শিরোনাম
শুক্রবার, ৭ ফেব্রুয়ারি, ২০২০ ০০:০০ টা

ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস সঠিকভাবে উপস্থাপিত হয়নি

সৈয়দ আনোয়ার হোসেন

ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস সঠিকভাবে উপস্থাপিত হয়নি

ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস সূচনাই হয়েছিল বঙ্গবন্ধুকে দিয়ে। ১৯৪৭ সালের আগস্ট মাসে পাকিস্তান হলো। বঙ্গবন্ধু ছিলেন পাকিস্তান আন্দোলনের নিষ্ঠকর্মী। কিন্তু পাকিস্তান হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই তার মোহ ভঙ্গ হলো। কলকাতার বেকার হোস্টেলে বসে সেই সময়েই তিনি সঙ্গীদের বলেছিলেন, পাকিস্তানিদের সঙ্গে বেশি দিন থাকা যাবে না। ঢাকায় ফিরে বাঙালির অধিকার আদায়ের জন্য নতুন করে আন্দোলন শুরু করতে হবে। সেই কাজটি তিনি করেছিলেন। অন্যদিকে বাঙালির মোহ ভঙ্গ হতে অনেক সময় লেগেছিল ভাষা আন্দোলন শেষ হওয়া পর্যন্ত। কিন্তু ভাষা আন্দোলনের পটভূমিটাই আমরা জানি না।

দেশ ভাগের পর পরই একদিন কলকাতা থেকে প্রকাশিত মুসলমানদের স্বার্থ রক্ষাকারী পত্রিকা সাপ্তাহিক মিল্লাত-এর সম্পাদকের কক্ষে বসে আড্ডা দিতে দিতে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘এই যে পাকিস্তান হলো, এই পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হতে হবে বাংলা। কারণ, বাংলা পাকিস্তানের গরিষ্ঠ জনগণের ভাষা।’ এর আগেও ভাষা নিয়ে অনেক কথা হয়েছে, তবে সেটা উর্দুর পক্ষে। ’৪৭-এর জুলাই মাসে আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. জিয়াউদ্দিন আহমেদ বলেছিলেন, পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হতে হবে উর্দু। বঙ্গবন্ধু বললেন, ‘বাংলা’। তাই আমি মনে করি বঙ্গবন্ধুই ভাষা আন্দোলনের দ্রষ্টা এবং স্রষ্টা। ’৪৮-এ হরতাল হয়েছিল। কিন্তু ’৪৭-এর ১৫ সেপ্টেম্বর তমদ্দুন মজলিশ থেকে ছোট্ট একটি পুস্তিকা প্রকাশ করা হলো- ‘পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা বাংলা না উর্দু’। একই বছরের নভেম্বরে ঢাকায় চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীরা একটি প্রতিবাদ মিছিল বের করে। প্রতিবাদটা ছিল- ‘পোস্টকার্ড শুধু উর্দু এবং ইংরেজিতে ছাপা হয়েছে, বাংলায় কেন নয়?’ অর্থাৎ, ভাষা আন্দোলন ’৪৭ থেকেই শুরু হয়েছিল। প্রশ্ন উঠতে পারে- মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ তো অত্যন্ত বিচক্ষণ মানুষ ছিলেন। তিনি কী করে মেনে নিলেন ৬ দশমিক ০৭ ভাগ মানুষের ভাষা উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করবেন? এখানে যুক্তি নয়, কাজ করেছিল ইসলামিক আবেগ। তিনি ইসলামকে রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার করেছিলেন। ভাষার প্রশ্নেও তিনি সেটাই করতে চাইলেন। কারণ, ১৮৬৭ সালে বেনারসে হিন্দু নেতৃবৃন্দ একটি সভায় সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন যে, ভারতের রাষ্ট্রভাষা হবে হিন্দি। তার পরপরই স্যার সৈয়দ আহমেদ খান বলেন, এই সিদ্ধান্তের পরে হিন্দু আর মুসলমানের কোনো মিলন হবে না। তাহলে মুসলমানের ভাষা হবে উর্দু। উর্দু-হিন্দি সংঘাত লেগে গেল। ভাষার রাজনীতিকীকরণ হলো। সাম্প্রদায়িকীকরণ হলো। অথচ, উর্দু বা হিন্দি কোনোটাই মূল ভাষা নয়। মুঘল আমলে সেনাবাহিনীর মধ্যে হিন্দুস্তানি ভাষা চালু হয়েছিল নানান ভাষা নিয়ে। সেখান থেকে হিন্দু পন্ডিতরা ফার্সি ও আরবি শব্দ ছেঁটে দিয়ে দেবনাগরী ভাষায় লেখা শুরু করলেন নতুন ভাষা। সেটা হিন্দি। তার প্রতিক্রিয়ায় মুসলমানরা হিন্দুস্তানি ভাষা থেকে সংস্কৃত ও আঞ্চলিক শব্দ ছেঁটে দিয়ে যে ভাষা তৈরি করলেন তার নাম হলো উর্দু। এটা ইসলামী ভাষা হিসেবে বিবেচিত হওয়ার পেছনের কারণটি হলো ভাষাটি লেখা হয় আরবি হরফে। ভাষার মধ্যে ধর্মান্ধতা, সাম্প্রদায়িকতা, রাজনৈতিক চেতনা চলে এলো। সেই সুবাদে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে মেনে নিলেন। এটাই পটভূমি। এ জন্য আমি মনে করি, ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস সঠিকভাবে উপস্থাপিত হয়নি। যেটা আছে সেটা ইতিহাস নয়। দীর্ঘ সংগ্রামের মাধ্যমে আমরা বাংলা ভাষা পেয়েছি। অথচ বাঙালিরা বর্তমানে ভাষা প্রতিবন্ধী জাতি। আমরা বাংলা ভাষাও জানি না, ইংরেজিকে তাড়িয়ে আবার আলিঙ্গন করার চেষ্টা করছি। কিন্তু ইংরেজিও শিখতে পারছি না। আমরা না পারি বাংলা ভালো করে বলতে ও লিখতে, না পারি ইংরেজি ভালো করে বলতে ও লিখতে। বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষায় ইংরেজিকে তাড়াতে কেউ কোনো দিন বলেনি। আন্তর্জাতিক ভাব বিনিময়ের মাধ্যম ইংরেজি। ইংরেজিতে কথা বলা মানুষরাই আমাদের শোষণ করে। তাদের শোষণের দাঁত ভাঙা জবাব দিতে হলে আমাকেও ইংরেজি জানতে হবে। রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, ‘এই বাংলায় শিক্ষার উচ্চপর্যায়ে ইংরেজি ও বাংলা গঙ্গা-যমুনার মতো মিলিত ধারায় চলিবে।’ বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে বাংলা পড়তে হবে কে বলেছে? কেন করা হলো? বিত্তবানের সন্তান ঠিকই ইংরেজি মাধ্যমে পড়ছে। ইংরেজি মাধ্যমে পড়ে ইংরেজি না শিখলেও ভালো চাকরি পাচ্ছে। দরিদ্রের সন্তানকে বাধ্য করা হচ্ছে বাংলা মাধ্যমে পড়তে। তারা প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হয়েও ভালো চাকরি পাচ্ছে না। ভুল শিক্ষানীতির কারণে একটা শ্রেণিবৈষম্য তৈরি করা হয়েছে।

লেখক : ইতিহাসবিদ ও বঙ্গবন্ধু চেয়ার অধ্যাপক, বিইউপি। অনুলেখক : শামীম আহমেদ।

সর্বশেষ খবর