শনিবার, ২৩ মে, ২০২০ ০০:০০ টা

এ ঈদে নেই মৌসুমি রাজনীতিবিদরা

স্যুটেট-বুটেট হাইব্রিডরা গা-ঢাকা, দুঃসময়ে ছাত্রলীগ-যুবলীগের রাজনীতি করে আসারা সাধ্যমতো চেষ্টা করছেন জনগণের পাশে দাঁড়াতে

রফিকুল ইসলাম রনি

এ ঈদে নেই মৌসুমি রাজনীতিবিদরা

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বরগুনা-১ আসনে নৌকা প্রতীকের মনোনয়ন পেতে আওয়ামী লীগের মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করেছিলেন ৫২ জন। এটি ছিল বিগত সংসদ নির্বাচনে কোনো আসন থেকে সর্বোচ্চসংখ্যক মনোনয়নপ্রত্যাশী। সংসদ নির্বাচনের আগে এসব মনোনয়নপ্রত্যাশী নিজ নিজ এলাকায় বিশাল জনদরদি, সমাজসেবক সেজে গরিব-দুঃখীদের মাঝে ত্রাণ, মসজিদ-মাদ্রাসায় নগদ টাকা বিতরণ করেছেন। কেউ কেউ লাখ-কোটি টাকা খরচ করে শোডাউন করেছেন নিজের জনপ্রিয়তা দেখাতে। চলতি বছরের মার্চ থেকে শুরু হওয়া করোনাভাইরাস ও সদ্য আঘাত হানা প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড়ে মানুষ যখন কর্মহীন, ঘরহারা, অসহায় হয়ে পড়েছেন তখন দু-একজন ছাড়া জনগণের পাশে নেই সেই মনোনয়নপ্রত্যাশী নেতারা। 

একই অবস্থা বরগুনা-২ আসনেও। এ আসনেও নৌকা পেতে মনোনয়ন ফরম তুলেছিলেন ৩২ জন। কুড়িগ্রাম-৪ আসনে নৌকার টিকিট বিক্রি হয়েছিল ৩০টি। এ আসনে বর্তমান এমপি ও মনোনয়নপ্রত্যাশীদের দু-একজন ছাড়া সবাই ‘সেফ আইসোলেশনে’। শুধু বরগুনা বা কুড়িগ্রামই নয়, এমন চিত্রই প্রায় ৬৪ জেলায়। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ৩০০ আসনে এমপি হতে নৌকার টিকিট কিনেছিলেন ৪ হাজার ২৩ জন। একইভাবে সংরক্ষিত নারী আসনে দলীয় মনোনয়ন পেতে ৪৩ আসনের বিপরীতে নায়িকা, গায়িকাসহ ১ হাজার ৫১০ জন মনোনয়ন ফরম সংগ্রহ করেছিলেন। আর পাঁচ ধাপে উপজেলা নির্বাচনে ৪৯২ উপজেলায় প্রায় ৫ হাজার নেতা নৌকার টিকিট কিনেছিলেন চেয়ারম্যান হতে। আবার আওয়ামী লীগের সহ-সম্পাদক কিংবা বিভিন্ন উপ-কমিটির সদস্য পদধারী ‘কেন্দ্রীয়’ নেতার পরিচয়ে এলাকায় গিয়ে দাপট দেখাতেন এমন নেতার সংখ্যাও ৫ হাজারের বেশি। প্রাণঘাতী করোনাভাইরাস ও সদ্য আঘাত হানা প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড়ে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের পাশে নেই এসব মৌসুমি নেতা।

সূত্রমতে, বরগুনা-১ আসনের সংসদ সদস্য ধীরেন্দ্র দেবনাথ শম্ভুকে বাদ দিয়ে অন্য যে কাউকে মনোনয়ন দিতে একজোট হয়েছিলেন প্রায় ৫০ জন নেতা। কিন্তু চলমান প্রাণঘাতী করোনাভাইরাস ও প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড় আম্ফানের এই দুর্যোগের ঈদেও ত্রাণ বিতরণ তো দূরের কথা, টেলিফোনেও খোঁজখবর নেননি অধিকাংশ নেতা। বর্তমান এমপি ধীরেন্দ্রনাথ শম্ভু এলাকায় আছেন। সাধ্যমতো ত্রাণ কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছেন। অন্যদিকে আরও ৫১ মনোনয়নপ্রত্যাশীর মধ্যে দৃশ্যমান মাঠে কাজ করছেন জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য মশিউর রহমান সিহাব। করোনার শুরু থেকে তিনি এ পর্যন্ত ৪০ হাজার মানুষকে খাদ্য সহায়তা, ইমাম ও শিক্ষকদের জন্য সহায়তা দিয়েছেন। এ ছাড়া নির্বাচনী এলাকার ৬টি স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে পিপিই, এন-নাইটি ফাইভ মাস্ক বিতরণ করেছেন। বরগুনা-২ আসনে এমপি হাচানুর রহমান রিমনের পাশাপাশি ৩২ মনোনয়নপ্রত্যাশীর মধ্যে সবচেয়ে বেশি সক্রিয় রয়েছেন জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক গোলাম সরোয়ার টুকু। একইভাবে নেত্রকোনা-১ আসনে নৌকা পেতে ২৬ জন মনোনয়নপ্রত্যাশী দলের মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করেছিলেন। হাতেগোনা দু-একজন ছাড়া সবাই গা-ঢাকা দিয়েছেন। একই অবস্থা ফরিদপুর-১ আসনে। এখানে নৌকা পেতে মনোনয়ন ফরম সংগ্রহ করেছিলেন ১৫ জন। বর্তমান এমপি ছাড়াও এখানে ব্যক্তিগত উদ্যোগে ত্রাণ বিতরণ করেছেন সাবেক এমপি ও আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য আবদুর রহমান, সাবেক এমপি কাজী সিরাজ ও ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি লিয়াকত সিকদার। আরও একজনের ত্রাণ তৎপরতার খবর পাওয়া গেছে। বাকিদের খবর নেই। শুধু একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনেই নয়, সদ্য অনুষ্ঠিত গাইবান্ধা-৩ উপনির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেতে ২৫ জন দলের মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করেছিলেন। কিন্তু সেখানে মনোনয়ন পান কৃষক লীগের সাধারণ সম্পাদক উম্মে কুলসুম স্মৃতি। করোনার সংকট শুরু হওয়ার পর থেকেই মাঠ ছাড়া অধিকাংশ মনোনয়নপ্রত্যাশী। ব্যক্তিগত ও সরকারিভাবে ত্রাণ বিতরণ করছেন উম্মে কুলসুম স্মৃতি।

দলীয় সূত্রমতে, সরাসরি সংসদ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা ছাড়াও সংরক্ষিত নারী আসনে দলের মনোনয়ন পেতে নায়িকা-গায়িকাসহ ১ হাজার ৫১০ জন নারী নেত্রী দলের মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করেছিলেন। এর মধ্যে ৪৩ জন দলের মনোনয়ন পেয়ে বর্তমানে সংসদে প্রতিনিধিত্ব করছেন। অনেকের কাজই দৃশ্যমান নয়। আর যেসব নায়িকা-গায়িকা নৌকা পেতে হুমড়ি খেয়ে পড়েছিলেন তাদের মধ্যে একজনকে কিছু ত্রাণ দিতে দেখা গেছে। তবে যারা ছাত্রলীগের বিভিন্ন রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন বা যুব মহিলা লীগের রাজনীতি করছেন তারা চরম ঝুঁকি নিয়েও এলাকায় কাজ করে যাচ্ছেন। নিজেদের সাধ্য অনুযায়ী এলাকাবাসীর পাশে থাকার চেষ্টা করছেন।

অন্যদিকে ব্যবসায়ী ও শিল্পপতি এমপি-মন্ত্রীর চেয়ে মাঠের রাজনীতিতে পোড় খাওয়ারাই এলাকায় জনগণের পাশে দাঁড়িয়েছেন। এ ছাড়া এমপি হয়ে যারা রাতারাতি টাকা বানিয়েছেন, আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ হয়েছেন, তারাও জনগণের বিপদে পাশে নেই। গা-ঢাকা দিয়েছেন স্যুটেট-বুটেট পরিহিত হঠাৎ গজিয়ে ওঠা নেতারা। যাদের দেখা মিলত সচিবালয়, রাজধানীর নামিদামি তারকা হোটেলে কিংবা বিভিন্ন সভা-সেমিনারে।

দলীয় সূত্র জানায়, মার্চ মাসে দেশে করোনাভাইরাস দেখা দেওয়ার পর থেকে সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে অসহায়-গরিব মানুষের পাশে দাঁড়াতে নির্দেশ দেন আওয়ামী লীগ সভানেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এ জন্য ওয়ার্ডভিত্তিক কমিটি গঠনের নির্দেশ দেন তিনি। করোনার শুরু থেকেই প্রায় অর্ধশত এমপি নিজ এলাকায় অবস্থান করে জনগণের পাশে দাঁড়িয়েছেন। আবার কেউ কেউ ‘সেফ আইসোলেনের নামে’ নিজেকে ঘরে বন্দী করে রেখেছেন। আবার দলীয় উপজেলা চেয়ারম্যান ও পৌর মেয়ররা কিছু কিছু এলাকায় ব্যাপকভাবে কাজ করলেও এসব জায়গায় মনোনয়নপ্রত্যাশীরা গা-ঢাকা দিয়েছেন। তাদের কেউ নির্বাচনের আগে লক্ষ-কোটি টাকা খরচ করলেও এখন লাপাত্তা।

গত রবিবার সিরাজগঞ্জের কাজীপুরে নিজস্ব অর্থায়নে ত্রাণ বিতরণকালে ভিডিও কনফারেন্সে যুক্ত হয়ে আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ও সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম বলেছেন, একটি গোষ্ঠী আছে, যারা নির্বাচন এলে অতিথি পাখির মতো এলাকায় উড়ে আসেন। নির্বাচন শেষে আবার উড়ে চলে যান। কোনো দুর্যোগে তাদের জনগণের পাশে দেখা যায় না।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর