শুক্রবার, ২৮ মে, ২০২১ ০০:০০ টা

ভয়ংকর মাদক এলএসডি

বলা হয় জীবনের শেষ মাদক, সেবনের পর তৈরি হয় খুনের প্রবণতা, নিজেকে অথবা অন্যকে নিষ্ঠুরভাবে হত্যার চেষ্টা করে, উচ্চবিত্ত পরিবারে উৎকণ্ঠা আতঙ্ক, শহীদ মিনারে নিজেকে কুপিয়ে খুন করা ছাত্র আসক্ত ছিলেন এ ড্রাগে

নিজস্ব প্রতিবেদক

ভয়ংকর মাদক এলএসডি

হাফিজুরের (ডানে) মৃত্যু তদন্তে নেমে মিলল এলএসডির সন্ধান

মাদকের সর্বশেষ সংযোজন ভয়ংকর এলএসডির (লাইসার্জিক অ্যাসিড ডাইইথ্যালামাইড) সন্ধান পেয়েছে পুলিশ। নেদারল্যান্ডস ও সুইডেন থেকে দেশে নিয়ে আসা এই মাদক ছড়িয়ে পড়েছে উচ্চবিত্তের মধ্যে। শুরু হয়েছে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা। হালে এই মাদক ছড়িয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মাঝে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এলএসডি ড্রাগ মস্তিষ্কে এমন এক প্রভাব সৃষ্টি করে যা হ্যালুসিনেশনে (সম্মোহন) সাহায্য করে। বিভিন্ন রকম রং এবং আকৃতির জিনিস দেখতে পাওয়া যায়, যার অস্তিত্ব পৃথিবীতেই নেই। শুধু তাই নয়, সেবনকারীর মধ্যে নিজেকে অথবা অন্যকে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করার প্রবণতা প্রবল হয়ে ওঠে।

পুলিশ জানিয়েছে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হাফিজুর রহমানের মৃত্যুর ঘটনা তদন্ত করতে গিয়ে তারা ভয়ংকর এই মাদকের সন্ধান পেয়েছে। গলায় দা চালিয়ে আত্মহত্যা করা হাফিজুর নিজেও এই মাদকে আসক্ত ছিলেন। এলএসডি মাদক সেবনের পর তিনি নিজের গলায় দা চালিয়েছেন।

দেশে এলএসডি উদ্ধারের ঘটনা এবারই প্রথম নয়। এ নিয়ে দ্বিতীয়বারের মতো এলএসডি উদ্ধারের ঘটনা ঘটল। এর আগে ২০১৯ সালের ১৫ জুলাই এই মাদক উদ্ধার করা হয়েছিল। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর রাজধানীর বাড্ডা থেকে এলএসডিসহ দুই যুবককে গ্রেফতার করেছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হাফিজুর রহমানের মৃত্যুর তদন্তে নেমে ভয়ংকর এলএসডি নামক মাদকের যোগসূত্র পেয়েছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। তারা বলছেন, এলএসডি (লাইসার্জিক অ্যাসিড ডাইইথ্যালামাইড) সেবন করেছিলেন এই তরুণ, আর তারপরই বিভ্রম ঘটায় নিজেই নিজেকে হত্যা করেন তিনি। ঈদের পরদিন ১৫ মে জরুরি কাজের কথা বলে ঢাকায় রওনা হয়েছিলেন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবা থানার খাড়েরা গ্রামের ইমাম মুজিবুর রহমানের ছেলে হাফিজুর। তারপর থেকে তিনি নিখোঁজ ছিলেন। আট দিন পর ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের মর্গে তার লাশ শনাক্ত করে পরিবার। প্রত্যক্ষদর্শীদের বরাত দিয়ে শাহবাগ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ মামুন অর রশীদ বলেছিলেন, ১৫ মে রাত পৌনে ৮টার দিকে ঢামেকের সামনে ডাব বিক্রেতার কাছ থেকে দা নিয়ে নিজের গলা নিজেই কাটতে থাকেন হাফিজুর। আর বলছিলেন, আমাকে মাফ করে দাও। তখন হাফিজুর মারা গেলেও তার পরিচয় শনাক্ত হয়নি। পরিচয় জানার পর এই অস্বাভাবিক মৃত্যুর কারণ খুঁজতে নেমে ঢাকার বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের তিন ছাত্রকে গ্রেফতার করে ডিবি। এরপর তাদের জিজ্ঞাসাবাদে ভয়ংকর এলএসডির বিষয়ে তথ্য পায় পুলিশ।

গতকাল রাজধানীর মিন্টো রোডে ডিএমপির মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে অতিরিক্ত কমিশনার (ডিবি) এ কে এম হাফিজ আক্তার ঢাবি ছাত্র হাফিজুরের অস্বাভাবিক মৃত্যুর কারণ খুঁজে পাওয়ার কথা জানান। তিনি বলেন, বুধবার ঢাকার লালমাটিয়া ও ধানমন্ডি থেকে সাদমান সাকিব রুপল, আসহাব ওয়াদুদ তূর্য ও আদিব আশরাফ নামে হাফিজুরের তিন বন্ধুকে গ্রেফতার করা হয়। তাদের কাছ থেকে ২০০ ব্লট ভয়ংকর এলএসডি উদ্ধার করা হয়। যার দাম প্রায় ৬ লাখ টাকা। এই এলএসডি নেদারল্যান্ডস থেকে কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে দেশে আনা হয়। পরে ফেসবুক দুটি গ্রুপের মাধ্যমে এলএসডি মাদকের প্রতিটি ব্লট ৮০০ থেকে ১০০০ টাকায় কেনা হলে তা ৩ থেকে ৪ হাজার টাকায় বিক্রি করত। জিজ্ঞাসাবাদে হাফিজুরের বন্ধুদের দেওয়া তথ্য উদ্ধৃত করে ডিবি কর্মকর্তারা বলেন, হাফিজুর ঈদের পরদিন ঢাকায় ফেরার পর সন্ধ্যায় এক প্রতিবন্ধী রিকশাচালকের সঙ্গে বাজে আচরণ করেছিলেন। এরপর তারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হল এলাকায় নেশা করতে বসেন। এলএসডি গ্রহণের পর বন্ধুদের একজন হাফিজুরকে বলেন, মামা তুমি কাজটা ভালো করনি। এরপর হাফিজুর কার্জন হলের মাঠ থেকে বেরিয়ে যান। বন্ধুরা একবার তাকে ধরে এনেছিলেন। এরপর তিনি আবার বেরিয়ে যান। কয়েকজন রিকশাচালকের পা চেপে ধরে বলেন, আমাকে মাফ করে দাও। এরপরই তিনি ডাবওয়ালার কাছ থেকে দা নিয়ে নিজের গলা কেটে আত্মহত্যা করেন। আর হাফিজুরের অবস্থা দেখে ভয়ে কাউকে কিছু না বলে বন্ধুরা পালিয়ে যায়।

হাফিজের বন্ধুদের কাছ থেকে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে পুলিশ প্রথমে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইবিএর বহিষ্কৃত ছাত্র সাদমানকে গ্রেফতার করে। তিনি বর্তমানে নর্থসাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ে বিবিএ পড়ছেন। সাদমান জানান, তিনি টেলিগ্রাম অ্যাপ-এ যোগাযোগ করে ৮০০ থেকে ১০০০ টাকা খরচ করে নেদারল্যান্ডসের এক ব্যক্তির কাছে পে পল মেইলে টাকা পাঠান। পরে ওই ব্যক্তি কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে পার্সেল করে ওই মাদকগুলো তার কাছে পাঠিয়েছে। প্রতি ব্লট ৩ থেকে ৪ হাজার টাকায় বিক্রি হয়। মাদক বিক্রির জন্য তাদের দুটি ফেসবুক গ্রুপ রয়েছে। একটির নাম ‘আপনার আব্বা’। আরেকটি নাম ‘বেটার ব্রাউনি অ্যান্ড বেয়ন্ড’। এই গ্রুপে ১ হাজার সদস্য রয়েছে। গ্রেফতার তিনজন ফেসবুক আইডি ও গ্রুপের মাধ্যমে এলএসডি বিক্রি করতেন। ভয়ংকর এলএসডির সঙ্গে জড়িত অন্যদের ধরতে অভিযান চলছে বলেও জানিয়েছেন ডিবি কর্মকর্তা এ কে এম হাফিজ আক্তার। নর্থসাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী রুপল ও তূর্য এবং ইন্ডিপেন্ডেন্ট ইউনিভার্সিটির ছাত্র আদিব।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তথ্য বিজ্ঞান ও গ্রন্থাগার ব্যবস্থাপনা বিভাগের ২০১৫-১৬ সেশনের ছাত্র হাফিজুর রহমান ছিলেন একজন মুকাভিনয় শিল্পী। টিএসসিভিত্তিক সংগঠন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মাইম অ্যাকশনের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন তিনি।

এলএসডি কী?

এলএসডি ড্রাগ মস্তিষ্কে এমন এক প্রভাব সৃষ্টি করে যা হ্যালুসিনেশনে (সম্মোহন) সাহায্য করে। ফলে যারা এই ড্রাগ ব্যবহার করে তারা বিভিন্ন রকম রং এবং আকৃতির জিনিস দেখে, যার অস্তিত্ব পৃথিবীতে নেই। এ ছাড়া এই ড্রাগ মানব মস্তিষ্কের এমন সব স্নায়ুর কার্যক্ষমতা বাড়িয়ে দেয় যা অনেক সময় অতীত স্মৃতি মনে করিয়ে দেয়। এমনকি এই ড্রাগ মানুষকে তার জন্মকালীন স্মৃতিও মনে করাতে সক্ষম।

বিশেষজ্ঞদের মতে, এলএসডির হ্যালুসিনেশন তৈরি করার প্রবণতা থেকে অনেক মানুষই এই ড্রাগটি ব্যবহার শুরু করে। এমনকি ষাটের দশকে এই ড্রাগ থেকে নতুন একটি সাইকেডেলিক কালচার তৈরি হয়। জনপ্রিয় সংগীত শিল্পী ও ব্যান্ড মেম্বাররা এই ড্রাগ ব্যবহার শুরু করেন।

১৯৬৮ সালে বিশ্বব্যাপী এলএসডি নিষিদ্ধ করা হয়। নিষিদ্ধ হওয়ার আগ পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্র ও গ্রেট ব্রিটেনের প্রায় ১০ শতাংশ মানুষ এই ড্রাগ ব্যবহার করেছিল। বর্তমানেও বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে রিক্রিয়েশনাল ড্রাগ হিসেবে এলএসডি ব্যবহৃত হয়ে থাকে। তবে এই ড্রাগ ভারতে এখনো গোপনে ব্যবহার হয়।

এলএসডি অত্যন্ত দামি একটি মাদক। সাধারণত ব্লটিং পেপারের ওপরে এই তরল মাদক ফেলে সেই কাগজ শুঁকে নেশা করে মাদকাসক্তরা। এলএসডি মাখা এক একটি ছোট ছোট টুকরো ব্লটিং পেপারের দাম কয়েক হাজার টাকা।

১৯৩৮ সালে সুইস রসায়নবিদ আলবার্ট হফম্যান প্যারাসাইটিক ফাঙ্গাস নিয়ে কাজ করতে গিয়ে এলএসডি আবিষ্কার করেন। আবিষ্কারের প্রথমদিকে এলএসডি ওষুধ হিসেবে ব্যবহার হতো। তবে ওষুধটি মস্তিষ্কের ক্ষতি করে বলে একে নিষিদ্ধ করা হয়। বিজ্ঞানীরা জানান, সাধারণত এলএসডি নেওয়ার পর একজন মানুষ চোখ বন্ধ করেও দেখতে পায়। তার দেখা এসব দৃশ্য সবসময় বাইরের পৃথিবী বা স্মৃতি থেকে আসে না বরং তাদের কল্পনাশক্তি অনেক বেড়ে যায়। এলএসডির প্রভাবে মস্তিষ্কের অন্যান্য যোগাযোগ ব্যবস্থা ভেঙে পড়ে। তারা বলেন, এলএসডি নেওয়ার পর প্রকৃতি ও বাইরের জগতের সঙ্গে এমন এক সম্পর্ক অনুভূত হয় যাকে অনেক সময় ধর্মীয় বা আধ্যাত্মিক রূপ দেওয়া হয়ে থাকে। এই মাদকের প্রভাব কেটে গেলেও ওই রকম অনুভূতি থেকে যেতে পারে।

এলএসডি ব্যবহার করলে মানুষের স্মৃতির ভান্ডার খুলে যায়। নেশার চূড়ান্ত পর্যায়ে কেউ কেউ মাতৃগর্ভের স্মৃতিও মনে করতে পারেন। তবে সেসব স্মৃতির ভার অধিকাংশ মানুষই সহ্য করতে পারেন না। ফলে মস্তিষ্ক বিকৃতির প্রবল সম্ভাবনা থাকে। এ ছাড়া অধিকাংশ মাদক গ্রহণকারীই স্মৃতির চূড়ান্ত স্তরে প্রবেশের আগে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন। এলএসডি গ্রহণ করেছেন এমন অনেকেই এমন দাবি করে থাকেন। তবে চিকিৎসাবিজ্ঞানীরা বলছেন, হ্যালুসিনেশনই এসব অনুভূতির মূল কারণ।

ক্রেতা কারা : ডিবি প্রধান বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় ও বিভিন্ন কলেজের শিক্ষার্থীদের কাছে এই মাদক বিক্রির তথ্য পাওয়া গেছে। অনেকের নাম পাওয়া গেছে সেগুলো যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে। তদন্তের স্বার্থে আগেই সব বলা যাচ্ছে না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েরও অনেক শিক্ষার্থীর নাম এসেছে, তাদের ধরতে অভিযান চলছে। এ ছাড়া আরও অনেক নামিদামি ব্যক্তির ছেলেদের নামও পাওয়া গেছে।

নতুন এই মাদক সেবন করলে নেশাকারীর চিন্তার পরিবর্তন ঘটে। অনুভূতি এবং পারিপার্শ্বিক চেতনাকে পরিবর্তন করে। সেবনকারীর দৃষ্টি ও শ্রুতির মধ্যে এক ধরনের উত্তেজিত ভাব তৈরি হয়। সে মনে করে সে একটি ট্রেন ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিতে পারবে, কাউকে কোনো তোয়াক্কাই করে না। এটি সেবন করলে চোখের মণির বিকৃতি ঘটে থাকে। ব্লাড প্রেসার ও শরীরের তাপমাত্রা বৃদ্ধি পায়। এর অন্য নাম এলএসডি-২৫, অ্যাসিড ও ডেলিসাইড। ছদ্মনাম এমডিএ, এন, মাশরুম, সিলোসাইবিন ও এম-ডিমথাইলট্রাইপটানিয়া।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর