দলীয় নেতা এম ইলিয়াস আলীর ‘গুম’ হওয়া নিয়ে বিস্ফোরক মন্তব্যের ব্যাপারে জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাসের ব্যাখ্যা চেয়েছে বিএনপি। দলের কেউ কেউ ওই গুমের সঙ্গে জড়িত থাকতে পারেন বলে তিনি যে বক্তব্য দিয়েছেন, সে ব্যাপারেই মূলত লিখিত ব্যাখ্যা চেয়েছে স্থায়ী কমিটি। আগামীকাল শনিবার দলের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম জাতীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে। সেখানে এ বিষয়টি এজেন্ডা হিসেবে থাকবে বলে জানা গেছে। দলীয় সূত্র জানায়, গতকাল বিকালে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের নির্দেশে দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর মির্জা আব্বাসকে তার বক্তব্যের ব্যাখ্যা চেয়ে চিঠি দেন। তবে তাকে কারণ দর্শানোর যে গুজব তা সঠিক নয়। এ নিয়ে মির্জা আব্বাসের সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করা হলে তাকে পাওয়া যায়নি। তবে ঘনিষ্ঠজনদের মির্জা আব্বাস জানিয়েছেন, তিনি কোনো কারণ দর্শাও নোটিস পাননি।
দলের একাধিক সূত্র জানিয়েছে, বিএনপির রাজনীতিতে ‘বিশ্বস্ত’ বলে পরিচিত নেতা মির্জা আব্বাসের বিরোধী একটি গ্রুপ এ বিষয়টি ইস্যু হিসেবে তৈরি করেছে। একটি ভার্চুয়াল সভায় স্বভাবসুলভ বক্তব্য দেন আব্বাস। বিষয়টি নিয়ে যতটা না জাতীয় রাজনীতিতে আলোচনা আছে, তার চেয়েও বেশি ঘাঁটছেন দলের নেতাদের কেউ কেউ।
গত শনিবার দলের ভার্চুয়াল এক অনুষ্ঠানে ইলিয়াস আলীর নিখোঁজ হওয়ার ঘটনা উল্লেখ করে মির্জা আব্বাস বলেন, ‘আমি জানি, আওয়ামী লীগ সরকার ইলিয়াস আলীকে গুম করেনি। তাহলে গুমটা কে করল? এই সরকারের কাছে এটা আমি জানতে চাই।’ ইলিয়াস আলী গুম হওয়ার আগের রাতে দলের কার্যালয়ে এক ব্যক্তির সঙ্গে মারাত্মক বাকবিতন্ডা করেন বলে বক্তব্যে বলেন মির্জা আব্বাস। স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস বিএনপির মহাসচিবের প্রতিও আহ্বান জানিয়ে বলেন, ইলিয়াস আলীর গুমের পেছনে দলের অভ্যন্তরে লুকায়িত ‘বদমায়েশগুলো’কে চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নিন।জানা গেছে, মির্জা আব্বাসকে দেওয়া ওই চিঠিতে তাঁর বক্তব্য উল্লেখ করে বলা হয়, ইলিয়াস আলী গুম হয়েছেন ৯ বছর হয়েছে। এই সময়ে তাঁকে গুমের বিষয়ে সরকারের বিরুদ্ধে দেশে ও বহির্বিশ্বে জনমত গড়ে উঠেছে। এ ব্যাপারে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলোর মধ্যে ঐকমত্য তৈরি হয়েছে। চিঠিতে মির্জা আব্বাসকে বলা হয়, ‘আপনার বক্তব্য এই জনমতকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে। যার পরিপ্রেক্ষিতে দলের নেতা-কর্মীরা আপনার বক্তব্যের ব্যাপারে আপনার কাছে ব্যাখ্যা প্রত্যাশা করছে যে আপনি কী বলতে চেয়েছিলেন।’
অবশ্য, ইতিমধ্যে মির্জা আব্বাস বক্তব্যের ব্যাখ্যা দিয়েছেন। দলের স্থায়ী কমিটির তিন সিনিয়র সদস্যও বিষয়টি মির্জা আব্বাসের স্বভাবসুলভ বক্তব্যের বহিঃপ্রকাশ বলে মনে করেন। এটি ভিন্নভাবে দেখার সুযোগ নেই। কিন্তু বিষয়টি জিইয়ে রেখেছেন সিনিয়র কয়েকজন নেতা। দলে তারা এখন অত্যন্ত প্রভাবশালী বলে পরিচিত।
দলের নেতা-কর্মীদের অধিকাংশ-ই মনে করেন, বিএনপির রাজনীতিতে আব্বাসের এমন বক্তব্য দেওয়ার ঘটনা নতুন নয়। দলের ত্যাগী নেতা হিসেবে তার ব্যাপারে কারও দ্বিমত নেই। বিএনপির রাজনীতিতে ইলিয়াস আলী তার ঘনিষ্ঠ ছিলেন। তার ব্যাপারে তিনি সবসময় দুর্বল। তার ঘটনায় তিনি আবেগপ্রবণ হয়ে ওই বক্তব্য দিয়েছেন। যে রাতে ইলিয়াস আলী গুম হন তার পরদিন বিএনপি আড়ম্বরপূর্ণ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে ১৮ দলীয় জোট গঠন করে। দলের নেতাকে বাঁচাতে আন্দোলনে না গিয়ে ওই জোট গঠন ওই দিন কেন করতে হলো তা নিয়েও প্রশ্ন ওঠে।
নেতা-কর্মীদের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া : মির্জা আব্বাসকে তার বক্তব্যের ব্যাখ্যা চেয়ে চিঠি দেওয়ার বিষয়টি দলীয় নেতা-কর্মীদের একটি অংশ ভালোভাবে নেয়নি। দলের কেন্দ্রীয় একাধিক নেতা বলেন, বিএনপির রাজনীতিতে আব্বাসের এমন বক্তব্যের ঘটনা নতুন নয়। নেতারা আরও জানান, মির্জা আব্বাসের বিরুদ্ধে যে অভিযোগ আনা হয়েছে তার সত্যতা নিশ্চিতে তার কর্মকান্ড এক বা দুই মাস পর্যবেক্ষণ করা যেত। কারণ দলের বিরুদ্ধে কোনো ষড়যন্ত্র করে থাকলে দু-এক মাসের কর্মকান্ডে তা প্রকাশ পেত। তাড়াহুড়ো করে চিঠি দেওয়ার সিদ্ধান্ত ঠিক হয়নি। মির্জা আব্বাস দলে আরেকজন তৈরি করা যাবে না।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক কেন্দ্রীয় নেতা জানান, মির্জা আব্বাসের বক্তব্যের বিষয়ে যতটা না জাতীয় রাজনীতিতে আলোচনা আছে, তার চেয়েও বেশি ঘাঁটছেন দলের স্থায়ী কমিটির কয়েকজন নেতা। যদিও দলের আরেকটি অংশ মনে করে, ইলিয়াস আলী গুম হওয়ার এত বছর পর মির্জা আব্বাসের এমন বক্তব্য দেওয়া ঠিক হয়নি। এই বক্তব্যের ফলে গুমের বিষয়ে সরকারের বিরুদ্ধে দেশে ও বহির্বিশ্বে যে জনমত গড়ে উঠেছে তা একটু হলেও প্রশ্নবিদ্ধ হবে। চিঠি দিয়ে দল সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছে।