বৃহস্পতিবার, ৮ এপ্রিল, ২০২১ ০০:০০ টা

করোনায় কাবু বিএনপি

দলটির দাবি মৃত্যু সাড়ে চার শ, আক্রান্ত শতাধিক, সাংগঠনিক কর্মকাণ্ড স্থগিত

মাহমুদ আজহার

করোনায় কাবু বিএনপি

‘প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসে আমাদের অনেক ক্ষতি হয়ে গেল। অনেক গুরুত্বপূর্ণ নেতা প্রাণ হারিয়েছেন। সব মিলিয়ে সর্বনাশা করোনায় মৃত্যুর মিছিলে আমাদের প্রায় সাড়ে চার শ নেতা-কর্মী রয়েছেন। তাদের রাজনৈতিক শূন্যস্থান পূরণ করা যাবে না। আপনজনকে হারিয়ে পরিবারগুলোও আজ দিশাহারা। অনেকের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি চলে গেছেন। এ ছাড়া আক্রান্তও হয়েছেন অনেক সিনিয়র নেতা। শতাধিক নেতা-কর্মীর আক্রান্ত হওয়ার খবর আমরা পেয়েছি। আমরা তাদের দ্রুত সুস্থতা কামনা করছি। সামগ্রিকভাবে পরিবারের পাশাপাশি করোনায় বিএনপিকেও অনেক ক্ষতি করে দিল। এটা কাটিয়ে ওঠা কঠিন।’ গতকাল সন্ধ্যায় কথাগুলো অনেক কষ্টের সঙ্গেই বললেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। তিনি শঙ্কিত গলায় আরও বলেন, ‘সর্বনাশা করোনা আরও কত প্রাণ কেড়ে নেবে তা বুঝতে পারছি না!’ দলীয় সূত্রমতে, সরকারের নির্বাহী আদেশে সাময়িক মুক্তি পাওয়া বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া গুলশানের বাসভবন থেকে সর্বস্তরের নেতা-কর্মীদের কাছে বার্তা পাঠিয়েছেন, সবাইকে পুরোপুরি স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে। আপাতত কোনো সভা-সমাবেশ নয়। লন্ডনে থাকা বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানও দলের নেতাদের সঙ্গে ফোনালাপে সবাইকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার দিকনির্দেশনা দিয়েছেন। স্থায়ী কমিটির সঙ্গে ভার্চুয়াল সভা করে তিনি দলের সাংগঠনিক ও রাজনৈতিক কর্মকান্ড সাময়িকভাবে স্থগিত রেখেছেন। মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরও তৃণমূলের নেতা-কর্মীদের সঙ্গে ফোনালাপে করোনায় সতর্কভাবে চলাফেরা করার দিকনির্দেশনা দিয়েছেন।

বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের দফতর শাখা সূত্রে জানা যায়, তিনজন সহ-দফতর সম্পাদক তাইফুল ইসলাম টিপু, বেলাল আহমেদ ও মুনির হোসেন কেন্দ্রীয় ও তৃণমূল পর্যায়ের নেতা-কর্মীদের মধ্যে  করোনাভাইরাসে আক্রান্ত এবং মারা যাওয়া নেতাদের তালিকা নিয়ে কাজ করছেন। তারা হাইকমান্ডের বার্তা তৃণমূলের নেতাদের কাছে পৌঁছে দিচ্ছেন। জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের নেতাদের সঙ্গে কথা বলে করোনায় আক্রান্ত ও মারা যাওয়া নেতা-কর্মীদের একটি পূর্ণাঙ্গ তালিকা তৈরি করছেন তারা। তাদের সঙ্গে আলাপকালে জানা যায়, প্রতিদিনই তাদের কাছে মৃত্যুর মতো দুঃসংবাদ আসছে। আক্রান্তের খবরও পাচ্ছেন।

বিএনপি নেতারা জানান, দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ অন্য রোগে মারা গেলেও সর্বনাশা করোনার একটি প্রভাব থাকতে পারে। তার মারা যাওয়া দলের জন্য বড় ধরনের ধাক্কা। দল বড় একটি সম্পদ হারিয়েছে। একটি নক্ষত্রের পতন হয়েছে। এই শূন্যস্থান কোনো দিনই পূরণ হবে না। দলের আরও তারকা নেতা ভাইস চেয়ারম্যান চৌধুরী কামাল ইবনে ইউসুফ ও মেজর জেনারেল (অব.) রুহুল আলম চৌধুরী করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা গেলেন। তারাও দলের দুঃসময়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। বিএনপির তরুণ নেতা স্বেচ্ছাসেবক দলের সভাপতি শফিউল বারী বাবু, দলের কেন্দ্রীয় সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক আবদুল আউয়াল খান ও ঢাকা মহানগর উত্তর বিএনপির সাধারণ সম্পাদক আহসান উল্লাহ হাসানের মৃত্যু এখনো মেনে নিতে পারছেন না নেতা-কর্মীরা। দলের হাইকমান্ডও এ শোক এখনো কাটিয়ে উঠতে পারেনি।

করোনায় প্রাণ হারানো বিএনপির উল্লেখযোগ্য নেতাদের মধ্যে রয়েছেন- বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা এম এ হক, গাইবান্ধা জেলা বিএনপির সহ-সভাপতি খন্দকার আহাদ আহমেদ, সাবেক মন্ত্রী টি এম গিয়াস উদ্দিন, সাবেক সংসদ সদস্য আমজাদ হোসেন সরকার, ওলামা দলের কেন্দ্রীয় আহ্বায়ক কমিটির সদস্য মাওলানা কাসেমী, চট্টগ্রাম মহানগর বিএনপির সহ-সভাপতি লায়ন মোহাম্মদ কামাল উদ্দিন, বেলজিয়াম বিএনপির সভাপতি আহমেদ সাজা, চট্টগ্রাম জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি ও বিএনপির প্রতিষ্ঠাকালীন সদস্য অ্যাডভোকেট কবির চৌধুরী, জাতীয় ট্যাক্সেস বার সভাপতি অ্যাডভোকেট গফুর মজুমদার, শ্রমিক দলের সহ-সাধারণ সম্পাদক ফজলুল হক মোল্লা, শ্রীপুর পৌরসভায় বিএনপি মেয়র প্রার্থী শহিদুল্লাহ শহীদ, ঢাকার পল্লবী থানা বিএনপির সহ-সভাপতি আনিসুর রহমান, আমেরিকার বোস্টন বিএনপি ক্রীড়াবিষয়ক সম্পাদক মিতোষ বড়ুয়া প্রমুখ।

জানা যায়, বিএনপির সিনিয়র নেতাদের অনেকে সপরিবারে আক্রান্ত হয়েছেন। এর মধ্যে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন ও তাঁর স্ত্রী বিলকিস আক্তার হোসেন হাসপাতালে ভর্তি রয়েছেন। দলের ভাইস চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. এ জেড এম জাহিদ হোসেন ও স্ত্রী রিফাত হোসেন এবং হাবিব-উন-নবী খান সোহেল ও স্ত্রী কামরুন নাহার সৃষ্টি, দুই মেয়ে জান্নাতুন ইসি সূচনা ও অপরাজিতা খানও আক্রান্ত। সেলিমুজ্জামান সেলিম ও তার স্ত্রী সাবরিনা শুভ্রা এবং দলের কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য মিজানুর রহমান মিজানও সপরিবারে করোনায় আক্রান্ত। করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সেলিমা রহমানও। দলের সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব অ্যাডভোকেট রুহুল কবীর রিজভী করোনায় আক্রান্ত হয়ে আইসিইউতে ছিলেন। এখন তিনি শারীরিকভাবে কিছুটা সুস্থ হয়ে কেবিনে স্থানান্তরিত হয়েছেন।

সম্প্রতি করোনায় আক্রান্ত হয়ে বাসায় চিকিৎসা নিচ্ছেন বিএনপি চেয়ারপারসনের বিশেষ সহকারী শামসুর রহমান শিমুল বিশ্বাস ও প্রচার সম্পাদক শহীদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানী। সর্বশেষ গতকাল বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা আবুল খায়ের ভূঁইয়া, ময়মনসিংহ বিভাগীয় সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক শরীফুল আলম, ভোলা জেলা বিএনপির সভাপতি গোলাম নবী আলমগীরের করোনায় আক্রান্ত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। জানা যায়, করোনায় আক্রান্ত হওয়া সিনিয়র নেতাদের মধ্যে রয়েছেন ভাইস চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট আহমেদ আযম খান, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ডা. এ কে এম আজিজুল হক, ডা. ফরহাদ হালিম ডোনার, গীতিকার গাজী মাজহারুল আনোয়ার, সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক খন্দকার মাশুকুর রহমান মাশুক প্রমুখ। এ ছাড়া সাবেক ছাত্রনেতা রকিবুল ইসলাম বকুল, বিএনপির নির্বাহী কমিটির সদস্য ড. শেখ ফরিদুল ইসলাম, স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদ্্যাপন মিডিয়া কমিটির সদস্য আতিকুর রহমান রুমন, অ্যাডভোকেট ফারজানা শারমিন পুতুল, বিএনপির প্রেস উইংয়ের ফটোসাংবাদিক বাবুল তালুকদারও করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। এদের মধ্যে কেউ কেউ সুস্থও হয়েছেন। আবার কারও কারও শারীরিক অবস্থার অবনতিও হয়েছে। বিএনপির কেন্দ্রীয় সহ-দফতর সম্পাদক তাইফুল ইসলাম টিপু বলেন, ‘দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের প্রত্যক্ষ নির্দেশনায় গত বছর মার্চে করোনা শুরুর পর থেকে জুন পর্যন্ত সারা দেশে বিএনপির নেতারা ৫৪ লাখ ১২ হাজার ৪১৬টি পরিবারকে সহযোগিতা করেছেন। এই সহযোগিতার আওতায় মোট ২ কোটি ১৬ লাখ ৪৯ হাজার ৬৬৪ জন মানুষ উপকৃত হয়েছে। এ ছাড়া ড্যাব, জিয়াউর রহমান ফাউন্ডেশন ও দলের নেতারা কয়েক লাখ মাস্ক, হ্যান্ড স্যানিটাইজার, সাবান ও পিপিই বিতরণ করেছেন। করোনা এখন ভয়ংকর রূপ নিয়েছে, যে কারণে আবারও অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়াবেন বিএনপির নেতা-কর্মীরা। তবে সবাইকে সতর্কভাবে কাজ করতে বলা হয়েছে।’

এই রকম আরও টপিক

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর