বুধবার, ১ জুলাই, ২০২০ ০০:০০ টা

সাত জঙ্গির মৃত্যুদণ্ড চূড়ান্ত অনুমোদনের অপেক্ষায়

আতঙ্ক এখন অনলাইনের জঙ্গিরা

মির্জা মেহেদী তমাল ও আরাফাত মুন্না

সাত জঙ্গির মৃত্যুদণ্ড চূড়ান্ত অনুমোদনের অপেক্ষায়

চার বছর আগে ঈদ উৎসবের প্রস্তুতিতে থাকা ঢাকার কূটনীতিকপাড়ায় হোলি আর্টিজান বেকারিতে নজিরবিহীন সেই জঙ্গি হামলাকে টার্নিং পয়েন্ট হিসেবেই নিয়েছে সংশ্লিষ্টরা। তারা মনে করছে, হামলার ওই ঘটনা বাংলাদেশে জঙ্গিবাদ বিস্তারের ভয়াবহ চিত্র স্পষ্ট করে তোলে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীও বুঝতে পারে, এই জঙ্গিরা কী চায়? কী তাদের উদ্দেশ্য? কারা এদের আশ্রয়-প্রশ্রয়দাতা কিংবা কারা এর অর্থায়ন করছে। কেবল মাদ্রাসাপড়ুয়া গরিব ঘরের ছেলেরা জঙ্গিবাদে জড়াচ্ছে না, নামি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়া ধনী পরিবারের সন্তানরাও জড়িয়ে পড়ছে জঙ্গিবাদের ভয়ঙ্কর পথে-এ তথ্যটিও জানা যায় এ হামলার ঘটনায়।

এসব বিষয় সামনে রেখে নিরাপত্তা নিশ্চিতে নানামুখী উদ্যোগ নিতে থাকে সরকার। এই সময়ের মধ্যে র‌্যাব-পুলিশ জঙ্গিবিরোধী পাঁচ শতাধিক অভিযান চালায়। এর মধ্যে শুধু র‌্যাবের অভিযান রয়েছে ৩৯৫টি। এতে জঙ্গিদের ১৭টি আস্তানা গুঁড়িয়ে দেওয়া ছাড়াও ১ হাজার ১৬ জঙ্গিকে গ্রেফতার করা হয়। আত্মসমর্পণ করে ৭ জন। আর নিহত হয়েছে ২৫ জঙ্গি। এ ছাড়া বিপুল পরিমাণ অস্ত্র ও গোলাবারুদ উদ্ধার হয় এসব অভিযানে। এরপরও জঙ্গিবাদের ঝুঁকি থেকে বেরিয়ে আসতে পারছে না দেশ। আতঙ্ক ছড়াচ্ছে এখন নতুন জঙ্গিরা। মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক আন্তর্জাতিক জঙ্গি সংগঠন আইএসপন্থি এই জঙ্গিরা নানাভাবে তাদের কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। তাদের অনলাইন কেন্দ্রিক তৎপরতা গোয়েন্দাদের ভাবিয়ে তুলেছে।

তবে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, জঙ্গিদের ইনটেনশন থাকলেও ক্যাপাসিটি বিপর্যস্ত করে দেওয়ায় তারা কোনো ধরনের নাশকতায় সক্ষম হয়নি। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতায় জঙ্গি সংগঠনগুলোর সাংগঠনিক কাঠামো ভেঙে গেছে। নেতৃত্ব পর্যায়ে ধারাবাহিক সব নেতাই হয়তো কোনো না কোনো অভিযানে নিহত হয়েছে, নয়তো গ্রেফতার হয়ে জেলে রয়েছে। জঙ্গিদের প্রচেষ্টা থাকলেও বড় ধরনের হামলা চালানোর সক্ষমতা নেই। জঙ্গিগোষ্ঠী নিয়ন্ত্রণে রয়েছে বলে বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পক্ষ থেকে আশ্বস্ত করা হলেও অনলাইনে তৎপরতা এবং গ্রেফতার হওয়া জঙ্গিদের জবানবন্দি বিশ্লেষণ করে জানা গেছে, সবকটি জঙ্গিগোষ্ঠীরই সদস্য সংগ্রহ কার্যক্রম অব্যাহত আছে। একই সঙ্গে তাদের পুনরায় সংগঠিত হওয়া ও শক্তি সঞ্চয়ের চেষ্টাও রয়েছে।

জানা গেছে, নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন জামা’আতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশ (জেএমবি), আনসার আল ইসলাম ও আল্লাহর দলের সদস্যরা বর্তমান করোনা পরিস্থিতিকে সুযোগ হিসেবেই নিচ্ছে। বসে নেই আরেক নিষিদ্ধ সংগঠন হিযবুত তাহরীরের সদস্যরাও। তৎপরতা চালাচ্ছে ইন্টারনেটভিত্তিক বিভিন্ন অত্যাধুনিক অ্যাপসের মাধ্যমে। বিগত বছরগুলোতে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার একের পর এক অভিযানে দুর্বল হয়ে পড়া বিভিন্ন সংগঠনগুলো অস্তিত্ব রক্ষার স্বার্থে একটি প্লাটফর্মে আসারও চেষ্টা চালাচ্ছে। সম্প্রতি এসব সংগঠনের ১৭ জন সদস্য গ্রেফতারের পর তাদের কাছ থেকে এমনই তথ্য আদায় করেছেন আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যরা।

র‌্যাবের অতিরিক্ত মহাপরিচালক কর্নেল মোস্তফা সারোয়ার বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, জঙ্গি সংগঠনগুলো আগের তুলনায় এখন অনেক দুর্বল হয়ে পড়েছে। তবে তাদের কার্যক্রম বন্ধ হয়নি। এ ছাড়া বহুদিন ধরেই জেএমবি, আল্লাহর দল ও আনসার আল ইসলাম এক প্লাটফর্মে আসার চেষ্টা করে যাচ্ছে। তবে নানা ধরনের মতবিরোধের কারণে এখনো তারা সেটি করতে পারেনি।

সাত জঙ্গির মৃত্যুদন্ড

হোলি আর্টিজান বেকারিতে হামলা মামলায় গত বছর ২৭ নভেম্বর সাত জঙ্গিকে মৃত্যুদন্ড দেয় বিচারিক আদালত। এখন এই সাত জঙ্গির মৃত্যুদন্ডে হাই কোর্টের চূড়ান্ত অনুমোদনের অপেক্ষায়। ফৌজদারি কার্যবিধির ৩৭৪ ধারা অনুযায়ী বিচারিক আদালতের রায়ে আসামির মৃত্যুদন্ড হলে, সেই মৃত্যুদন্ড কার্যকরের জন্য উচ্চ আদালতের অনুমোদনের প্রয়োজন হয়। রায়ের এক সপ্তাহের মধ্যে তা উচ্চ আদালতে পাঠানোর বাধ্যবাধকতা থাকে।

সুপ্রিম কোর্টের মুখপাত্র ও স্পেশাল অফিসার মোহাম্মদ সাইফুর রহমান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, বিচারিক আদালত থেকে ডেথ রেফারেন্স হিসেবে নথিপত্র হাই কোর্টে আসার পর প্রধান বিচারপতির অনুমোদন নিয়ে পেপারবুক (রায়সহ মামলার সব নথি সংবলিত বই) তৈরির জন্য বিজি প্রেসে পাঠানো হয়েছে। বিজি প্রেস থেকে জানানো হয়েছে কাজ শেষ পর্যায়ে। তিনি বলেন, পেপারবুক প্রস্তুত হলেই প্রধান বিচারপতির দৃষ্টি আকর্ষণ করা হবে। পরে শুনানির জন্য বেঞ্চ নির্ধারণ করে দেবেন প্রধান বিচারপতি।

এ বিষয়ে রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা মাহবুবে আলম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, বর্তমানে করোনাভাইরাসের কারণে আদালতের নিয়মিত কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে এবং আদালতের নিয়মিত কার্যক্রম শুরু হলে আমরা গুরুত্বপূর্ণ এ মামলার ডেথ রেফারেন্স অগ্রাধিকার ভিত্তিতে শুনানির জন্য আবেদন জানাব।

ঢাকার সন্ত্রাসবিরোধী বিশেষ ট্রাইব্যুনালের বিচারক মজিবুর রহমান গত ২৭ নভেম্বর আলোচিত এ মামলার রায় ঘোষণা করেন। নব্য জেএমবির সাত সদস্যকে সন্ত্রাসবিরোধী আইনের ৬(২)(অ) ধারায় দোষী সাব্যস্ত করে সর্বোচ্চ সাজা মৃত্যুদন্ডের পাশাপাশি ৫০ হাজার টাকা করে অর্থদন্ড দেওয়া হয় রায়ে। আরও দুটি ধারায় তাদের কয়েকজনকে দেওয়া হয় বিভিন্ন মেয়াদের কারাদন্ড। মৃত্যুদন্ডাদেশপ্রাপ্তরা হলেন- জাহাঙ্গীর হোসেন ওরফে রাজীব গান্ধী, আসলাম হোসেন ওরফে র‌্যাশ, হাদিসুর রহমান, রাকিবুল হাসান রিগ্যান, আবদুস সবুর খান, শরিফুল ইসলাম ওরফে খালেদ ও মামুনুর রশিদ রিপন।

মৃত্যু নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত ফাঁসিতে ঝুলিয়ে তাদের মৃত্যুদন্ড কার্যকর করার আদেশ দিয়ে বিচারক তার রায়ে বলেন, হোলি আর্টিজান বেকারিতে হামলার মধ্য দিয়ে আসামিরা ‘জঙ্গিবাদের উন্মত্ততা, নিষ্ঠুরতা ও নৃশংসতার জঘন্য বহিঃপ্রকাশ’ ঘটিয়েছে। সাজার ক্ষেত্রে তারা কোনো অনুকম্পা বা সহানুভূতি পেতে পারে না। অপরাধে সংশ্লিষ্টতা প্রমাণিত না হওয়ায় এ মামলায় বিচারের মুখোমুখি করা আসামি মিজানুর রহমান ওরফে বড় মিজানকে খালাস দেওয়া হয়েছে রায়ে।

২০১৬ সালের ১ জুলাই রাতে পাঁচ জঙ্গি গুলশান-২-এর ৭৯ নম্বর সড়কে  হোলি আর্টিজান বেকারিতে হামলা চালায়। তারা দেশি-বিদেশি ২০ জনকে গুলি করে ও কুপিয়ে হত্যা করে। পরদিন সকালে কমান্ডো অভিযানে পাঁচ জঙ্গিসহ ছয়জন নিহত হয়। আগের দিন হামলা প্রতিরোধ করতে গিয়ে পুলিশের এএসপি রবিউল করিম ও বনানী থানার ওসি সালাউদ্দিন আহম্মেদ নিহত হন। দুই বছর ২২ দিন পর ২০১৮ সালের ২৪ জুলাই ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতে চার্জশিট দাখিল করে সিটিটিসি।

সর্বশেষ খবর