রবিবার, ১৮ অক্টোবর, ২০২০ ০০:০০ টা

ঢাকার উত্তরে স্বস্তি, দক্ষিণে অস্বস্তি

ঝুলন্ত তার অপসারণ নিয়ে হয়রানি, ঢাকা দক্ষিণে ৩৫-৪০ শতাংশ এলাকায় ডিশ ও ৩০ হাজার ইন্টারনেট গ্রাহক বঞ্চিত, সেবা বন্ধের কর্মসূচি প্রত্যাহার

নিজস্ব প্রতিবেদক

ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন কর্তৃপক্ষ নগরীর ঝুলন্ত তার অপসারণে অ্যাকশনে নেমেছে। এরই মধ্যে ঝুলন্ত তার কাটার কারণে ঢাকা সিটি করপোরেশন দক্ষিণের বিভিন্ন এলাকায় ডিশ সংযোগ (ক্যাবল টিভি) সেবা থেকে বঞ্চিত হয়েছেন ৩৫ থেকে ৪০ শতাংশ এলাকার মানুষ। ইন্টারনেট সেবা থেকে বঞ্চিত হয়েছেন প্রায় ৩০ হাজার মানুষ। বিকল্প ব্যবস্থা না করে দক্ষিণ সিটি করপোরেশন থেকে ঝুলন্ত তার অপসারণের কাজ বন্ধ না করায় ক্ষুব্ধ হয়ে আজ থেকে তিন ঘণ্টা সেবা বন্ধের আলটিমেটামও দিয়েছিল ক্যাবল অপারেটরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (কোয়াব) ও ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোভাইডার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (আইএসপিএবি) কর্তৃপক্ষ। অবশেষে গতকাল ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার, আইসিটি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলকসহ সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে জুম মিটিং করে সমস্যা সমাধানের আশ্বাস মেলায় কর্মসূচি প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়।

ইন্টারনেট এবং ক্যাবল ডিশ সংযোগ বন্ধ করার ঘোষণা স্থগিত করায় সাধারণ ভোক্তা থেকে শুরু করে সংশ্লিষ্ট মহলে স্বস্তি বিরাজ করছে। সরকারের উচ্চ পর্যায় থেকে যথাযথ সমাধানের আশ্বাসে এখন বেশ স্বস্তিতে আছে খোদ কোয়াব ও আইএসপিএবি। একই সঙ্গে সমাধানের উদ্যোগ গ্রহণে প্রধানমন্ত্রীসহ সংশ্লিষ্ট মহলকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন গ্রাহকরা।

ঝুলন্ত তার নিয়ে সমস্যা সমাধানে সম্প্রতি এক সংবাদ সম্মেলনে কোয়াব ও (আইএসপিএবি) কর্তৃপক্ষ ছয় দফা দাবি তুলে ধরেন। দুই সেবাপ্রতিষ্ঠানের সংশ্লিষ্টরা জানান, ঝুলন্ত তার অপসারণে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন কর্তৃপক্ষ এ দুটি প্রতিষ্ঠানকে কোনো সহযোগিতা না করলেও উত্তর সিটি করপোরেশন এ ক্ষেত্রে অনেকটা নমনীয়। তারা প্রতিষ্ঠান দুটির কারিগরি সমস্যার বিষয়টি উপলব্ধি করে ক্যাবল অপসারণে সহায়ক ভূমিকা রাখছে। দিনের গুরুত্বপূর্ণ এ তিন ঘণ্টা ডিশ ও ইন্টারনেট সেবা বন্ধ থাকলে শেয়ারবাজার, শিক্ষার্থীদের অনলাইন কার্যক্রম, ব্যাংকিং লেনদেন, এটিএম বুথ, করপোরেট হাউসসহ বিভিন্ন ব্যবসা, অফিসের গুরুত্বপূর্ণ মিটিং, অনলাইন বেচাকেনাসহ গুরুত্বপূর্ণ কাজ ক্ষতিগ্রস্ত হবে। আবার ক্যাবল সেবা বন্ধ থাকায় গ্রাহক গুরুত্বপূর্ণ সংবাদ ও অন্যান্য টিভি অনুষ্ঠান থেকে বঞ্চিত হবেন।

কোয়াব ও আইএসপিএবি নেতারা জানান, তারাও নিরাপদ ও সুন্দর ঢাকা গড়তে মাটির নিচে তার নিয়ে যেতে চান তবে এজন্য পর্যাপ্ত সময় ও বিকল্প ব্যবস্থা করতে হবে। ভূগর্ভস্থ ক্যাবল সেবা দেওয়ায় দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠান ন্যাশনওয়াইড টেলিকমিউনিকেশন ট্রান্সমিশন নেটওয়ার্ক (এনটিটিএন) কর্তৃপক্ষ বাড়ি বাড়ি সেবা দেওয়ার কথা চিন্তা করেনি। তারা ঢাকার নির্দিষ্ট কিছু এলাকা যেমন- মহাখালী ডিওএইচএস, বনানী ডিওএইচএস, নিকেতন, মতিঝিল, বারিধারায় সেবা দিচ্ছে, যা মোট ঢাকার ১-২% এলাকার মধ্যে পড়ে। গুলশান ও বনানীর মতো জায়গায়ও তারা এখনো সেবা দিতে পারেনি। তারা আরও বলেছে, উত্তরের মেয়র আমাদের সমস্যা উপলব্ধি করতে পারলেও দক্ষিণের মেয়র পারেননি। তাকে হয়তো এনটিটিএন কতৃৃপক্ষ ‘মিসগাইড’ করেছে। এমনকি উত্তর সিটি কর্তৃপক্ষ নতুন যে ড্রেনেজ লাইন করছে সেখানে এসব ক্যাবল নেওয়ার জন্য আলাদা ব্যবস্থাও করে দিচ্ছে। এনটিটিএন কর্তৃপক্ষকে জোর দিয়ে কাজ করালে রাজধানীর প্রধান সড়কগুলোয় দেড়-দুই বছরের মধ্যেই ঝুলন্ত তার মাটির নিচে নেওয়া সম্ভব হবে।

কোয়াব সভাপতি এস এম আনোয়ার পারভেজ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘আমরা এরই মধ্যে মাটির নিচ দিয়ে সেবা দেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু করেছি। আমাদের চাহিদামতো অপারেটর কোম্পানি যেখানে যেখানে সেবা দিতে পেরেছে সেখানেই আমরা মাটির নিচে তার নেওয়ার চেষ্টা করেছি। বাংলামোটর থেকে উত্তরা পর্যন্ত তার মাটির নিচে নিয়ে গিয়েছি। যেখানে যেখানে তাদের ভূগর্ভস্থ ক্যাবল আছে এবং যেখানে আমাদের যাওয়ার মতো জায়গা আছে সেখানে আমরা তাদের সেবা নিয়েছি। কিন্তু গ্রাহকের বাড়ির ভিতরে তো তারা ক্যাবল দেয়নি। তারা লাস্ট মাইল সলিউশন দেয়নি। আর এক রাতের ব্যবধানেও এর সমাধান সম্ভব নয়। যেহেতু এনটিটিএনকে লাইসেন্স দেওয়া হয়েছে এ দায়িত্বও তাদের। কিন্তু গত ১২ বছরেও তারা সেটি করেনি। উত্তর সিটি করপোরেশন আমাদের কারিগরি সমস্যাগুলো উপলব্ধি করতে পারলেও দুঃখজনক হলো, দক্ষিণ সিটি করপোরেশন কর্তৃপক্ষ তা পারেনি।’

এদিকে এনটিটিএনের অপারেটর সামিট কমিউনিকেশন ও ফাইবার অ্যাট হোম ২০০৯ সাল থেকে দেশজুড়ে ভূগর্ভস্থ লাইন সম্প্রসারণের কাজ করছে। এই এনটিটিএন অপারেটরদের ভূগর্ভস্থ লাইন দিয়ে ইন্টারনেট ও ডিশ ক্যাবল সেবা দেওয়ার কথা। তাদের মতে সুনির্দিষ্ট নীতিমালা করে তাদের দায়িত্ব দেওয়া হলে তারা তা পালন করবেন।

ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন কর্তৃপক্ষ জানান, কোনো অনুমতি না নিয়েই আইএসপিএবি ও কোয়াব কর্তৃপক্ষ ঝুঁকিপূর্ণ বৈদ্যুতিক তার মাথার ওপর ঝুলিয়ে রেখেছে। অন্যদিকে ক্যাবল ব্যবসায়ীদের ভাষ্য, কোনো সময় না দিয়েই এ তার কাটা হচ্ছে। তারা আরও জানান, ভূগর্ভস্থ ক্যাবল সেবা (এনটিটিএন) সব জায়গায় না থাকায় তাদের ঝুলন্ত তারের মাধ্যমে সেবা দিতে হচ্ছে। বিকল্প ব্যবস্থা চালু হলে সংগঠন দুটো তার নামিয়ে মাটির নিচে নিয়ে যাবে।

ঢাকা উত্তর সিটি মেয়র মো. আতিকুল ইসলাম জানান, উত্তরের পুরো এলাকার ঝুলন্ত তার আগামী এক বছরের মধ্যে অপসারণ করা হবে। আর ঢাকা দক্ষিণ সিটি মেয়র ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে দক্ষিণ সিটিকে তারের জঞ্জালমুক্ত করার ঘোষণা দিয়েছেন।

আইএসপিএবি সভাপতি আমিনুল হাকিম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘বর্তমানে ক্যাবল কাটার কারণে দক্ষিণ ঢাকার প্রায় ৩০ হাজার গ্রাহক সেবা থেকে বঞ্চিত আছেন। উত্তর ঢাকায় সমস্যা সমাধানে কাজ গোছানো হচ্ছে। উত্তরের মেয়র আমাদের সহযোগিতা করছেন। দক্ষিণে গত ৫ আগস্ট ক্যাবল কাটার পরই আমরা বিষয়টি জানতে পারি। আর উত্তর সিটি করপোরেশন গত ১ অক্টোবর তার অপসারণের কাজ শুরুর আগে আমাদের সঙ্গে এ নিয়ে বৈঠকে বসে। কিন্তু দক্ষিণের মেয়র কোনো ঘোষণা ছাড়াই তার কাটার নির্দেশ দেন। আবার উত্তরে তার কাটার আগে আমাদের কী ধরনের লজিস্টিক সাপোর্ট লাগবে তা জানতে চাওয়া হয়েছিল। তবে ১ অক্টোবর সিটি করপোরেশন নয় আমরাই নিজেদের তার কাটা শুরু করি। এতে উত্তরের ক্যাবল নিরাপদে আনতে পারলেও দক্ষিণে হঠাৎ করে যত্রতত্রভাবে ক্যাবল কাটায় তা আমাদের সংগ্রহের সুযোগও দেওয়া হয়নি। এমনকি আমরা যখন দক্ষিণের মেয়রের সঙ্গে বসেছিলাম তখন আমাদের বার্ষিক প্রতিটি কোম্পানিকে নিবন্ধন ফি বাবদ ২৫ লাখ টাকা করে দেওয়ার কথা বলা হয়েছিল, যা কোনোভাবেই সম্ভব নয়।’

ডিশ ও ইন্টারনেট সেবা বন্ধের সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার : আজ রবিবার থেকে প্রতিদিন ৩ ঘণ্টা করে ইন্টারনেট ও ক্যাবল টিভি (ডিশ) সংযোগ বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করা হয়েছে। গতকাল সন্ধ্যায় ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোভাইডার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (আইএসপিএবি) এবং ক্যাবল অপারেটর অব বাংলাদেশ (কোয়াব) আয়োজিত এক জুম মিটিংয়ের পর এ ঘোষণা দেওয়া হয়। এতে জুম মিটিংয়ে ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার, আইসিটি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক, ডাক ও টেলিযোগাযোগ সচিব মো. আফজাল হোসেন ছাড়াও কোয়াব এবং আইএসপিএবি নেতারা যুক্ত ছিলেন।

 

পরে কোয়াবের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি এস এম আনোয়ার পারভেজ, আইএসপিএবি সভাপতি আমিনুল হাকিম ও মহাসচিব ইমদাদুল হক গণমাধ্যমকে বলেন, ‘আগামীকাল থেকে আমাদের প্রতীকী ধর্মঘট স্থগিত করছি। আগামীকাল সকাল সাড়ে ১০টায় ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন কার্যালয়ে বৈঠক হবে। ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার আমাদের আশ্বাস দিয়েছেন তিনি আমাদের সংকট নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনা করবেন। এখন সে বৈঠকের জন্য দুই, তিন বা চার দিন যতই সময় লাগুক আমরা অপেক্ষা করব। আশা করছি, এ সপ্তাহের মধ্যেই আমরা ফলপ্রসূ সমাধান পাব।’ পরে মন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার বলেন, ‘আমি বলেছি, প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে আমরা যত দ্রুত পারি সিদ্ধান্ত নেব। এখন তিনি কবে আমাদের সঙ্গে মিটিংয়ে বসেন, আমি এখনই তা বলতে পারব না।’

সর্বশেষ খবর