বুধবার, ১১ ডিসেম্বর, ২০১৯ ০০:০০ টা

রোহিঙ্গা গণহত্যার বিচার শুরু

নিজ নাগরিকদের উৎখাত করছে মিয়ানমার : গাম্বিয়া; ফেক রেপ নামে ফেসবুক পেজ খোলে সু চি, বাইরে বাংলাদেশিদের বিক্ষোভ

কূটনৈতিক প্রতিবেদক

রোহিঙ্গা গণহত্যার বিচার শুরু

নেদারল্যান্ডসের হেগে ইন্টারন্যাশনাল কোর্ট অব জাস্টিসে (আইসিজে) বিভিন্ন অভিযোগ উপস্থাপনের সময় সু চি ছিলেন নির্বিকার -এএফপি

রাখাইনে রোহিঙ্গাদের ওপর গণহত্যার অভিযোগে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে (আইসিজে) শুনানি গতকাল শুরু হয়েছে। ইসলামী সহযোগিতা সংস্থার (ওআইসি) সমর্থনে গাম্বিয়া আইসিজেতে ওই মামলাটি করেছে। রোহিঙ্গাদের সুরক্ষা দেওয়া এবং রাখাইনে গণহত্যার আলামত নষ্টের বিভিন্ন উপাদান উল্লেখ করে গাম্বিয়ার করা অন্তর্বর্তী পদক্ষেপের নির্দেশনার বিষয়ে তিন দিনের এ শুনানি হচ্ছে।

দ্য হেগের স্থানীয় সময় সকাল ১০টায় বিভিন্ন দেশের কূটনীতিক, রোহিঙ্গা ও মানবাধিকার সংগঠনের প্রতিনিধিদের উপস্থিতিতে শুনানি শুরু হয়। গাম্বিয়ার প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব দিচ্ছেন সে দেশের আইন ও বিচারমন্ত্রী আবুবকর মারি তামবাদু। মিয়ানমারের নেতৃত্বে রয়েছেন দেশটির স্টেট কাউন্সিলর অং সান সু চি। শুনানির শুরুতে আইসিজের প্রেসিডেন্ট আবদুলকোয়াই আহমদ ইউসুফ শুনানির প্রক্রিয়া সম্পর্কে বিচারকক্ষে উপস্থিত সুধীজনদের অবহিত করেন। নিয়মানুযায়ী গতকাল শুনানির শুরুতেই দুই অ্যাডহক বিচারপতি গাম্বিয়ার নাভি পিল্লাই ও মিয়ানমারের প্রফেসর ক্লাউস ক্রেস শপথ নিয়েছেন। অ্যাডহক বিচারপতিদের শপথের পর আইসিজের রেজিস্ট্রার ফিলিপ গোতিয়ে অন্তর্বর্তী পদক্ষেপের নির্দেশনা চেয়ে গাম্বিয়া আবেদনে যা বলেছে তা পড়ে শোনান। গাম্বিয়ার বিচারমন্ত্রী আবুবকর মারি তামবাদু কেন মিয়ানমারের বিরুদ্ধে মামলাটি করা হয়েছে সেই প্রেক্ষাপট তুলে ধরেন। এরপর তিনি জানান, আবেদনের পক্ষে কারা কী বিষয়ে কথা বলবেন। তিনি বলেন, ‘পুরো গাম্বিয়াবাসীর চাওয়া হলো, কা-জ্ঞানহীন এই হত্যা বন্ধ করুক মিয়ানমার। এসব বর্বরতা ও নৃশংসতা, যা আমাদের হতবাক করেছে এবং আমাদের সমন্বিত বিবেককে আহত করছে অব্যাহতভাবে, তা বন্ধ করতে হবে। মিয়ানমারকে নিজেদের লোকদের বিরুদ্ধে এই গণহত্যা বন্ধ করতে হবে। রুয়ান্ডার গণহত্যার জন্য গঠিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে মামলা পরিচালনার অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ তামবাদুর সঙ্গে আন্তর্জাতিক আইনে বিশেষজ্ঞ যুক্তরাজ্যের অধ্যাপক ফিলিপ স্যান্ডস, অধ্যাপক পায়াম আখাভানসহ বেশ কয়েকজন বিশ্বপরিসরের নেতৃস্থানীয় আইনজ্ঞ শুনানিতে অংশ নেন। রাখাইনে গণহত্যা নিয়ে অধ্যাপক পায়াম আখাভান বলেন, গতকাল (মঙ্গলবার) গণহত্যা সনদের ৭০তম বার্ষিকী ছিল। কিন্তু এ সনদের আলোকে গণহত্যা বন্ধ হয়নি। গণহত্যার সনদ কীভাবে লঙ্ঘিত হচ্ছে তা তুলে ধরেন তিনি। জাতিসংঘ তদন্তকারীরা রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে ঘৃণা ও বিদ্বেষ ছড়ানোয় রাষ্ট্রীয় ভূমিকার কথা বলেন। তদন্তে গণহারে হত্যাযজ্ঞ পরিচালনার প্রমাণ মিলেছে, যা সনদের লঙ্ঘন। গণহত্যা সনদ ও আইসিসির রায়ে যে ধর্ষণ ও যৌন সহিংসতাকে গণহত্যার মতো অপরাধ গণ্য করা হয়েছে, জাতিসংঘের তদন্তে সে ধরনের অপরাধের বর্ণনা রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের আইনজীবী অ্যান্ড্রু লোয়েনস্টেইন যুক্তি তুলে ধরে বলেন, মিয়ানমার জনমিতিক গঠন (ডেমোগ্র্যাফিক স্ট্রাকচার) পরিবর্তনের চেষ্টা করছে। সেনাপ্রধান রোহিঙ্গাবিরোধী প্রচারে জড়িত থাকায় তার ফেসবুক ও টুইটার অ্যাকাউন্ট বন্ধ করে দিতে হয়েছিল, যা রাষ্ট্রীয় নীতি ও ভূমিকার প্রমাণ। বক্তব্য দেন যুক্তরাষ্ট্রের আইনজীবী আরসালান সুলেমান। তিনি আইসিজের এখতিয়ার বিষয়ে আদালতের বিধিমালার ৪১(১) উদ্ধৃত করেন। এরপর বক্তৃতা দেন যুক্তরাষ্ট্রের আইনজীবী তাফাদজ পাসিপান্দো। তিনি আদালতের কাছে আরাকানে এখনো যে ৬ লাখ রোহিঙ্গা আছেন, তাদের দুর্ভোগ ও ঝুঁকির কথা তুলে ধরেন। পাসিপান্দো সেখানে রোহিঙ্গাদের কাঁটাতারের বেষ্টনীর মধ্যে শিবিরে আটক রাখা, চলাচলের স্বাধীনতা খর্ব করা ও অন্যান্য বিধিনিষেধের কথা, যা জাতিসংঘের তদন্তে উঠে এসেছে, সেগুলোর বিবরণ দেন। এই আইনজীবী বলেন, রোহিঙ্গাদের চাষাবাদের জমি কেড়ে নেওয়া হয়েছে, খাদ্য সরবরাহ কমানো হয়েছে, তাদের পালিত পশু কেড়ে নেওয়া হয়েছে বলে জাতিসংঘ তদন্তে যে তথ্য উঠে এসেছে, তার উদ্দেশ্য হচ্ছে তাদের অভুক্ত রাখা। এগুলো গণহত্যার উদ্দেশ্য হিসেবে সনদের লঙ্ঘন। আরও গণহত্যার অপরাধ যাতে না ঘটে, সেজন্য ব্যবস্থা নিতে পারে এই আদালত। তিনি বিভিন্ন প্রমাণ তুলে ধরে বলেন, এগুলোয় গণহত্যার উদ্দেশ্যের প্রতিফলন ঘটেছে। এরপর তিনি তার বক্তব্য শেষ করেন। আইনজীবী তাফাদজ পাসিপান্দো বলেছেন, রোহিঙ্গা নারীদের ধর্ষণের কথা অস্বীকার করতে মিয়ানমারের স্টেট কাউন্সিলর অং সান সু চি বলেছেন, সেনাবাহিনী ও বৌদ্ধ জনগোষ্ঠীর কেউ নোংরা বাঙালি মেয়েকে ছোঁবে না। ওরা আকর্ষণীয় নয়। এই আইনজীবী বলেন, ফেসবুকে ‘ফেক রেপ’ নামে যে পেজ খোলা হয়েছে, তার নিয়ন্ত্রণও হচ্ছে স্টেট কাউন্সিলরের দফতর থেকে। ইন্টারন্যাশনাল কোর্ট অব জাস্টিস (আইসিজে) আদালতে গাম্বিয়ার লিখিত অভিযোগে বলা হয়েছে, কথিত শুদ্ধি অভিযানের সময় গণহত্যামূলক কর্মকা- সংঘটিত হয়েছে, যার উদ্দেশ্য ছিল গোষ্ঠীগতভাবে অথবা আংশিকভাবে রোহিঙ্গাদের ধ্বংসসাধন। এজন্য অবাধে হত্যা, ধর্ষণ ও অন্যান্য যৌন সহিংসতা, কখনো কখনো বাড়িতে লোকজনকে আটকে রেখে জ্বালিয়ে দেওয়ার মাধ্যমে গ্রামগুলোর পদ্ধতিগত ধ্বংস সাধন করা হয়েছে। গাম্বিয়া গণহত্যাবিষয়ক আন্তর্জাতিক সনদের ৩ নম্বর ধারার আলোকে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে সনদ লঙ্ঘনের অভিযোগ করেছে।

আজ মিয়ানমার বক্তব্য দেবে : বিচারকাজের সূচি অনুসারে আজ মিয়ানমার তার অবস্থান তুলে ধরবে। এরপর আগামীকাল সকালে গাম্বিয়া এবং বিকালে মিয়ানমার প্রতিপক্ষের যুক্তি খ-ন ও চূড়ান্ত বক্তব্য পেশ করবে। মামলার রায় পেতে স্বল্পতম আট সপ্তাহ থেকে কয়েক বছর পর্যন্ত লাগতে পারে।

আদালতের সিদ্ধান্ত হবে সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে : আদালতে ১৫ বিচারক ও দুই অ্যাডহক বিচারক বিচারকাজ পরিচালনা করছেন। এর মধ্যে সভাপতিত্ব করছেন সোমালিয়ার বিচারপতি আবদুলকোয়াই আহমদ ইউসুফ ও সহসভাপতি হিসেবে আছেন চীনের বিচারক সুই হানকিন। অন্য বিচারকরা হলেন স্লোভাকিয়ার বিচারক পিটার তোমকা, ফ্রান্সের বিচারক রোনি আবরাহাম, মরক্কোর বিচারক মুহাম্মদ বেনোউনা, ব্রাজিলের বিচারক অ্যান্তানিও অগাস্তো ক্যানকাদো ত্রিনদাদে, যুক্তরাষ্ট্রের বিচারক জোয়ান ই ডোনোঘুয়ে, ইতালির বিচারক জর্জিও গাজা, উগান্ডার বিচারক জুলিয়া সেবুতিনডে, ভারতের বিচারক দলবীর ভা ারী, জ্যামাইকার বিচারক প্যাটট্রিক লিপটন রবিনসন, অস্ট্রেলিয়ার বিচারক জেমস রিচার্ড ক্রফোর্ড, রাশিয়ার বিচারক কিরিল জেভোরজিয়ান, লেবাননের বিচারক নাওয়াফ সালাম ও জাপানের বিচারক ইউজি ইয়াসাওয়া। তাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছেন দুজন অ্যাডহক বিচারপতি গাম্বিয়ার নাভি পিল্লাই ও মিয়ানমারের ক্লাউস ক্রেস। আদালতের সিদ্ধান্ত হবে সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে।

আদালতে ভাবলেশহীন সু চি : মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে যখন নৃশংসতার বর্ণনা দিয়ে যাচ্ছিলেন গাম্বিয়ার টিম, তখন ভাবলেশহীন বসে ছিলেন মিয়ানমারের নেত্রী অং সান সু চি। পুরোটা সময় আদালত কক্ষে সু চি চুপচাপ বসে ছিলেন। শুনানি শুরুর আগে গাড়িবহর নিয়ে হেগে অবস্থিত পিস প্যালেসে হাজির হন সু চি। সেখানে আগে থেকেই উপস্থিত ছিলেন সাংবাদিকরা। তারা চিৎকার করে তার প্রতি প্রশ্ন ছুড়ে দিচ্ছিলেন। কিন্তু কোনো উত্তর দেননি সু চি।

বাইরে রোহিঙ্গাদের পাশাপাশি বিক্ষোভ করেন বাংলাদেশিরাও : হেগের আদালতে যখন বিচারকাজ চলছিল তখন বাইরে ব্যানার, প্ল্যাকার্ড নিয়ে বিক্ষোভ প্রকাশ করেন বিভিন্ন দেশ থেকে নেদারল্যান্ডসে জড়ো হওয়া রোহিঙ্গা নাগরিকরা। পাশাপাশি আরেক অংশে প্রবাসী বাংলাদেশিদেরও স্লোগান দিয়ে বিক্ষোভ করতে দেখা যায়। অবশ্য শুধু বিক্ষোভ নয়, মামলায় গাম্বিয়াকে লজিস্টিক বিভিন্ন সাপোর্ট দিতে হেগে উপস্থিত আছে বাংলাদেশের একটি প্রতিনিধি দল। শুধু বাংলাদেশ নয়, গাম্বিয়াকে সাপোর্ট করতে সেখানে আছে কানাডার প্রতিনিধি দল, নেদারল্যান্ডসের বিভিন্ন কর্মকর্তা ও মুসলিম বিশ্বের দেশগুলোর সংগঠন ওআইসির কূটনীতিকরা।

সর্বশেষ খবর