শনিবার, ১৯ জুন, ২০২১ ০০:০০ টা
অর্থ মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ ব্যাংকে চিঠি

ব্যাংক ঋণের কিস্তি পরিশোধে বেকায়দায় ব্যবসায়ীরা

মহামারীর দ্বিতীয় ধাক্কায় নেতিবাচক প্রভাবে ঋণ পরিশোধের সময় বাড়ানোর দাবি - ঋণের কিস্তি দিতে পারছে না অধিকাংশ শিল্প ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান

রুহুল আমিন রাসেল

করোনা মহামারীর দ্বিতীয় ঢেউয়ে দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য এবং অর্থনৈতিক কার্যক্রমে বিরূপ প্রভাব বিরাজমান। অধিকাংশ শিল্প ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ব্যাংক ঋণের কিস্তি সময়মতো পরিশোধ করতে পারছে না। ফলে ব্যাংক ঋণের কিস্তি পরিশোধে বেকায়দায় পড়েছেন ব্যবসায়ীরা। এই তথ্য অর্থ মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ ব্যাংককে জানিয়ে দেওয়া চিঠিতে এফবিসিসিআই বলেছে- চলমান করোনা পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ ব্যাংকের দেওয়া সুবিধাসমূহের মেয়াদ বাড়ানো না হলে, অধিকাংশ ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান অনিচ্ছাকৃত খেলাপি গ্রাহকে পরিণত হবে। যা ব্যাংকিং খাতসহ পুরো অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। এ অবস্থায় দেশের শিল্প ও ব্যবসা-বাণিজ্যসহ সংশ্লিষ্ট সব খাতের ঋণ বিরূপমান শ্রেণিকরণ প্রক্রিয়া আগামী ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত স্থগিত রাখতে হবে। এ প্রসঙ্গে ব্যবসায়ী-শিল্পপতিদের শীর্ষ সংগঠন বাংলাদেশ শিল্প ও বণিক সমিতি ফেডারেশন-এফবিসিসিআই সভাপতি মো. জসিম উদ্দিন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, মহামারীর দ্বিতীয় ধাক্কা সামলাতে হিমশিম খাচ্ছেন ব্যবসায়ীরা। বর্তমানে করোনার প্রাদুর্ভাব ফের ঊর্ধ্বমুখী। পরিস্থিতি কোন দিকে যাচ্ছে পরিষ্কার না। ব্যবসা-বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক কার্যক্রমে বিরূপ প্রভাব এ অবস্থায় জীবন ও জীবিকা সচল রাখতে শিল্প ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলো বিপাকে পড়েছে। এই পরিস্থিতিতে করোনার নেতিবাচক প্রভাবে ঋণ পরিশোধের সময় বাড়ানো এখন সময়ের দাবি। আশা করছি- সংশ্লিষ্টরা সুদৃষ্টিতে দেখবেন। ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি- ডিসিসিআই সভাপতি রিজওয়ান রহমান বলেন, এক বছরে কেউ ঋণ পরিশোধ করতে পারেনি। করোনাও যায়নি। করোনা যত দিন থাকবে, তত দিন এই ঋণ সুবিধা চাই। কমপক্ষে আগামী দুই বছর ঋণ পরিশোধের সুযোগ চাই।

এর আগে চলমান কভিড পরিস্থিতিতে ঋণ বিরূপমান শ্রেণিকরণ প্রক্রিয়া আগামী ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত স্থগিত রাখার দাবি জানিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ফজলে কবির ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সিনিয়র সচিব মো. আসাদুল ইসলামকে গত ১৬ জুন দুটি পৃথক চিঠি দিয়েছে এফবিসিসিআই। সংগঠনটির সভাপতি মো. জসিম উদ্দিন স্বাক্ষরিত চিঠি দুটিতে বলা হয়- করোনার নেতিবাচক প্রভাব মোকাবিলায় অর্থনীতির বাস্তব সমস্যাগুলো অনুধাবন করে তা থেকে উত্তরণের নিমিত্তে কার্যকর ও সময়োপযোগী আর্থিক এবং নীতি সহায়তা দেওয়া হয়েছে ব্যবসায়ীদের। করোনাকালীন সময়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের বিভিন্ন সার্কুলারসমূহ অর্থনীতিকে পুনরুজ্জীবিত ও ব্যবসা-বাণিজ্যের গতিকে সমুন্নত রাখতে সর্বাত্মক সহায়তা করেছে। মেয়াদি ঋণসমূহের মেয়াদ ৫০ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ানো, চলমান ঋণের ওপর আরোপিত অনাদায়ী সুদ ৬টি ত্রৈমাসিক কিস্তিতে পরিশোধের সুযোগ প্রদান করা হয়। তলবি ঋণসমূহ পরিশোধের জন্য চলতি বছরের মার্চ থেকে ৮টি সমান ত্রৈমাসিক কিস্তিতে পরিশোধের সুযোগ প্রদান করা হয়েছে। ঋণসমূহের বিপরীতে চলতি বছরের মার্চ পর্যন্ত প্রদেয় ত্রৈমাসিক কিস্তি চলতি জুনের ৩১ তারিখ পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে।

ওই চিঠি দুটিতে আরও বলা হয়, দেশের রপ্তানি বাণিজ্য সচল রাখার স্বার্থে শ্রমিক কর্মচারীদের মজুরি বাবদ সরকারি তহবিল থেকে বিশেষ প্রণোদনা প্রদান করা হয়েছে। শিল্প ও সেবাখাতে চলতি মূলধন হিসেবে ঋণ প্রদান করা হয়। প্রি-শিপমেন্ট ক্রেডিট খাতে পুনঃঅর্থায়ন স্কিম, অতি ক্ষুদ্র এবং ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তা বা সিএমএসএমই খাতের জন্য বিশেষ ঋণ সুবিধাসহ কৃষিখাতে চলতি মূলধন সরবরাহ, নিম্ন আয়ের পেশাজীবী, কৃষক ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের জন্য পুনঃঅর্থায়ন স্কিম ইত্যাদি অত্যন্ত ইতিবাচক ভূমিকা রেখেছে। এ অবস্থায় করোনা মহামারীর দ্বিতীয় ঢেউ মোকাবিলায় বাংলাদেশ ব্যাংকের দেওয়া চলমান সুবিধাসমূহের মেয়াদ বাড়ানো না হলে, অধিকাংশ ব্যবসা প্রতিষ্ঠান অনিচ্ছাকৃত খেলাপি গ্রাহকে পরিণত হবে। যা ব্যাংকিং খাতসহ পুরো অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। এ অবস্থায় দেশের শিল্প ও ব্যবসা-বাণিজ্য সংশ্লিষ্ট সব খাতের ঋণ বিরূপমান শ্রেণিকরণ প্রক্রিয়া আগামী ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত স্থগিত রাখতে বলেছে এফবিসিসিআই। এদিকে সম্প্রতি অর্থ মন্ত্রণালয়ে পাঠানো বাংলাদেশ ব্যাংকের মনিটরিং পলিসি বিভাগের সর্বশেষ মাসিক মূল্যায়ন প্রতিবেদনে বেসরকারি খাতে মার্চ পর্যন্ত হিসাবে ব্যাংক ঋণের প্রবৃদ্ধি, মূলধনি যন্ত্রাংশ আমদানি কমে যাওয়া এবং শিল্প খাতসহ সমগ্রিক অর্থনীতির স্থবিরতা না কাটার আভাস মিলেছে। প্রতিবেদন অনুযায়ী, জানুয়ারি থেকে মার্চ- এ তিন মাসে বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৮ দশমিক ৭৯ শতাংশ। গত বছরের একই সময়ে ব্যাংক ঋণের প্রবৃদ্ধি ছিল ৮ দশমিক ৮৭ শতাংশ। অর্থাৎ এ সময়ে ঋণ কম নিয়েছে শিল্পোদ্যোক্তারা। যে কারণে প্রবৃদ্ধি কমছে দশমিক ৮ শতাংশ। তবে একই সময়ে বাজারে টাকার প্রবাহের প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১৩ দশমিক ২১ শতাংশ। এটি গত বছরের একই সময়ের তুলনায় বেড়েছে ১ দশমিক শূন্য ৫ শতাংশ।

অপরদিকে করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ে চলতি বছরেও ব্যাংকগুলোতে খেলাপি ঋণ বেড়েছে। চলতি বছরের প্রথম তিন মাসে ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণ ৬ হাজার ৩৫১ কোটি টাকা বেড়ে ৯৫ হাজার ৮৫ কোটি টাকা হয়েছে। মোট ঋণের যা ৮ দশমিক শূন্য ৭ শতাংশ। গত ডিসেম্বর পর্যন্ত মোট ঋণের ৭ দশমিক ৬৬ শতাংশ বা ৮৮ হাজার ৭৩৪ কোটি টাকা ছিল খেলাপি। বাংলাদেশ ব্যাংক আগে মূল ব্যাংক ও অফশোর ব্যাংকিং ইউনিটের ঋণ বিতরণ ও খেলাপির তথ্য আলাদাভাবে হিসাব করত। গত ডিসেম্বর থেকে একসঙ্গেই হিসাব করা হচ্ছে। করোনাভাইরাসের প্রভাব শুরুর পর গত বছর কেউ ঋণ পরিশোধ না করলেও তাকে খেলাপি করতে পারেনি ব্যাংক। এ বছর নতুন করে আগের মতো ঢালাও সুযোগ দেওয়া হয়নি। যেসব মেয়াদি ঋণ চলতি বছরের মার্চের মধ্যে পরিশোধ করার কথা, ব্যাংকার-গ্রাহক সম্পর্কের ভিত্তিতে তা আগামী জুনে পরিশোধ করলেও চলবে। আর চলমান ঋণের ওপর ২০২০ সালে আরোপিত অনাদায়ী সুদ একবারে পরিশোধ না করে আগামী জুন পর্যন্ত ছয়টি কিস্তিতে পরিশোধ করা যাবে। এ ছাড়া তলবি ঋণ চলতি বছরের মার্চ থেকে ২০২২ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে আটটি কিস্তিতে পরিশোধের সুযোগ দেওয়া হয়।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত মার্চ শেষে ব্যাংকগুলোর মোট ঋণ স্থিতি দাঁড়িয়েছে ১১ লাখ ৭৭ হাজার ৬৫৯ কোটি টাকা। তিন মাস আগে যেখানে ঋণ স্থিতি ছিল ১১ লাখ ৫৮ হাজার ৭৭৬ কোটি টাকা। এর মানে গত তিন মাসে ঋণ বেড়েছে মাত্র ১৮ হাজার ৮৮৩ কোটি টাকা বা ১ দশমিক ৬৩ শতাংশ। মার্চ শেষে রাষ্ট্রীয় বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে ৪৩ হাজার ৪৫১ কোটি টাকা। মোট ঋণের যা ১৯ দশমিক ৬৭ শতাংশ। তিন মাস আগে ৪২ হাজার ২৭৩ কোটি টাকা ছিল খেলাপি। বেসরকারি ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ ৪০ হাজার ৩৬১ কোটি টাকা থেকে বেড়ে ৪৫ হাজার ৯০ কোটি টাকা হয়েছে। এ খাতের ব্যাংকগুলোর মোট ঋণের যা ৫ দশমিক ১৩ শতাংশ। বিদেশি ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ ২ হাজার ৩৮ কোটি টাকা থেকে বেড়ে ২ হাজার ৪৫৮ টাকা হয়েছে। আর বিশেষায়িত ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ ২৪ কোটি টাকা বেড়ে হয়েছে ৪ হাজার ৮৬ কোটি টাকা।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর