মঙ্গলবার, ১০ ডিসেম্বর, ২০১৯ ০০:০০ টা
অনুসন্ধানী সাক্ষাৎকার

মহাজোটের মঞ্চে এরশাদ যেভাবে গিয়েছিলেন

নিজস্ব প্রতিবেদক

মহাজোটের মঞ্চে এরশাদ যেভাবে গিয়েছিলেন

বিএনপি সরকারের সময় সব গোয়েন্দা সংস্থা আর দলের নেতা তারেক রহমানের নজর ফাঁকি দিয়ে জাতীয় পার্টি চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদকে দুই দিনের অন্তর্ধান রহস্য উন্মোচন করে যখন পল্টনে শেখ হাসিনার মহাজোটের মঞ্চে এনে তোলা হলো, তখন চারদিকে উল্লাস, স্লোগান আর আনন্দের বন্যা। বিএনপি-জামায়াত জোটবিরোধী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন মহাজোটের সবাই এলেও এরশাদ আসার পরই তা পূর্ণতা পেল। বিএনপির তৎকালীন যুগ্ম মহাসচিব ক্ষমতাধর তারেক রহমান এরশাদকে তাদের নির্বাচনী জোটে নিতে প্রবল চাপ সৃষ্টি করেছিলেন। শেষ পর্যন্ত এরশাদ দুই দিন উধাও হলে গণমাধ্যম তাকে খুঁজে পায়নি।

সেই ঘটনার এতগুলো বছর কেটে গেছে। এরশাদ চিরনিদ্রায় শায়িত। সেই শ্বাসরুদ্ধকর ও নাটকীয় ঘটনার বর্ণনা দিলেন লক্ষ্মীপুর জেলা আওয়ামী লীগের  সিনিয়র সহ-সভাপতি সফিকুল ইসলাম। তিনি বলেন, সেদিন এইচ এম এরশাদকে পল্টন ময়দানে শেখ হাসিনার মহাসমাবেশে উপস্থিত করা ছিল রাজনীতিতে টার্নিং পয়েন্ট। তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেতা শেখ হাসিনার এপিএস আলাউদ্দিন আহমেদ চৌধুরী নাসিমের নেতৃত্বে নানা শঙ্কা, বাধা-বিপত্তি পেরিয়ে আমরা শেষ পর্যন্ত এরশাদকে নিয়ে পল্টনের মহাসমাবেশে পৌঁছে যাই। বাস্তবে সেদিনই মহাজোটের আনুষ্ঠানিক আত্মপ্রকাশ ঘটে।  গতকাল বিকালে বাংলাদেশ প্রতিদিনের সঙ্গে আলাপচারিতায় সেদিনের ঘটনার খোলামেলা বর্ণনা দেন আওয়ামী লীগের সাবেক এই এমপি প্রার্থী। সফিকুল ইসলাম বলেন, ২০০৬ সালের শেষ দিকে বাংলাদেশের রাজনীতিতে তখন টালমাটাল অবস্থা। তখন আওয়ামী লীগের সঙ্গে মহাজোট করতে বিএনপি জোটের বাইরে সব রাজনৈতিক দল একে একে পল্টন ময়দানের মহাসমাবেশে যোগ দিচ্ছিল। বেলা ২টায় পল্টন ময়দানের মহাসমাবেশ কানায় কানায় পূর্ণ। এর চারপাশেও হাজার হাজার জনতার স্রোত ছিল। ওই মহাসমাবেশের মঞ্চে ১৪ দলের নেতারা ছাড়াও তখন ড. কামাল হোসেন, অধ্যাপক ডা. বদরুদ্দোজা চৌধুরীসহ বাম দলের নেতারা উপস্থিত। সবাই অপেক্ষা করছিলেন তখন। কিছুক্ষণ পরই মঞ্চে আসেন আমাদের প্রিয় নেত্রী শেখ হাসিনা। এ সময় তাকে মুহুর্মুহু করতালির মাধ্যমে লাখো জনতা অভিবাদন জানান। তখন সবাই যেন একটা চমকের অপেক্ষায় ছিলেন। জাতীয় পার্টি চেয়ারম্যান এইচ এম এরশাদকেও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। তিনি বলেন, পল্টন ময়দান জনস্রোত। বেলা দেড়টার দিকে তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেতার এপিএস আলাউদ্দিন আহমেদ চৌধুরী নাসিম মরহুম এইচ এম এরশাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে তাকে নিয়ে জিয়াউদ্দিন বাবলুর গুলশানের বাসভবনে অপেক্ষা করছিলেন। আজকের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে নাসিমের দফায় দফায় যোগাযোগ হচ্ছিল। আলাউদ্দিন নাসিম আমাকে ও নোয়াখালী-১ আসনের বর্তমান এমপি এইচ এম ইবরাহিমকে কালো গ্লাসের একটি গাড়ি নিয়ে জিয়াউদ্দিন বাবলুর গুলশানের বাসায় আসতে বলেন। এরপর এইচ এম ইবরাহিম আমাকে ফোনে বলেন, জরুরিভাবে গুলশানে বাবলুর বাসায় নিজে ড্রাইভ করে যেতে হবে, সহযোগী কাউকে নেওয়া যাবে না। আওয়ামী লীগের এই নেতা বলেন, তখন আমি বিশেষ বার্তা বুঝতে পেরে আমার কালো রঙের জিপ গাড়িটি নিয়ে নিজেই চালিয়ে গুলশানে জিয়াউদ্দিন বাবলুর বাসায় চলে আসি। এসেই দেখি এইচ এম এরশাদ, আলাউদ্দিন আহমেদ চৌধুরী নাসিম ও জিয়াউদ্দিন বাবলুও বসা। তারা আমাদের অপেক্ষায় ছিলেন। পরে সবাই একটেবিলে দুপুরের খাবার খাই। বেলা ২টার দিকে আমরা পল্টন ময়দানের দিকে রওনা হই। আমি নিজেই গাড়ি ড্রাইভ করি। আলাউদ্দিন নাসিম নির্বিঘ্নে পল্টন ময়দানে পৌঁছতে গুলশান থেকে পল্টন যাওয়ার পথে বিভিন্ন স্থানে নিরাপত্তার জন্য আগে থেকেই যুবলীগ-ছাত্রলীগ নেতা-কর্মীদের অপেক্ষায় থাকতে বলেন। নেতা-কর্মীরা অবস্থান নিয়েও ছিলেন। এরশাদের যাওয়ার পথে যেন কোনো বাধা সৃষ্টি না হয় রাস্তা নিরাপদ রাখার জন্য এ ব্যবস্থা করে রাখেন তিনি। সেদিনের ঘটনা বর্ণনা করে আওয়ামী লীগের সাবেক এই এমপি প্রার্থী বলেন, গাড়ির পেছনে বসা ছিলেন এইচ এম এরশাদ। সামনের আসনে ছিলেন আলাউদ্দিন আহমেদ চৌধুরী নাসিম। চালকের আসনে আমি। পথে জরুরি প্রয়োজনে গাড়ি পরিবর্তন করে এরশাদ ও নাসিম অন্য গাড়িতে উঠে বসেন। দুটি গাড়ি একসঙ্গে পল্টন ময়দানের উদ্দেশে রওনা হয়। পৌনে ৩টার দিকে মঞ্চের পেছনে গিয়ে থামি। এরশাদকে সঙ্গে নিয়ে আমরা মঞ্চে উঠি। পুরো পল্টন ময়দান তখন লাখ লাখ জনতায় ভরপুর। ওই মুহূর্তে এরশাদকে দেখে লাখো জনতা মুহুর্মুহু করতালির মাধ্যমে অভিবাদন জানান। এ সময় আমাদের নেত্রী আজকের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, এইচ এম এরশাদ, অধ্যাপক বদরুদ্দোজা চৌধুরী ও কর্নেল (অব.) অলি আহমদসহ সবাইকে নিয়ে হাত নেড়ে জনতার অভিবাদনের জবাব দেন। সেদিনই প্রকৃত অর্থে মহাজোটের আত্মপ্রকাশ ঘটে।

সর্বশেষ খবর