বুধবার, ২ সেপ্টেম্বর, ২০২০ ০০:০০ টা

জাল-জালিয়াতি কমছে না

তথ্য গোপন করে জামিন নিলেন হত্যা মামলার আসামি

আরাফাত মুন্না

আবারও তথ্য গোপন করে হাই কোর্ট থেকে জামিন নেওয়ার ঘটনা ঘটেছে। খুলনার একটি হত্যা মামলার আসামি খবির মোল্লা তথ্য গোপনের মাধ্যমে জামিন নিয়ে এরই মধ্যে কারাগার থেকে বেরিয়েও গেছেন। গত ১৮ আগস্ট হাই কোর্টের একটি বেঞ্চ তাকে জামিন দেয়। তবে একই হাই কোর্টের অন্য বেঞ্চের দেওয়া জামিন আদেশ, সে আদেশের ওপর আপিল বিভাগের স্থগিতাদেশ ও হাই কোর্ট থেকে আবেদনটি নন প্রসিকিউশন করে নিয়ে যাওয়ার সব তথ্যই গোপন করা হয়েছে আবেদনে।

চলতি বছর ১৮ মে তথ্য গোপন ও সৃজনকৃত নথি দাখিল করে জামিন নেওয়ার আরেকটি ঘটনা ঘটেছিল। বিষয়টি অবগত হওয়ার পর ওই আদেশ প্রত্যাহার করেছিল সংশ্লিষ্ট হাই কোর্ট বেঞ্চ। এর আগে খোদ সুপ্রিম কোর্টেই ভুয়া জামিন আদেশ তৈরির নজির রয়েছে।

আইন বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, যে কোনো আবেদনের ক্ষেত্রে যদি পেছনে ঘটনা থাকে তার সব তথ্যই বাধ্যতামূলকভাবে উল্লেখ করতে হয়। এ ক্ষেত্রে যদি আইনজীবী জেনে শুনে তথ্য গোপন করেন, তাহলে তিনি পেশাগত অসদাচরণ করেছেন। আর যদি না জানেন, তাহলে এর দায় তদবিরকারকের ওপর বর্তাবে। নথিসূত্রে জানা গেছে, নড়াইলের কালিয়া উপজেলার হামিদপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নাহিদ হোসেনকে ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট রাতে তার খুলনার বাগানবাড়িতে গুলি করে হত্যা করা হয়। এ ঘটনায় তার স্ত্রী বর্তমান চেয়ারম্যান পলি বেগম বাদী হয়ে খুলনার দিঘলিয়া থানায় পাঁচজনকে আসামি করে হত্যা মামলা দায়ের করেন। এ মামলার ২ নম্বর আসামি খবির মোল্লা গত বছর ২৮ অক্টোবর হাই কোর্ট থেকে জামিন নেন। ওই আদেশের অন্তর্বর্তীকালীন জামিন দেওয়ার পাশাপাশি তাকে কেন স্থায়ী জামিন দেওয়া হবে না, তা জানতে চেয়ে রুলও জারি করা হয়েছিল। এ আদেশের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষ আপিল বিভাগে চেম্বার জজ আদালতে গেলে গত বছর ৩ নভেম্বর হাই কোর্টের আদেশটি স্থগিত হয়। এরপর প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন নেতৃত্বাধীন চার বিচারপতির আপিল বেঞ্চেও হাই কোর্টের আদেশের ওপর স্থগিতাদেশ আসে। একই সঙ্গে হাই কোর্টের জারি করা রুল নিষ্পত্তি করতেও আদেশ দেয় আপিল বিভাগ।

সূত্র জানান, জামিন আবেদনকারী পক্ষ হাই কোর্টে রুল শুনানি না করে মামলাটি নন প্রসিকিউশন করে নেন। এরপর চলতি বছর জুলাইয়ে ভার্চুয়াল আদালতে নতুন করে জামিন আবেদন করেন। এ আবেদনের ওপর শুনানি শেষে ২৮ জুলাই খুলনার জেলা ও দায়রা জজ মশিউর রহমান চৌধুরী খবির মোল্লার জামিন আবেদন নামঞ্জুর করে। পরে বিচারিক আদালতের এ আদেশের বিরুদ্ধে হাই কোর্টে আবেদন করেন খবির মোল্লা। ১৮ আগস্ট বিচারপতি এ কে এম আসাদুজ্জামান ও বিচারপতি কাজী মো. ইজারুল হক আকন্দের সমন্বয়ে গঠিত হাই কোর্ট বেঞ্চ খবির মোল্লাকে ছয় মাসের অন্তর্বর্তীকালীন জামিন দেওয়ার পাশাপাশি রুলও জারি করেছে। তবে এ আবেদনে আগে হাই কোর্টের অন্য বেঞ্চের জামিন আদেশ, আপিল বিভাগের স্থগিতাদেশ এবং রুল শুনানি না করে নন প্রসিকিউশন করে নিয়ে যাওয়ার তথ্য উল্লেখ করা হয়নি। এ বিষয়ে জানতে চাইলে হাই কোর্টে সর্বশেষ জামিন আবেদনে খবির মোল্লার আইনজীবী মো. আবু জাফর শেখ মানিক বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘আসামির পক্ষ থেকে আমার সঙ্গে যিনি যোগাযোগ করেছেন, তিনি আমাকে কিছুই জানাননি। এ ছাড়া বিচারিক আদালতের আদেশের এমন কোনো ঘটনা উল্লেখ নেই।’ সাধারণত বিচারিক আদালতের আদেশে সব ঘটনা উল্লেখ থাকে বলে জানান এই আইনজীবী। জানতে চাইলে সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি এ এম আমিন উদ্দিন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘যে কোনো মামলায় কোনো আবেদন করতে হলে ওই মামলাসংক্রান্ত সব তথ্য নতুন আবেদনে উল্লেখ করা বাধ্যতামূলক। এখানে সংশ্লিষ্ট আইনজীবী যদি জেনে বুঝে এমন কাজ করে থাকেন, তাহলে সেটা তার পেশাগত অসদাচরণ হবে।’ এ বিষয়ে জানতে চাইলে ফৌজদারি আইন বিশেষজ্ঞ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী খুরশীদ আলম খান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘জামিন আবেদনে তথ্য গোপনের ঘটনা দুঃখজনক। এটা আইনজীবীদের দেখার দরকার।’ তিনি বলেন, ‘একই মামলায় যদি আপিল বিভাগ স্থগিতাদেশ দিয়ে থাকে, সে ক্ষেত্রে নতুন করে আবেদন করতে হলে ওই স্থগিতাদেশসহ আগের সব তথ্য উল্লেখ করতে হবে। এটা বাধ্যতামূলক।’ তিনি বলেন, ‘এই আসামির সর্বশেষ জামিন আবেদন না-মঞ্জুরের আদেশে বিচারিক আদালতের বিচারকেরও এসব তথ্য উল্লেখ করে দেওয়া প্রয়োজন ছিল।’ এমন স্পর্শকাতর ঘটনায় তথ্য গোপনের সঙ্গে যারা জড়িত তাদের বিচার হওয়া উচিত বলেও মনে করেন এই আইন বিশেষজ্ঞ। এ বিষয়ে জানতে চাইলে সংশ্লিষ্ট আদালতের রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ‘এ মামলায় যদি তথ্য গোপনের ঘটনা থেকে থাকে তাহলে আমরা ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার সঙ্গে আলোচনা করে আইনগত পদক্ষেপ গ্রহণ করব।’

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর