শিরোনাম
শুক্রবার, ৩০ জুলাই, ২০২১ ০০:০০ টা

প্রবাসে যেতে আগ্রহ কমছে নারী শ্রমিকের

জিন্নাতুন নূর

ভাগ্যের চাকা ঘোরাতে বিদেশে পাড়ি জমালেও নির্যাতন কিছুতেই প্রবাসী নারী শ্রমিকদের পিছু ছাড়ছে না। আশঙ্কার বিষয় হচ্ছে করোনা মহামারীতে এ নির্যাতন আরও বেড়েছে। মহামারীতে একদিকে যেমন প্রবাসে যাওয়া নারী শ্রমিকের সংখ্যা কয়েক গুণ কমেছে, অন্যদিকে কমেছে নারী শ্রমিকদের আয়ও। আবার করোনায় দেশে ফেরত এসে কাজ হারিয়ে তারা যেমন আর্থিক অনটনে দিন কাটাচ্ছেন, তেমনি তাদের ওপর ঘটছে সহিংসতা। সব মিলিয়ে প্রবাসী নারী শ্রমিকদের দুর্ভোগ যেন কিছুতেই কাটছে না। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গৃহকর্মীদের বাইরে যে নারীরা অন্য পেশা এবং উৎপাদনমুখী কাজে সম্পৃক্ত করোনায় তারা কাজ হারিয়েছেন। মহামারীর কারণে অতীতের যে কোনো সময়ের তুলনায় নারী শ্রমিকদের বিদেশে কাজ করতে যাওয়ার হার কমে গেছে। এ ক্ষেত্রে ঝুঁকি নিয়ে পুরুষ শ্রমিক প্রবাসে যেতে আগ্রহী হলেও নারী শ্রমিকদের আগ্রহ কম।

জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর তথ্যমতে চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে মে পর্যন্ত ২৮ হাজার ৮২৪ জন নারী বিদেশে কাজের উদ্দেশ্যে যান। এর মধ্যে শুধু সৌদি আরবেই গেছেন ১৮ হাজার ৪৩৭ জন। ২০২০ সালে মোট গিয়েছিলেন ২১ হাজার ৯৩৪ জন নারী শ্রমিক। এর মধ্যে সৌদি আরবে যান ১২ হাজার ৭৩৫ জন। করোনা শুরুর আগে ২০১৯ সালেও গিয়েছিলেন ১ লাখ ৪ হাজার ৭৮৬ জন নারী। করোনা সংক্রমণের কারণে গত বছরের এপ্রিল থেকে জুন ও জুলাই থেকে ডিসেম্বরে মাত্র ৩ হাজার ১২১ জন নারী কর্মী বিদেশে কাজ করতে যান। এই সময়ে বাংলাদেশ থেকে এর আগের বছরের তুলনায় নারী শ্রমিকের বিদেশ যাওয়ার হার ৭৯ শতাংশ কমেছে। গত বছরের এপ্রিলের ১ থেকে ১৭ ডিসেম্বর পর্যন্ত ৪৬ হাজারের ওপর নারী শ্রমিক দেশে ফিরে আসেন। এর মধ্যে ২০ হাজার ২৩৮ জন সৌদি আরব, ১০ হাজার ৪৬১ জন আরব আমিরাত, ৪ হাজার ৩২৮ জন কাতার, ২ হাজার ৯১৬ জন ওমান, ২ হাজার ৮০৩ জন লেবানন ও ১ হাজার ৮৭৬ জন জর্ডান থেকে ফেরত আসেন। মূলত সে বছরের সেপ্টেম্বর থেকে ডিসেম্বরে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক নারী শ্রমিক দেশে ফিরে আসেন। প্রসঙ্গত, প্রবাসে কর্মরত ১ কোটি ২০ লাখ শ্রমিকের মধ্যে ১০ লাখ নারী যা মোট প্রবাসী শ্রমিকের ১২ শতাংশ। আর বিদেশফেরত ৩৫ শতাংশ নারীই নিপীড়নের শিকার হন। ২০২০ সালে বিদেশফেরত নারীর বেশির ভাগই শারীরিক, মানসিক ও যৌন নির্যাতনের অভিযোগ করেন বলে বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাকের এক জরিপে জানা যায়। উদ্বেগজনক যে করোনা সংক্রমণ শুরুর আগে থেকেই প্রবাসে কাজ করতে গিয়ে শারীরিক, মানসিক, যৌন নির্যাতনসহ প্রতারণার শিকার হয়ে শূন্য হাতে দেশে ফিরে আসেন অনেক নারী কর্মী। কখনো কখনো নির্যাতনের মাত্রা এত বেশি হয়ে যায় যে অনেক নারী মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন। আবার নির্যাতনের কারণে অনেকে বিদেশে মারাও যাচ্ছেন। নির্যাতন সইতে না পেরে কেউ কেউ আত্মহত্যা করছেন।

নারী শ্রমিকের ওপর নিপীড়ন সবচেয়ে বেশি ঘটে সৌদি আরবে। হযরত শাহজালাল বিমানবন্দরের প্রবাসীকল্যাণ ডেস্কের হিসাব বলছে, ২০২০ সালের প্রথম ১০ মাসে সৌদি আরব থেকে দেশে ২২ জন নারী গৃহকর্মীর লাশ দেশে এসেছে। এর সিংহভাগই হত্যার শিকার বলে অভিযোগ আছে। এ ছাড়া প্রায়ই অনাকাক্সিক্ষত সন্তান নিয়ে মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ থেকে দেশে আসছেন নারী শ্রমিকরা।

শরণার্থী ও অভিবাসী আন্দোলন গবেষণা ইউনিট (রামরু) প্রতিষ্ঠাতা এবং চেয়ারম্যান ড. তাসনিম সিদ্দিকী বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘করোনা সব অভিবাসী শ্রমিকের জীবনে প্রভাব ফেলেছে। বাদ যায়নি নারী অভিবাসীও। তবে পেশাভেদে এর প্রভাব ভিন্ন। নারী শ্রমিকের মধ্যে যারা গৃহকর্মী তারা বেতন পাচ্ছেন। তবে তাদের ওপর নির্যাতন করোনাকালে আরও বেড়েছে। সৌদি আরবে যে গৃহকর্মীরা হোস্টেলে থেকে কাজ করছেন তারা মহামারীতে ব্যাপকভাবে কাজ হারিয়েছেন। এর বেশির ভাগ দেশে ফিরে আসতে বাধ্য হচ্ছেন। বিশেষ করে যে নারীরা মানসিক ও শারীরিকভাবে নির্যাতিত হয়ে দেশে ফিরে আসছেন তাদের নিয়ে কাজ করার জন্য এনজিও ছাড়া সরকারি পর্যায়ে কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। কিন্তু এই নারীদের তাদের পরিবারে ফিরিয়ে দিলে আরও বিপদ হবে। এদের কোনো আশ্রয় কেন্দ্রে রেখে কাউন্সেলিংয়ের ব্যবস্থা করে তারপর পরিবারে পাঠাতে হবে। এ ছাড়া ফিরে আসা প্রবাসী শ্রমিকদের জন্য সরকার যে ঋণ প্রকল্প গ্রহণ করেছে সেখানে নারীবান্ধব বিভিন্ন উৎপাদন কার্যক্রম রেখে ঋণ দেওয়ার পথ তৈরি করতে হবে।’ রামরুর তথ্যে মহামারীতে নারী শ্রমিকরা (৬৯ শতাংশ) পুরুষ শ্রমিকের তুলনায় পরিবারের কাছে বেশি (৩১ শতাংশ) অর্থ পাঠাচ্ছেন। তবে এ অর্থ আগের বছরগুলোর তুলনায় কম। আগে প্রতি তিন মাস পর এই শ্রমিকরা যেখানে ৪৫ হাজার টাকা পাঠাতেন তা কমে এখন দাঁড়িয়েছে ৩০ হাজারে। এতে এ পরিবারগুলো প্রয়োজন মেটাতে ধার করছে কিংবা পরিবারের অন্য সদস্যের আয়ের ওপর নির্ভর করছে। এমনকি এ পরিবারগুলো তাদের খরচও কমিয়ে এনেছে। রামরুর গবেষণায় দেখা যায়, মহামারীতে সামাজিক ও লিঙ্গ বৈষম্যের কারণে ফিরে আসা নারী শ্রমিকদের ওপর সহিংসতার মাত্রাও বেড়েছে। এই নারীদের অর্থনৈতিক চাপেও পড়তে হয়। একই সঙ্গে তাদের স্বাস্থ্য খারাপ হতে থাকে এবং সমাজে সম্মানহানিসহ অনিরাপত্তায় ভুগতে হয়। ব্র্যাকের অভিবাসন কর্মসূচির এক জরিপ প্রতিবেদন বলছে, করোনাকালে বিদেশফেরত কর্মীর ৪৭ শতাংশ বেকার হয়ে পড়েন। তারা দেশে কোনো কাজ পাননি। পরিবারের অন্যদের আয় থেকে বা আত্মীয়স্বজন থেকে ধার করে চলছেন। বিদেশফেরতের ৯৮ শতাংশই ভবিষ্যৎ নিয়ে চরম উদ্বিগ্ন। করোনা শুরুর পর গত বছরের মার্চ থেকে ১৪ মাসে প্রায় ৫ লাখ প্রবাসী কর্মী দেশে ফেরত আসেন। এ গবেষণায় অংশগ্রহণকারীর ৪ দশমিক ৩২ শতাংশই নারী।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর