শিরোনাম
বুধবার, ১৯ আগস্ট, ২০২০ ০০:০০ টা
পর্যবেক্ষণ

চীন-পাকিস্তানের অমার্জনীয় ধৃষ্টতা

বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক

চীন-পাকিস্তানের অমার্জনীয় ধৃষ্টতা

‘দেশ রূপান্তর’ পত্রিকায় ১৪ আগস্ট প্রকাশিত একটি খবর দেখে একদিকে বিস্মিত এবং অন্যদিকে গুরুতর ক্রোধান্বিত হয়েছি। খবরটি এই যে, ঢাকাস্থ চীনা দূতাবাস খালেদা জিয়ার জন্য উপহারসামগ্রী পাঠিয়েছে, চীনা দূতাবাসের ভাষায়- ‘১৫ আগস্ট খালেদা জিয়ার জন্ম দিবস উপলক্ষে’। যে কোনো দূতাবাস তাদের পছন্দের লোকের জন্য উপহার পাঠাতেই পারে। এটি তাদের অধিকার। কিন্তু তারা যে দেশে অবস্থিত সে দেশের অভ্যন্তরীণ কোনো বিষয়ে বা বিতর্কে জড়িত হতে পারে না। ১৫ আগস্ট আসলে খালেদা জিয়ার জন্ম দিবস কিনা সে প্রশ্নে প্রচুর বিতর্ক রয়েছে। এটি আদৌ তার জন্ম দিবস নয়, তিনি রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে জাতির পিতার শহীদ দিবসকে তার জন্ম দিবস হিসেবে প্রচার করেছেন বলেই এ দেশের মানুষ জানেন। এমনকি বিএনপির লোকেরাও মনে করেন ১৫ আগস্ট খালেদা জিয়ার জন্ম দিবস নয়। বিএনপির ঊর্ধ্বতন নেতা ব্যারিস্টার মওদুদও দিনটিকে খালেদা জিয়ার ‘তথাকথিত জন্মদিন’ হিসেবে উল্লেখ করে সবাইকে পরিষ্কার বুঝিয়ে দিয়েছেন যে, এটি খালেদা জিয়ার নতুন আবিষ্কৃত কাহিনি, এটি আসলে তার জন্মদিন নয়। নব্বইয়ের দশকে খালেদা জিয়া হঠাৎ করে জানালেন ১৫ আগস্ট তার জন্মদিন। এর আগে তিনি আরও তিনটি জন্মদিন ব্যবহার করেছেন যথা তার স্কুল রেজিস্ট্রিকৃত, তার বিয়ের কাবিনে এবং তার নির্বাচনী দরখাস্তে। প্রশ্নটি আদালত পর্যন্ত গড়িয়েছে। এ মামলা আমার বেঞ্চেও এসেছিল, কিন্তু বিএনপির আপত্তির কারণে আমি শুনানি করতে পারিনি, তবে আমার নেতৃত্বাধীন বেঞ্চ থেকে সরিয়ে নেওয়ার আগে, অর্থাৎ প্রথম দিনের শুনানির সময়ই আমি ফাইলের সব দলিল থেকে জানতে পেরেছি যে, ইতিপূর্বে তিনি আরও তিনটি জন্মদিন ব্যবহার করতেন, যেখানে ১৫ আগস্ট তার জন্মদিন বলে কোনো উল্লেখ ছিল না। বিষয়টি এখনো আদালতে অমীমাংসিত রয়েছে। খালেদা জিয়া জাতীয় শোক দিবসে তার তথাকথিত জন্মদিন পালন শুরু করলে সারা দেশে প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। আর এ প্রতিবাদ উপেক্ষা করে চীনা দূতাবাস খালেদার দাবির পক্ষে অবস্থান নিয়ে আমাদের দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে নাক গলাচ্ছে। এমন অবস্থায় চীনা দূতাবাস ১৫ আগস্ট খালেদা জিয়ার জন্ম দিবস বলে মেনে নিয়ে সেদিন তার জন্য উপহার পাঠিয়ে আমাদের দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ করেছে, একটি বিচারাধীন বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিয়ে আমাদের বিচারব্যবস্থায় হস্তক্ষেপ করেছে। তার চেয়েও বড় কথা, আমাদের জাতীয় শোক দিবসকেও প্রশ্নবিদ্ধ করার চেষ্টা করেছে। দিনটি বাঙালি জাতির কাছে অতীব তাৎপর্যপূর্ণ। ১৯৭৫-এর এদিন পাকিস্তানে বিশ্বাসী এবং বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বিরোধীরা দেশকে আবার পাকিস্তানের অংশে পরিণত করার জন্য জাতির জনককে হত্যা করেছিল, আর খালেদা জিয়া সেই তাৎপর্যকে নস্যাৎ করার চেষ্টায় ১৫ আগস্ট তার জন্মদিন বলে একটি প্রতারণামূলক ঘোষণা দেন, আর চীনা দূতাবাস খালেদা জিয়ার প্রতারণাকে সত্য মেনে নিয়ে জাতির জনকের প্রতি শ্রদ্ধাবোধকে নস্যাৎ করার চেষ্টা করেছে, যেটি কোনো দূতাবাস করতে পারে না। আমরা জানি, চীন বঙ্গবন্ধুর নির্মম হত্যার আগে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়নি, দিয়েছিল বঙ্গবন্ধু হত্যার ১৬ দিনের মাথায় পাকিস্তানের কথায়। আমরা জানি, চীন আমাদের মুক্তিযুদ্ধে সরাসরি আমাদের বিপক্ষে ছিল। এখন বুঝতে পারছি চীন তার আগের অবস্থানেই রয়েছে।

গত সপ্তাহে ঢাকাস্থ পাকিস্তান হাইকমিশন প্রকাশিত একটি সংবাদ বিজ্ঞপ্তি আমাদের নজরে এসেছে; যে সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে পাকিস্তান হাইকমিশন ভারতের বিরুদ্ধে অনেক কথা লিখেছে। পাকিস্তান তার নিজের দেশ থেকে যা ইচ্ছা লিখতে পারে কিন্তু অন্য একটি সার্বভৌম রাষ্ট্রে বসে আর একটি রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে কিছু লেখা সোজা কথায় কূটনৈতিক সুবিধাদির নির্লজ্জ এবং অগ্রহণযোগ্য লঙ্ঘন। ঢাকাস্থ পাকিস্তান হাইকমিশনের এ ধরনের ধৃষ্টতাপূর্ণ খেলাপ এই প্রথম নয়। অতীতে এক সাবেক উপহাইকমিশনার আমাদের মুক্তিযুদ্ধকে কটাক্ষ করে বক্তব্য দেওয়ার পর তাকে বাংলাদেশ থেকে বের হয়ে যেতে বাধ্য করা হয়েছিল। আরেক ঘটনায় হাইকমিশনের এক কর্মকর্তা জঙ্গি এবং মুক্তিযুদ্ধবিরোধীদের সঙ্গে হাইকমিশন ভবনেই বৈঠক করলে তা আমাদের গোয়েন্দাদের নজরে এলে সেই কূটনীতিককেও বাংলাদেশ ত্যাগ করতে হয়েছিল। আরেক কূটনীতিক বহু নকল ভারতীয় মুদ্রা সংগ্রহ করে রেখে সেগুলো ভারতে পাঠাতেন ভারতের অর্থনীতিতে অস্থিরতা সৃষ্টির জন্য। পাকিস্তান হাইকমিশন ২০০০ সালে পাকিস্তান গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআইয়ের নির্দেশে বিএনপি-জামায়াতকে নির্বাচনে খরচ করার জন্য প্রচুর অর্থ দিয়েছিল ঢাকাস্থ হাইকমিশনের মাধ্যমে, যা আইএসআই-প্রধান পাকিস্তানি আদালতেই স্বীকার করেছেন। ১৯৬১ সালে কূটনৈতিক সুবিধাদি দেওয়ার জন্য ভিয়েনায় যে কনভেনশন স্বাক্ষরিত হয় তার বহু আগে থেকেই কাস্টমারি আন্তর্জাতিক আইনে এসব সুযোগ-সুবিধার কথা ছিল। একটি দূতাবাস কী করতে পারে তার তালিকা রয়েছে কনভেনশনের তৃতীয় অনুচ্ছেদে। এ তালিকার বাইরে যাওয়ার কোনো সুযোগ কোনো দূতাবাসের নেই। এ ছাড়া, কনভেনশনের ৪১ অধ্যায়ে স্পষ্ট করে বলা আছে- কোনো কূটনীতিক স্বাগতিক দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করতে পারবে না। ইউএস ডিপ্লোম্যাটিক অ্যান্ড কনসুলার স্টাফ মামলায় ১৯৭৯ সালে আন্তর্জাতিক আদালত স্বচ্ছ ভাষায় বলে দিয়েছে, কোনো দূতাবাস বা কূটনীতিক তাকে প্রদান করা কূটনৈতিক সুবিধাদির অপব্যবহার করতে পারে না। বলা হয়েছে, কূটনীতিকরা আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করতে পারেন না।

১৯৬১ সালের ভিয়েনা কনভেনশনের মুখবন্ধেও পরিষ্কার করে বলা হয়েছে দূতাবাসগুলো কী করতে পারে এবং কী করতে পারে না। যদিও ভিয়েনা কনভেনশনে দূতাবাস ও কূটনীতিকদের আবাসস্থলকে অভেদ্যস্থান বলে উল্লেখ করা হয়েছে, তবু দূতাবাস চত্বর সংশ্লিষ্ট দেশের অংশ নয় এবং সে এলাকার ওপর কূটনীতিকের দেশের কোনো বহিরাষ্ট্রীয় ক্ষমতা থাকে না (অধ্যাপক ব্রাউনলি)। চীন নিশ্চিতভাবে একটি সম্পদশালী পুঁজিবাদী দেশ, যদিও নামে কমিউনিস্ট, কিন্তু তার অর্থ এই নয় যে, সে আমাদের ওপর ছড়ি ঘোরাবে। আমরা শ্রীলঙ্কা নই যে, চীন আমাদের এলাকা নিয়ে নেবে, আমরা জিবুতি বা পাকিস্তান নই যে, আমাদের রাষ্ট্রসীমায় তারা ঘাঁটি বানাবে। পাকিস্তানকে মনে রাখতে হবে, আমরা সে দেশের অংশ নই। আমাদের দেশে তাদের হাইকমিশনকে আমাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে বা আমাদের প্রতিবেশী দেশের বিরুদ্ধে ব্যবহার করতে দেওয়া হবে না। চীন-পাকিস্তান উভয়কেই আমাদের মর্যাদাবোধ, সার্বভৌমত্ব এবং আন্তর্জাতিক আইনকে শ্রদ্ধা করতে শিখতে হবে।

লেখক : সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি।

সর্বশেষ খবর