শনিবার, ১৭ জুলাই, ২০২১ ০০:০০ টা

সংকটে করোনা চিকিৎসা

কাটছে না টেস্ট ভোগান্তি, আইসিইউর জন্য হাসপাতালের দুয়ারে ঘুরছেন স্বজনরা, হাসপাতালে সাধারণ শয্যার চাপ বাড়ছে

জয়শ্রী ভাদুড়ী

সংকটে করোনা চিকিৎসা

শেবাচিম হাসপাতালের করোনা ওয়ার্ডে আইসিইউ সংকট চরমে -বাংলাদেশ প্রতিদিন

করোনাভাইরাসের সংক্রমণে দীর্ঘ হচ্ছে আক্রান্ত ও মৃত্যুর পরিসংখ্যান। আইসিইউয়ের জন্য হাসপাতালের দুয়ারে ঘুরছেন স্বজনরা। হাসপাতালের সাধারণ শয্যাও সংকুলান হচ্ছে না। গ্রামেগঞ্জে ছড়িয়ে পড়েছে করোনা রোগী। টেস্ট করতে ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে মানুষকে। সংকটের শেষ নেই হাসপাতালগুলোতে। জেলা-উপজেলা থেকে             রেফার্ড রোগীদের চাপ বাড়ছে ঢাকার হাসপাতালগুলোতে। স্বাস্থ্য অধিদফতরের দেওয়া তথ্যে দেখা যায়, সরকারি হাসপাতালে আইসিইউ সংকট তৈরি হচ্ছে। রাজধানীর সরকারি হাসপাতালে আইসিইউ সংখ্যা ৩৯৩টি, এর মধ্যে ফাঁকা ছিল ৬৬টি। সাধারণ শয্যাতেও বাড়ছে ভিড়। কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে শয্যার চেয়ে অতিরিক্ত রোগী ভর্তি। রাজধানীর সরকারি হাসপাতালে সাধারণ শয্যা ৩ হাজার ৭৫৫টি, এর মধ্যে ফাঁকা ছিলা ১ হাজার ২৫২টি। হাসপাতালে ভর্তি থাকা রোগীর অধিকাংশই ঢাকার বাইরে থেকে আসা।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ও ভাইরোলজিস্ট অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম বলেন, দেশে কভিড-১৯ আক্রান্ত রোগী শনাক্তে প্রায় দেড় বছর হচ্ছে। কিন্তু স্বাস্থ্য সেবায় সেরকম কোনো অগ্রগতি হয়নি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত বছর জুনে নির্দেশনা দিয়েছিলেন দেশের সব জেলা শহরে আইসিইউয়ের ব্যবস্থা করার। তার নির্দেশনা বাস্তবায়িত হলে আজ এ পরিস্থিতি তৈরি হতো না।

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ও আইইডিসিআরের উপদেষ্টা ডা. মুশতাক হোসেন বলেন, গ্রামগঞ্জে জেলা উপজেলায় করোনাভাইরাসের সংক্রমণ বেড়েছে। রোগীর তুলনায় সেবা অপ্রতুল। সংক্রমণ না কমলে এ সক্ষমতায় সেবা দেওয়া কঠিন হয়ে পড়বে। দ্রুত রোগী শনাক্ত করে তাদের চিকিৎসা দিতে না পারলে মৃত্যু হার কমানো কঠিন হয়ে পড়বে। করোনা যেহেতু গ্রামেগঞ্জে ছড়িয়ে পড়েছে তাদের শনাক্ত করতে বাড়ি বাড়ি যেতে হবে স্বাস্থ্যকর্মীদের। স্বাস্থ্যকর্মীরা অধিক সংক্রমিত এলাকায় বাড়ি বাড়ি গিয়ে র‌্যাপিড অ্যান্টিজেন টেস্টের মাধ্যমে রোগী শনাক্ত করতে পারবেন।

চট্টগ্রামে আমাদের নিজস্ব প্রতিবেদক রেজা মুজাম্মেল জানান, চট্টগ্রামে সরকারি ৩ হাসপাতালে করোনা রোগীর চিকিৎসায় সাধারণ শয্যা আছে ৩৯৬টি এবং আইসিইউ ৩৩টি। তবে রোগীর চাপে এসব হাসপাতালে এখন একটি আইসিইউ পাওয়া এখন সোনার হরিণ এবং তদবির করতে হয় সাধারণ শয্যার জন্যও। ১০টি বেসরকারি হাসপাতালে ৫০০টি সাধারণ ও প্রায় ১০০টির মতো আইসিইউ থাকলেও তা ব্যয়বহুল। ফলে এগুলো সাধারণ নাগরিকদের সাধ্যের বাইরে।

চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালে সাধারণ শয্যা ২০৬টি, আইসিইউ শয্যা ১০টি, বিআইটিআইডিতে সাধারণ ৫০টি ও আইসিইউ ৫টি ও জেনারেল হাসপাতালে সাধারণ ১৪০টি ও আইসিইউ ১৮টি শয্যায়। চট্টগ্রামের সিভিল সার্জন ডা. সেখ ফজলে রাব্বি বলেন, চট্টগ্রামে শয্যা সংকট হবে না। গত বুধবার থেকে হলি ক্রিসেন্টে শুরু হয়েছে চিকিৎসা এবং বেসরকারি মেরিন সিটি হাসপাতালকেও করোনা চিকিৎসার জন্য প্রস্তুত করা হচ্ছে। চট্টগ্রামে সরকারি-বেসরকারি ১১টি ল্যাবে নমুনা পরীক্ষা চলছে। তাছাড়া বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালক কার্যালয়ের উদ্যোগে শিগগিরই চালু হবে আরও একটি ল্যাব। ফলে নমুনা পরীক্ষা নিয়ে কোনো সংকট নেই।

চট্টগ্রাম বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালকের কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, বৃহত্তর চট্টগ্রামে আইসিইউ আছে মাত্র ৬৫টি। এর মধ্যে ৩৩টি চট্টগ্রাম জেলায়। চট্টগ্রাম বিভাগীয় পরিচালক (স্বাস্থ্য) ডা. হাসান শাহরিয়ার কবির বলেন, চট্টগ্রাম বিভাগে এখনো কোনো জেলায় চিকিৎসায় সংকট দেখা দেয়নি। প্রয়োজনীয় সব প্রস্তুতি নেওয়া আছে, চিকিৎসাও চলছে। অন্য বিভাগের চেয়ে চট্টগ্রামের অবস্থা ভালো। তবে আইসিইউ বা ভেন্টিলেটর সমাধান নয়, এখন প্রয়োজন সতর্কতা। 

রাজশাহীতে আমাদের নিজস্ব প্রতিবেদক কাজী শাহেদ জানান, করোনা সংক্রমণের দ্বিতীয় দফায় টালমাটাল হাসপাতালগুলো। করোনা আক্রান্ত রোগীর পাশাপাশি এ বছর সাধারণ রোগী বেড়েছে কয়েকগুণ। রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল শামীম ইয়াজদানী বলেন, ‘রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে সাধারণ রোগী ও করোনা আক্রান্ত রোগী একসঙ্গে রেখে দীর্ঘদিন চিকিৎসা করানো একটু কঠিন। এতে করে সাধারণ ওয়ার্ডেও করোনা রোগী ছড়িয়ে পড়ার একটা আশঙ্কা থেকেই যাচ্ছে। এ জন্য করোনা রোগীদের চিকিৎসার জন্য আলাদা হাসপাতালের ব্যবস্থা করা অত্যন্ত জরুরি।’ তিনি বলেন, ‘এই মুহূর্তে রাজশাহী সদর হাসপাতাল চালু করা খুবই দরকার। এ জন্য আমরা বরাদ্দ পেয়েছি। কিন্তু সেটি চালু করতে দুই মাসের মতো সময় লাগবে।’ রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের উপ-পরিচালক ডা. সাইফুল ফেরদৌস জানান, গত বছর এ সময়ে হাসপাতালে ৫০০-৬০০ রোগী ভর্তি ছিল। এ বছর তিন হাজারের বেশি রোগী ভর্তি আছে। সাধারণ রোগীর চাপ আগের বছরগুলোর তুলনায় কয়েকগুণ বেড়েছে। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. চিন্ময় কান্তি দাস বলেন, ‘সাধারণ রোগীর চাপ কমানো না গেলে চিকিৎসার চেইন ভেঙে পড়বে। এখন যে হারে করোনা রোগী বাড়ছে, তাতে সাধারণ রোগীর চাপ কমাতে হবে। সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) জেলা সভাপতি আহমদ শফিউদ্দিন বলেন, ‘করোনার এই ভয়াবহ সময়ে দেশের প্রায় ২০টি জেলা থেকে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মানুষজন চিকিৎসা নিতে আসছেন। এতে হাসপাতালে তৈরি হচ্ছে চাপ। রাজশাহী সদর হাসপাতালের পাশাপাশি বন্ধ করে দেওয়া দুটি করোনা বিশেষায়িত হাসপাতালও চালুর উদ্যোগ নিতে হবে।’ রাজশাহী সিটি মেয়র এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন বলেন, ‘রাজশাহী সদর হাসপাতালে পর্যাপ্ত অবকাঠামো আছে। সরকারি বরাদ্দ পাওয়া গেছে। দ্রুতই হাসপাতালটি চালু হলে, রামেক হাসপাতালে চাপ কমবে।’

খুলনায় আমাদের নিজস্ব প্রতিবেদক সামছুজ্জামান শাহীন জানান, খুলনা ডেডিকেটেড হাসপাতালে করোনা চিকিৎসায় ‘চিকিৎসা ব্যবস্থাপনা গাইডলাইন’ মানা হয় না। অভিযোগ রয়েছে, বিভিন্ন ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধির সঙ্গে যোগসাজশে চিকিৎসকরা প্রেসক্রিপশনে বরাদ্দকৃত ওই ওষুধের বাইরেও অপ্রয়োজনীয় ওষুধ লিখে থাকেন। এতে হাসপাতালে ভর্তির ৩-৪ দিনের মধ্যে ২৫-৩০ হাজার টাকার ওষুধ কিনতে হয় রোগীর স্বজনদের।   

খুলনায় করোনা চিকিৎসায় সমন্বয়কারী ডা. মেহেদী নেওয়াজ জানান চাপ সামলাতে ডেডিকেটেড হাসপাতালকে ১০০ শয্যা থেকে ১৩০ শয্যায় উন্নীত করা হয়েছে। সেখানে রোগী ভর্তি থাকছে ১৯০-২০০ জন। ১০০ শয্যার জনবল দিয়ে এত রোগীর চিকিৎসাসেবা দেওয়া কষ্টকর হচ্ছে।

জেলা দুর্নীতি প্রতিরোধ কমিটির সাধারণ সম্পাদক শেখ আশরাফ উজ্জামান জানান, সরকারি হাসপাতালে করোনা রোগী ভর্তি করলেও পরীক্ষা-নিরীক্ষা, ওষুধে ৩০ থেকে ৪০ হাজার টাকা ব্যয় হচ্ছে। অক্সিজেনে কৃত্রিম সংকট তৈরি করেও স্বজনদের কাছ থেকে অর্থ আদায়ের অভিযোগ রয়েছে। জানা যায়, অক্সিজেনের সংকটের কথা শুনে গত ৪ জুলাই রাতে খুমেক হাসপাতালের আবাসিক মেডিকেল অফিসার অঞ্জন চক্রবর্তী করোনা ইউনিটের বাথরুম থেকে ৪৫টি অক্সিজেন ভর্তি সিলিন্ডার উদ্ধার করেন। খুলনা মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ ডা. আবদুল আহাদ জানান, এখানে ল্যাবে দুটি পিসিআর  মেশিন থাকলেও মেয়াদোত্তীর্ণ হওয়ায় পুরান মেশিনটি মাঝে মধ্যে নষ্ট থাকছে। এতে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে নমুনা পরীক্ষা। আর জেলা সিভিল সার্জন নিয়াজ মোহাম্মদ জানান, করোনা ওয়ার্ডে বহিরাগতদের প্রবেশ ঠেকাতে ‘ভিজিটিং পাস’ চালু করা হচ্ছে। সেখানে ওষুধ কোম্পানি বা ক্লিনিক প্যাথলজির প্রতিনিধির প্রবেশ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। বরিশালে আমাদের নিজস্ব প্রতিবেদক রাহাত খান জানান, বরিশাল শেরেবাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের (শেবাচিম) করোনা ওয়ার্ডে প্রতিদিন রোগীর চাপ বাড়ছে। সেই সঙ্গে বাড়ছে নানামুখি সংকট। রোগীর তুলনায় ডাক্তার-নার্স এবং অন্যান্য কর্মচারীর সংখ্যা একেবারে অপ্রতুল। এ কারণে রোগীদের অভাব অভিযোগের শেষ নেই। জরুরি মুহূর্তে ডাক্তার ডাকলে পাওয়া যায় না। সময়মতো পাওয়া যায় না অক্সিজেন। আইসিইউর অভাবে ছটফট করে মারা যাচ্ছে মুমূর্ষু রোগীরা। রয়েছে বিশুদ্ধ পানি সংকট। বাথরুম-টয়লেটও নোংরা-অপরিচ্ছন্ন এবং অন্ধকার। যা ব্যবহার অনুপযোগী। ভুক্তভোগীরা করোনা ওয়ার্ডের নানামুখী সংকট এবং সমস্যা দ্রুত সমাধানের দাবি জানিয়েছেন। হাসপাতাল সূত্র জানায়, শয্যা বাড়ানো হলেও সেন্ট্রাল অক্সিজেন সেবা রয়েছে ১০৩ জন রোগীর। হাই ফ্লো ন্যাজাল ক্যানোলা রয়েছে ৬৯টি। আইসিইউ শয্যা রয়েছে ২২টি। ৪৭০টি অক্সিজেন সিলিন্ডার দিয়ে পর্যায়ক্রমে সেবা দেওয়া হচ্ছে জরুরি রোগীর। আইসিইউয়ের জন্য হাহাকার। হাসপাতালের পরিচালক ডা. এইচ এম সাইফুল ইসলাম বলেন, প্রয়োজনের এক তৃতীয়াংশ জনবল দিয়ে রোগীদের প্রত্যাশা অনুযায়ী সেবা দেওয়া যাচ্ছে না। জনবল নিয়োগের জন্য স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে একাধিকবার তাগাদা দেওয়া হয়েছে।

 

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর