকান্ডে  বিএনপির হাইকমান্ড খুশি। ছাত্রদল চট্টগ্রাম মহানগর শাখার প্রতিষ্ঠাতা আহ্বায়ক শাহাদাত হোসেন সেলিম ১২ বছর বন্দর থানা বিএনপির সাধারণ সম্পাদকও ছিলেন। জানা যায়, রাজনৈতিকভাবে মূল্যায়ন না করায় অলি আহমদের জাতীয় মুক্তিমঞ্চ গঠনের আগের দিন দলের তিনজন সাবেক এমপি পদত্যাগ করেন। এর মধ্যে তিনবারের এমপি আবদুল করিম আব্বাসী নেত্রকোনা জেলা বিএনপির সভাপতি হিসেবে ২৫ বছর দায়িত্ব পালন করেছেন। আবদুল গণিও বিএনপির মনোনয়নে তিনবারের এমপি ছিলেন। এ প্রসঙ্গে আবদুল গণি বলেন, জাতীয়তাবাদী শক্তি ঐক্যবদ্ধ হোক তা আমাদের সবার চাওয়া। সেই চাওয়ায় যা কিছু দরকার আমরা করব। শাহাদাত হোসেন সেলিম বলেন, বিএনপি আমার আপন ঠিকানা। খালেদা জিয়া আমার রাজনৈতিক অভিভাবক। তাকে অন্যায়ভাবে কারাবন্দী করে রাখা হয়েছে। এখন ভেদাভেদ ভুলে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনতে আর খালেদা জিয়াকে মুক্ত করতে নিজের সর্বোচ্চটুকু ত্যাগ করতেও আমি প্রস্তুত রয়েছি।

২০ দলে ভাঙাগড়া : জানা যায়, ১৯৯৯ সালের ৬ জানুয়ারি জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান মরহুম হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ, জামায়াতের সাবেক আমির গোলাম আযম এবং ইসলামী ঐক্যজোটের চেয়ারম্যান শায়খুল হাদিস আল্লামা আজিজুল হককে সঙ্গে নিয়ে চারদলীয় জোট গঠন করেন কারাবন্দী বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। সেই জোট থেকে প্রথমেই বেরিয়ে যান এরশাদ। ২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে মহাজোটের অংশীদার হয় জাতীয় পার্টি। ২০০৯ সাল থেকেই তিনি এবং তাঁর দল ক্ষমতার ভাগীদার। এরপর ২০১২ সালের ১৮ এপ্রিল বিএনপির নেতৃত্বে গড়ে ওঠে ১৮-দলীয় জোট। পর্যায়ক্রমে জাতীয় পার্টি (কাজী জাফর) ও সাম্যবাদী দল যোগ দিলে তা পরিণত হয় ২০-দলীয় জোটে।

বিএনপির এই জোটে প্রথম ভাঙন লাগে ২০১৫ সালে। ওই বছরের সেপ্টেম্বরে জোট থেকে বেরিয়ে যায় শেখ শওকত হোসেন নিলুর নেতৃত্বাধীন ন্যাশনাল পিপলস পার্টি (এনপিপি)। প্রয়াত নীলুর অভিযোগ ছিল- ২০-দলীয় জোটে বিএনপি-জামায়াত সব সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দিত। এর পরের বছরই ফের ভাঙনের মুখে পড়ে বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোট। ২০১৬ সালের জানুয়ারিতে দীর্ঘদিনের জোটের সম্পর্ক ত্যাগ করে ইসলামী ঐক্যজোট। সরাসরি কাউকে দায়ী না করলেও নিজ সংগঠনকে শক্তিশালী করতে ওই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়ে বলে জানিয়েছিলেন ইসলামী ঐক্যজোটের তৎকালীন চেয়ারম্যান আবদুল লতিফ নেজামী। এরপর ভাঙন লাগে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ) ও ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক পার্টিতে (এনডিপি)। এ ছাড়াও খন্ড বিখন্ড হয় লেবার পার্টি ও জাগপা। সেক্ষেত্রে সবগুলো দলের একটি অংশ থেকে যায় ২০ দলে।

সর্বশেষ খবর