র্যাব অফিসে বসে র্যাব কর্মকর্তাদেরই হুমকি দিলেন প্রতারক সাহেদ। তিনি বললেন, ‘আমার সঙ্গে আপনাদের আবারও দেখা হবে। হয়তো ছয় মাস পর দেখা হয়ে যেতে পারে। আপনাদের প্রমোশন পোস্টিং যাই হোক না কেন, আমি কিন্তু দেখা করব। কথাটা মনে রাখবেন।’ গ্রেফতারের পরও সাহেদের এমন দাম্ভিকতায় হতবাক র্যাব কর্মকর্তারা। সংশ্লিষ্ট সূত্র এ তথ্য দিয়ে বলেছে, ঢাকার র্যাব কার্যালয়ে প্রতারক সাহেদকে নিয়ে আসার পর কর্মকর্তারা তাকে জেরা করছিলেন। ঠিক তখনই সবাইকে অবাক করে দিয়ে র্যাব কর্মকর্তাদের উদ্দেশে এমন ঔদ্ধত্যপূর্ণ কথা বলেন। করোনাভাইরাসের নমুনা পরীক্ষা নিয়ে মহাজালিয়াতিসহ বিভিন্ন অপকর্মের হোতা রিজেন্ট হাসপাতালের মালিক মো. সাহেদ ওরফে সাহেদ করিমকে গতকাল গ্রেফতার করা হয়। চুলে কালো রং লাগিয়ে, গোফ কেটে নিজেকে পাল্টে ফেলেন সাহেদ। বোরকা পরে একটি নৌকায় করে ইছামতী নদী দিয়ে পালাচ্ছিলেন। ভোর সাড়ে ৫টায় সাতক্ষীরার দেবহাটা সীমান্তবর্তী এলাকা থেকে তাকে গ্রেফতার করে র্যাব। পরে সকাল সাড়ে ৮টার দিকে র্যাবের হেলিকপ্টারযোগে ঢাকায় আনা হয়। এরপর সাহেদকে নিয়ে উত্তরা ১১ নম্বর সেক্টরের ২০ নম্বর সড়কের ৬২ নম্বর বাড়িতে তার ব্যক্তিগত অফিসে অভিযান চালায়। সেখান থেকে উদ্ধার করা হয় এক লাখ ৪৬ হাজার জাল টাকা। এই জাল টাকায় তিনি ঋণ শোধ করতেন। বিকাল সাড়ে ৪টার দিকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চেকআপ শেষে তাকে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হয়। এর আগে বিকাল ৩টার দিকে র্যাব সদর দফতরে আনুষ্ঠানিক সংবাদ সম্মেলনে র্যাব মহাপরিচালক চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুন বলেন, রিজেন্ট হাসপাতালে অভিযানের পর থেকে আমরা সাহেদকে খুঁজছিলাম। তাকে গ্রেফতারের জন্য দেশের বিভিন্ন এলাকায় গোয়েন্দা কার্যক্রম অব্যাহত ছিল। মঙ্গলবার গাজীপুরের কাপাসিয়া থেকে রিজেন্ট গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাসুদ পারভেজকে গ্রেফতারের পর তার দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে সাহেদকে তার পৈতৃক জেলা সাতক্ষীরার দেবহাটা থেকে গ্রেফতার করা হয়। সে দেবহাটা সীমান্ত দিয়ে নৌকায় করে ভারতে যাওয়ার প্রস্তুতি নিয়েছিল।
ফেরার সাহেদের কয়েকদিন : র্যাব সূত্র বলছে, রিজেন্ট হাসপাতালে অভিযানের রাতেই বিভিন্ন প্রভাবশালী ব্যক্তির কাছ থেকে ইতিবাচক সাড়া না পেয়ে আত্মগোপনে চলে যান সাহেদ। ৭ জুন দিবাগত রাতে তিনি তার ব্যক্তিগত গাড়িতে করে নরসিংদীর মাধবদীতে চলে যান। সেখানে তার এক অফিস স্টাফের বাসায় কিছু সময় অবস্থান করেন। গোসল এবং খাওয়া-দাওয়া সেরে তিনি বাসা থেকে বিদায় নেন। ৮ জুন সারা দিন তিনি নরসিংদীর বিভিন্ন এলাকায় অবস্থান করেন। সেখান থেকে তিনি ফোন করেন রিজেন্টের এমডি মাসুদকে। তার মাধ্যমে ডেকে নেন মাসুদের ভায়রা গিয়াসকে। ৮ জুন রাতে তিনি আবার ঢাকায় ফেরেন। ৯ জুন তিনি গিয়াসের গাড়িতে করে কক্সবাজারের মহেশখালীতে চলে যান। সেখানে তার কয়েকটি সাইক্লোন সেন্টার রয়েছে। ১১ জুন তিনি পুনরায় মহেশখালী থেকে সাতক্ষীরার উদ্দেশ্যে রওনা করেন। মহাখালী পর্যন্ত ভাড়া করা গাড়িতে করে কুমিল্লা পর্যন্ত আসেন। কুমিল্লা থেকে প্রাণ-আরএফএলের ট্রাকে করে পোশাক পাল্টে ঢাকায় আসেন। সেখান থেকে একটি প্রাইভেটকারে মানিকগঞ্জ পর্যন্ত যান। পুনরায় গাড়ি পরিবর্তন করে সাতক্ষীরা চলে যান। ১২ জুন থেকে তিনি সাতক্ষীরায় তার অনেক স্বজনের বাড়িতে অবস্থান করেছেন। তবে কেউই তাকে বেশি সময় অবস্থান করতে দেননি। সাতক্ষীরায় অবস্থান করে ব্যক্তিগত উদ্যোগেই তিনি দেবহাটার সীমান্তবর্তী কোমরপুর গ্রামের বাচ্চু মাঝির সঙ্গে যোগাযোগ করেন। বাচ্চু মাঝিরই নৌকায় করে লবঙ্গবতী নদীর ইছামতী খাল দিয়ে ভারত সীমান্তে পার করে দেওয়ার কথা ছিল। সীমান্ত পার হওয়ার আগেই তিনি লবঙ্গবতী নদীতে ধরা পড়ে যান র্যাবের কাছে।
সাহেদ গত এক সপ্তাহে বিভিন্ন স্থানে লুকিয়ে ছিলেন বলে জানান র্যাব মহাপরিচালক। বিশাল দেহের সাহেদ কাঁচাপাকা চুল আর বড় গোঁফ নিয়ে বিভিন্ন টেলিভিশনে আলোচনা অনুষ্ঠানে হাজির হলেও গ্রেফতারের সময় তার চেহারায় ভিন্নতা দেখা যায়। তবে গ্রেফতার এড়াতে তিনি তার চুলে কলপ দিয়েছিলেন। একই সঙ্গে সীমান্ত পাড়ি দিতে সাহেদ বোরকা পরেছিলেন। তবে নিরাপত্তার স্বার্থে তিনি সঙ্গে একটি পিস্তল ও তিন রাউন্ড গুলি রেখেছিলেন বলে জানিয়েছে র্যাব। র্যাব প্রধান চৌধুরী মামুন বলেন, জিজ্ঞাসাবাদে তিনি বলেছেন, ঢাকাসহ কক্সবাজার, কুমিল্লা, সাতক্ষীরার বিভিন্ন অঞ্চলে আত্মগোপন করেছিলেন। বিভিন্নভাবে যানবাহন ব্যবহার করেছেন। কখনো হেঁটে, কখনো ট্রাকে, কখনোবা ব্যক্তিগত গাড়িতে করে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে গেছেন।
পলাতক অবস্থায় সাহেদ কোনো প্রভাবশালী ব্যক্তির আশ্রয়ে ছিলেন কি না- সংবাদ সম্মেলনে এমন প্রশ্নের জবাবে র্যাবের মহাপরিচালক বলেন, তাকে কেবল গ্রেফতার করা হয়েছে। তার সঙ্গে কথা বললে আরও বিস্তারিত জানা যাবে। সাহেদ গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের সঙ্গে ছবি তুলে তা প্রতারণার কাজে ব্যবহার করতেন। তিনি কখনো নিজেকে অবসরপ্রাপ্ত বা কখনো চাকরিরত সেনা কর্মকর্তা, কখনো মিডিয়া ব্যক্তিত্ব, কখনো উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা পরিচয় দিতেন বলে জানতে পারি। তিনি নিজেকে ক্লিন ইমেজের ব্যক্তি হিসেবে প্রচার করার চেষ্টা করলেও প্রকৃত অর্থে তিনি একজন ধুরন্ধর লোক। দুর্নীতিসহ ক্ষমতাসীন দলের নেতা পরিচয় দিয়ে ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে নানা কাজ হাসিল করে নেওয়া মোহাম্মদ সাহেদ। এ সম্পর্কিত কোনো তথ্য পেয়েছেন কি না? এমন প্রশ্নের জবাবে র্যাব ডিজি বলেন, তিনি (সাহেদ) অনেক কিছু বলেছেন, তবে তদন্তের স্বার্থে তা বলা যাবে না। তবে রিজেন্ট হাসপাতাল থেকে কভিড-১৯ এর প্রায় ১০ হাজার নমুনা পরীক্ষা করে ছয় হাজারের মতো ভুয়া রিপোর্ট দেওয়া হয় বলে প্রাথমিক তদন্তে তারা জানতে পেরেছেন। এ ছাড়া সাহেদ একদিকে রোগীর কাছ থেকে টাকা নিয়েছেন, অন্যদিকে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে টাকা চেয়ে বিল জমা দিয়েছেন। এ ছাড়াও সাহেদের বিরুদ্ধে আরও প্রতারণার খোঁজ বেরিয়ে আসছে এখন। রিকশাচালক, বালু ব্যবসায়ীদের সঙ্গে ব্যবসার নামে প্রতারণা ছাড়াও এমএলএম ব্যবসার নামে কোটি কোটি হাতিয়ে নেওয়ার খবরও মিলছে। সাহেদের বিরুদ্ধে কতগুলো মামলা পেয়েছেন? জবাবে চৌধুরী মামুন সুনির্দিষ্ট করে বলতে পারেননি। তবে তিনি বলেন, ৫০টির অধিক মামলা আছে, এরকম শোনা গেছে। আমরা যাচাই করে দেখছি। মামলার তদন্তভার র্যাবের কাছে রাখতে কোনো বিব্রতবোধ করছেন কি না? এমন প্রশ্নের জবাবে র্যাব প্রধান চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুন বলেন, আমরা বিব্রতবোধ করলে প্রতারণার অভিযোগে সাহেদ করিমকে গ্রেফতার করে আনতাম না। এতেই বোঝা যায় যে বিব্রতবোধ করার কোনো প্রশ্নই আসে না। এই মামলার তদন্তভার গ্রহণের জন্য যে প্রক্রিয়া আছে সেটি মেনেই আমরা কার্যক্রম গ্রহণ করব।
র্যাবের গোয়েন্দা শাখার পরিচালক সারওয়ার বিন কাশেম বলেন, গ্রেফতার এড়াতে সাহেদ চুলে কলপ করিয়েছিলেন এবং গোঁফও ছেঁটেছিলেন। বোরকা পরিহিত অবস্থায় নৌকায় করে পাশের দেশে পালিয়ে যাওয়ার সময় তাকে গ্রেফতার করা হয়। চেহারা পরিবর্তন করার জন্য তিনি তার চুলও কালো করে ফেলেছিলেন।
প্রসঙ্গত, গত ৬ জুলাই সকালে রাজধানীর উত্তরার রিজেন্ট হাসপাতালে অভিযান শুরু করে র্যাব। অভিযানে করোনার নমুনা সংগ্রহ করে তা টেস্ট না করে ফলাফল প্রদান, হাসপাতালের লাইসেন্স না থাকাসহ বিভিন্ন অভিযোগ পায় এলিট ফোর্সটি। এর এক দিন পর হাসপাতালটির উত্তরা ও মিরপুর শাখা সিলগালা করে দেওয়া হয়। এরপর থেকেই আত্মগোপনে ছিলেন রিজেন্ট চেয়ারম্যান।