বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরিতে এক বছর ওত পেতেছিল হ্যাকাররা। গতকাল বিবিসি এ সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। সেখানে তুলে ধরা হয়েছে বিশ্বে ব্যাংকিং ইতিহাসের অন্যতম দুর্ধর্ষ এই চুরির আদ্যোপান্ত।
২০১৬ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভ থেকে ৮ কোটি ১০ লাখ ডলার চুরি করে দুর্ধর্ষ একদল হ্যাকার।
এই ঘটনাটি ছিল তাদের বহু বছরের সুনিপুণ পরিকল্পনার ভিত্তিতে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশের অর্থ যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল ব্যাংক, ফিলিপাইনের আরসিবিসি ব্যাংক, ক্যাসিনো ঘুরে ম্যাকাও হয়ে শেষপর্যন্ত উত্তর কোরিয়ায় পৌঁছায় বলে বিশ্বাস তদন্তকারীদের। এ ঘটনা কীভাবে ঘটেছিল তা নিয়ে তদন্তে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ধরনের তথ্য উঠে এসেছে। তবে শুরুটা কীভাবে হয়েছিল, তা জানলে চোখ কপালে উঠবে! বিবিসির প্রতিবেদন অনুসারে, এ ঘটনার শুরু একটি ত্রুটিযুক্ত প্রিন্টার থেকে। সেটি বসানো ছিল মতিঝিলে বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ের ১০ম তলায় অত্যন্ত সুরক্ষিত একটি ঘরে। ব্যাংক থেকে কোটি কোটি ডলার লেনদেনের সব রেকর্ড প্রিন্ট হতো এটি দিয়ে। আজকালকার দিনে প্রিন্টারে সমস্যা অনেকটা দৈনন্দিন ঘটনা হয়ে উঠেছে। এ কারণে শুরুর দিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তাদের কাছেও সেই প্রিন্টারের সমস্যাকে সাধারণ ঘটনা বলেই মনে হয়েছিল। ২০১৬ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি সকাল ৮টা ৪৫ মিনিটে তারা দেখেন প্রিন্টারটি কাজ করছে না। সে সময় ডিউটি ম্যানেজার ছিলেন জুবায়ের বিন হুদা। পরে তিনি পুলিশকে বলেন, ‘আমরা ধরে নিয়েছিলাম এটি অন্য যে কোনো দিনের মতো একটি সাধারণ সমস্যা, যা আগেও হয়েছে।’ মূলত বাংলাদেশ ব্যাংক যে সমস্যায় জর্জরিত, সেটিই যেন প্রথম প্রকাশ পায় ওই ঘটনার মাধ্যমে। হ্যাকাররা ব্যাংকের কম্পিউটার নেটওয়ার্ক ব্যবস্থায় ঢুকে পড়ে এবং এযাবৎকালের সবচেয়ে দুর্ধর্ষ সাইবার হামলা চালায়। ১ বিলিয়ন ডলার চুরির লক্ষ্য নিয়ে মিশন শুরু করে হ্যাকাররা। এই অর্থ সরাতে তারা একাধিক ভুয়া ব্যাংক অ্যাকাউন্ট, দাতব্য সংস্থা, ক্যাসিনোসহ বিশাল এক নেটওয়ার্ক ব্যবহার করে। কিন্তু কারা ছিল এই হ্যাকার? তদন্তকারীদের পাওয়া সব তথ্যপ্রমাণ কেবল এক দিকেই নির্দেশ করেছে, তা হলো উত্তর কোরিয়া সরকার। যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা এফবিআইয়ের তথ্যমতে, বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরি করতে উত্তর কোরিয়া সরকারের সাহায্য নিয়ে বহু বছর ধরে সুপরিকল্পিতভাবে এগিয়েছে হ্যাকাররা। সাইবার নিরাপত্তা ইন্ডাস্ট্রিতে এই দলটি ল্যাজারাস গ্রুপ নামে পরিচিত। এদের সম্পর্কে খুব কমই জানা যায়। তবে এফবিআই এক সন্দেহভাজনকে চিহ্নিত করেছে, যার নাম পার্ক জিন হিয়ক। এই হ্যাকার পাক জিন-হেক ও পার্ক কোয়াং-জিন নামেও কাজ করে থাকেন। তবে এগুলো তার আসল নাম নয় এবং তিনি রাতারাতিই হ্যাকার হয়ে ওঠেননি। পার্ক উত্তর কোরিয়ার হাজার হাজার তরুণের একজন, যাকে শৈশব থেকেই সাইবারযোদ্ধা বানানোর জন্য প্রস্তুতি চলছে। সেখানে ১২ বছর বয়স থেকেই প্রতিভাধর গণিতবিদদের স্কুল থেকে সরাসরি রাজধানীতে নেওয়া হয়, যেখানে হ্যাকার হয়ে উঠতে তাদের সকাল থেকে রাত অবধি নিবিড় প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। আবারও সেই ত্রুটিপূর্ণ প্রিন্টারের গল্পে ফেরা যাক। বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মীরা প্রিন্টারটি চালু করার পর উদ্বেগজনক কিছু লক্ষ্য করেন। তারা বুঝতে পারেন, যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংকে প্রায় ১০০ বিলিয়ন ডলার, অর্থাৎ অ্যাকাউন্ট খালি করে দেওয়ার মতো বার্তা গেছে সেখান থেকে। বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে দ্রুত যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়। তবে ঝামেলা বাধায় সময়ের পার্থক্য। হ্যাকাররা হ্যাকিং শুরু করেছিল বাংলাদেশ সময় বৃহস্পতিবার রাত ৮টায়, সে সময় নিউইয়র্কে ছিল বৃহস্পতিবার সকাল। অর্থাৎ বাংলাদেশে ব্যাংকিং কার্যক্রম যখন বন্ধ, তখন যুক্তরাষ্ট্রে সবেমাত্র শুরু হয়েছে। অন্যদিকে, শুক্র ও শনিবার বাংলাদেশে সাপ্তাহিক ছুটি। ফলে শনিবার যখন বাংলাদেশে চুরির ঘটনা সামনে আসতে শুরু করে, তখন আবার নিউইয়র্কে সাপ্তাহিক ছুটি শুরু হয়ে যায়। এখানেই শেষ নয়, হ্যাকাররা আরও একটি বুদ্ধি খাটায়। যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল ব্যাংক থেকে অর্থ ছাড় করতে পারলে তা অন্য কোথাও পাঠানো দরকার হতো। এক্ষেত্রে তারা জায়গা হিসেবে বেছে নেয় ফিলিপাইনের রাজধানী ম্যানিলাকে। কারণ, ২০১৬ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি সোমবার ছিল চন্দ্রবর্ষের প্রথম দিন, অর্থাৎ এশিয়াজুড়ে ছিল সরকারি ছুটি। এভাবে যুক্তরাষ্ট্র, বাংলাদেশ এবং ফিলিপাইনের ছুটি ও সময়ের ব্যবধানকে কাজে লাগিয়ে অর্থ সরাতে পাঁচটা দিন হাতে পায় হ্যাকাররা। ধারণা করা হয়, কয়েক বছর ধরে এই হ্যাকিংয়ের পরিকল্পনা করেছিল ল্যাজারাস গ্রুপ।