ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন নির্বাচনে জমজমাট প্রচারণায় ভোট উৎসবের আমেজ আছে। পাশাপাশি ভোটারদের মধ্যে শঙ্কাও বিরাজ করছে। আওয়ামী লীগের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপি ঘুরে ফিরে শঙ্কার কথাই বলছে। তবে দৃশ্যমান হলো, দুই একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছাড়া এখনো সব মেয়র প্রার্থীই সৌহার্দ্যপূর্ণ পরিবেশে গণসংযোগ চালিয়ে যাচ্ছেন। প্রচার নিয়ে কারও তেমন কোনো প্রশ্ন নেই। ২০১৪ সালের পর এই প্রথম ঢাকায় সব প্রার্থীদের একসঙ্গে পোস্টার দেখা যাচ্ছে। কাউন্সিলর প্রার্থীরাও দ্বারে দ্বারে ভোট প্রার্থনা করছেন। তবে কিছু কিছু জায়গায় দুই প্রতিপক্ষ ও বিদ্রোহী প্রার্থীদের মধ্যে বাধা ও হামলার অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে। এ দিকে সরকার সমর্থিত মেয়র প্রার্থীরা বিএনপিসহ অন্যান্য প্রার্থীদের নির্ভয়ে গণসংযোগের প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন। এমনকি ঢাকা সিটি করপোরেশন উত্তরে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী আতিকুল ইসলাম তার প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী ধানের শীষের মেয়র প্রার্থী তাবিথ আউয়ালকে বলছেন, কোথাও তাবিথের পোস্টার ছিঁড়ে ফেলা হলে তিনি নিজেই তা লাগিয়ে দেবেন। একইভাবে দক্ষিণে নৌকার মেয়র প্রার্থী ফজলে নূর তাপস তার নেতা-কর্মীদের বলেছেন, আচরণবিধি লঙ্ঘন করা যাবে না।
নির্বাচন কমিশন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, সব প্রার্থীর জন্য সমান সুযোগ সৃষ্টি করা হয়েছে। ভোটে শেষ পর্যন্ত উৎসবমুখর পরিবেশ বজায় রাখা হবে। ভোটারদের কেন্দ্রে যাওয়ার জন্য সব ধরনের নিরাপত্তা দেওয়া হবে। ইভিএমে ভোট কারচুপি রোধ করাও সম্ভব বলে জনগণকে আশ্বস্ত করছে নির্বাচন কমিশন। এ প্রসঙ্গে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) কমিশনার মোহা. শফিকুল ইসলাম গতকাল সন্ধ্যায় বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘আমি মনে করি এখন পর্যন্ত ভোটের সুষ্ঠু পরিবেশে বিঘ্নতা ঘটেনি। উৎসবমুখর ভোটের পরিবেশ বজায় আছে। এই পরিবেশ শেষ পর্যন্ত বজায় রাখতে আমাদের সর্বাত্মক প্রচেষ্টা থাকবে।’ সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘নির্বাচন কমিশনের ওপর যখন আস্থার সংকট থাকে তখন ভোট নিয়ে শঙ্কাও থাকবে। এই নির্বাচন কমিশন বলেছিল, সবাই না চাইলে ইভিএম ব্যবহার করা হবে না। কিন্তু চারদিকে এত বিরোধিতা সত্ত্বেও কোনো এক অদৃশ্য শক্তির কারণে তারা ইভিএম ব্যবহার করবেই। ইভিএমে যে ভোট দেওয়ার পর কোনো চ্যালেঞ্জেরও সুযোগ নেই। তাছাড়া ইসি সব সময় পক্ষপাতমূলক আচরণ করে আসছে। তাই এখন যতই উৎসবের আমেজ থাকুক না কেন, ভোটের দিনের শঙ্কা সবার মাঝেই বিরাজ করছে।’ রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, দুই নির্বাচন কমিশনারের বক্তব্যেও উৎসবের ভোটে শঙ্কার চিত্রই ফুটে উঠেছে। সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে নির্বাচন কমিশনার রফিকুল ইসলাম বলেছেন, বুথ দখল করলে ইভিএমএ জাল দেওয়া সম্ভব। সর্বশেষ গতকাল নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার বলেন, আসন্ন ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন নির্বাচনের আচরণবিধি লঙ্ঘনের বিষয়ে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটদের কার্যক্রম দৃশ্যমান নয়। এই ধরনের বক্তব্যে সরকারবিরোধী প্রার্থীদের মধ্যে শঙ্কার বিষয়টি বাড়িয়ে দেয়। তাছাড়া ঢাকার দুই সিটিতে বেশকিছু ঝুঁকিপূর্ণ কেন্দ্র রয়েছে। এগুলো নিয়েও বাড়তি শঙ্কা আছে। আবার প্রধান দুই দলে বেশকিছু বিদ্রোহী প্রার্থী রয়েছে। ভোটের দিন কাউন্সিলর প্রার্থীদের মধ্যেও এবার বেশি সংঘর্ষ বাধতে পারে।
এ প্রসঙ্গে স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ ড. তোফায়েল আহমেদ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, নির্বাচন কমিশনারদের এ ধরনের বক্তব্যে সরকারবিরোধী দলগুলোর পাশাপাশি ভোটাররাও শঙ্কিত। নির্বাচন কমিশন যদি হতাশার কথা শুনায়, তাহলে সাধারণ ভোটারদের কী হবে? ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারকরা জানান, ভোটের সুষ্ঠু পরিবেশ বজায় রাখতে সরকার ও দলের পক্ষ থেকে সর্বাত্মক সহযোগিতা করা হবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও চান, দুই সিটি ভোট সুষ্ঠু হোক। যে কোনো মূল্যে ভোটকে বিতর্কের ঊর্ধ্বে রাখতে চান তিনি। এ ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রী হার্ডলাইনে। দলের শীর্ষ নেতাদেরই নয়, মন্ত্রী, এমপি থেকে বিভিন্ন সংস্থার দায়িত্বশীলদের সঙ্গে বৈঠকে তার এ মনোভাব জানিয়ে দিয়েছেন। দায়িত্বশীল একাধিক সূত্র জানিয়েছেন, ওই সব বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জানিয়েছেন, সিটি নির্বাচন হবে অবাধ, গ্রহণযোগ্য ও নিরপেক্ষ।এ প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘প্রশ্নবিদ্ধ ও বিতর্কিত নির্বাচন করতে চাই না। আওয়ামী লীগ সভানেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পরিষ্কারভাবে বলেছেন নির্বাচন নিরপেক্ষ হতে হবে। নির্বাচন কমিশন সুষ্ঠু নির্বাচন করবে। সরকার সব ধরনের সহযোগিতা করবে। রেজাল্ট যেটাই হোক আমরা মেনে নেব।’
বিএনপির নীতিনির্ধারকরা বলছেন, ভোটের দিন স্বাভাবিক পরিবেশ বিরাজ থাকবে না। দিন যতই গড়াচ্ছে ততই ভোটের পরিবেশ নিয়ে শঙ্কা বাড়ছে। দলটির শঙ্কা, এবারও তাদের পোলিং এজেন্টদের বের করে দেওয়া হতে পারে। এ জন্য প্রতিটি ভোট কেন্দ্রে বিকল্প এজেন্ট রাখারও সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিএনপি। পোলিং এজেন্টদের ইভিএম নিয়ে প্রশিক্ষণও দেওয়া হচ্ছে। প্রতিটি ভোট কেন্দ্রে যেন এজেন্ট থাকে সেই চ্যালেঞ্জও এবার নিচ্ছে দলটি। এ ছাড়া ওয়ার্ড পর্যায়ের সাহসী, ত্যাগী ও দক্ষ নেতাদের দিয়েই পোলিং এজেন্ট করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিএনপি।
এ প্রসঙ্গে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, আমরা শুরু থেকেই বলে আসছি, দলীয় সরকার ও বর্তমান নতজানু নির্বাচন কমিশনের অধীনে সুষ্ঠু ভোট হবে না। তারপরও আমরা আমাদের নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া ও গণতন্ত্রের মুক্তির স্বার্থে ভোটে অংশ নিয়েছি। তবে ভোটের দিন যতই যাচ্ছে, শঙ্কা ততই বাড়ছে।
শতাধিক ভোট কেন্দ্র নিয়ে চিন্তায় ইসি : ঢাকার উত্তর-দক্ষিণ সিটির শতাধিক ভোট কেন্দ্র নিয়ে চিন্তিত আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর বাসার পাশের কেন্দ্রগুলোকে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ মনে করা হচ্ছে। তবে নির্বাচন কমিশন চূড়ান্ত তালিকা তৈরির কাজ করছে। কর্মকর্তারা বলছেন, বিশেষ করে আওয়ামী লীগের যে সব ওয়ার্ডে একাধিক প্রার্থী রয়েছে, এ গুলোতে বাড়তি নিরাপত্তা থাকবে। তারা বলেন, প্রতি সাধারণ কেন্দ্রে বিভিন্ন বাহিনীর ১৯ জন করে এবং ঝুঁকিপূর্ণ কেন্দ্রে ২৩ জন করে ফোর্স মোতায়েন থাকবে। এ ছাড়া নির্বাচনে পুলিশ, এপিবিএন ও ব্যাটালিয়ন আনসার সমন্বয়ে মোবাইল টিম নিয়োজিত থাকবে। থাকবে র্যাব ও বিজিবির সদস্যরা। এদিকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রাথমিক তথ্য অনুযায়ী- দুই সিটিতে ঝুঁকিপূর্ণ ৫০টি কেন্দ্র আছে। এর মধ্যে উত্তর সিটিতে ২৩টি আর দক্ষিণ সিটিতে ২৭টি কেন্দ্র। কেন্দ্রগুলোর ওয়ার্ডে ক্ষমতাসীন দলের একাধিক বিদ্রোহী প্রার্থী থাকা, সাম্প্রতিক সময়ে ক্যাসিনো ও দুর্নীতিবিরোধী অভিযানের প্রভাব, দলীয় মনোনয়ন না পাওয়া প্রার্থীদের ক্ষোভ, বিরোধী দলের শক্ত প্রার্থী থাকা ও এলাকাগুলো ক্রাইম জোন হওয়ার কারণে ঝুঁকিপূর্ণ ধরে নেওয়া হয়েছে।
উত্তরে ভোট কেন্দ্রের সংখ্যা ১ হাজার ৩১৮ আর দক্ষিণে ১ হাজার ১৫০টি। বিভিন্ন ওয়ার্ডে ক্ষমতাসীন দলের বিদ্রোহী প্রার্থী রয়েছেন। এ ছাড়াও আগের দায়িত্ব পালন করা কাউন্সিলর যারা দলের মনোনয়ন পাননি, তারাও ভোটে দাঁড়িয়েছে।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে দুই সিটির নির্বাচন নিয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে বৈঠক শেষে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেন, ঝুঁকিপূর্ণ কেন্দ্র এখনো কোনোটাই মনে হচ্ছে না। যদি থাকে নির্বাচন কমিশন থেকে তালিকা আসবে, সে অনুযায়ী নিরাপত্তা ব্যবস্থা থাকবে।