শনিবার, ৪ সেপ্টেম্বর, ২০২১ ০০:০০ টা

পাচারে স্বপ্নভঙ্গ যুবকদের

ইউরোপের কথা বলে আফ্রিকার দেশ টোগোতে নিয়ে জিম্মি চক্রের সদস্যদের দেশে ফিরিয়ে আনতে ইন্টারপোলকে চিঠি

আলী আজম ও মাহবুব মমতাজী

ইতালি যাওয়ার স্বপ্নে ঢাকার নবাবগঞ্জের সাইদুর রহমান ১৫ লাখ টাকা তুলে দেন দালাল তুহিনের হাতে। ২০১৯ সালের ৩১ ডিসেম্বর তাকে ঢাকা থেকে নেওয়া হয় থাইল্যান্ডে। সেখান থেকে আফ্রিকার দেশ ইথিওপিয়া হয়ে টোগো নিয়ে জিম্মি করা হয়। সেখানকার টর্চার সেলে চলে অকথ্য নির্যাতন। স্বজনদের কাছ থেকে দুই কিস্তিতে ৭ লাখ টাকা নেন দালাল তুহিন ও তার সহযোগীরা। গত ২ এপ্রিল প্রাণ নিয়ে দেশে ফিরে আসেন। গুলশান থানায় মানব পাচারকারী তুহিনসহ ১৫ জনের বিরুদ্ধে মামলা করেন। সাইদুরের মতোই ভাগ্যের চাকা ঘোরাতে চাঁদপুরের যুবক ইয়াসিন যেতে চেয়েছিলেন স্পেনে। দালাল নুরুল আলম সুমনকে ৪ লাখ টাকা দেন। বাকি টাকা ‘বডি কন্ট্রাক্টে’ স্পেনে পৌঁছানোর পর পরিশোধের চুক্তি হয়। কিন্তু ইয়াসিনকেও নেওয়া হয় টোগোতে। বর্বর নির্যাতন করে ৬ লাখ টাকা আদায় করা হয় ইয়াসিনের পরিবারের কাছ থেকে। অসহ্য নির্যাতন সয়ে স্পেন যাওয়ার স্বপ্ন বাদ দিয়ে প্রাণে বাঁচতে দেশে পালিয়ে আসেন। পল্টন থানায় গত ১৩ জুন নুরুল আলম সুমনসহ ১৫ জনের বিরুদ্ধে মামলা করেন ইয়াসিন।

আর পোল্যান্ডে নেওয়ার কথা বলে ময়মনসিংহের মাসুম সরদারকে মানব পাচারকারীরা নিয়ে গিয়েছিল উজবেকিস্তানে। তিনি ৬ লাখ ৫২ হাজার টাকা দেশে থাকতেই দিয়েছিলেন মানব পাচারকারী ইয়াসির বারীকে। উজবেকিস্তানে একটি জঙ্গলে আটকে রেখে দেশে থাকা স্বজনদের কাছ থেকে আরও সাড়ে ৩ লাখ টাকা নেওয়া হয়। গত ৩ জুন তিনি দেশে পালিয়ে এসে ইয়াসির বারীসহ ছয়জনের বিরুদ্ধে মামলা করেন। এভাবে অনেক তরুণ ভাগ্য ফেরানোর আশায় বিদেশে যাওয়ার জন্য দালালের খপ্পরে পড়ে সর্বস্ব খোয়াচ্ছেন। তাদের অভিজ্ঞতাও করুণ। এদিকে পুলিশের বিশেষ শাখার (এসবি) কর্মকর্তারা বলছেন, ইউরোপের বিভিন্ন দেশে যাওয়ার প্রলোভনে দালালের খপ্পরে পড়ে দেশ ছেড়েছেন এ তরুণ-যুবকরা। তারা রুট হিসেবে ব্যবহার করছেন বৈধ ট্যুরিস্ট ভিসা।

এসবির তথ্য অনুসারে, গত ১৮ মাসে দুবাইয়ের ট্যুরিস্ট ভিসা নিয়ে ১ লাখ ৯৯ হাজার ৮৬৪ জন নারী ও পুরুষ দেশ ছেড়েছেন। তাদের মধ্যে ফেরত এসেছেন মাত্র ২১ হাজার ৭৫৪ জন। ভিসার মেয়াদ শেষ হয়ে গেলেও ১ লাখ ৭৮ হাজার লোক কোথায় আছেন, সে সম্পর্কে ধারণা নেই পুলিশের। এ ছাড়া অন্য দেশের ভিসা নিয়েও ফেরেননি এমন অনেক মানুষ আছেন। এদের বেশির ভাগেরই বয়স ১৬ থেকে ৪০ বছরের মধ্যে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাংলাদেশ থেকে পোল্যান্ডে পাচারের জন্য প্রথমে ঢাকা থেকে দিল্লি নেওয়া হয়। এরপর দিল্লি থেকে বোম্বে হয়ে উজবেকিস্তানে। সেখান থেকে সুযোগ বুঝে সাগর পাড়ি দিয়ে পাঠানো হয় পোল্যান্ডে। এর আগে পাচারকারীরা ভুক্তভোগীদের কাছ থেকে তাদের দাবিকৃত টাকা, কখনো তার  চেয়েও বেশি টাকা জিম্মি করে আদায় করে নেয়।

সিআইডির মানব পাচার শাখার বিশেষ পুলিশ সুপার মুহাম্মদ সাইদুর রহমান খান বলেন, ইউরোপের দেশে গেলেই সোনার হরিণ মিলবে এমন আশা করে কেউ যেন অবৈধ পথে বিদেশ না যায়। কেউ বিদেশ যাওয়ার নামে জিম্মি বা প্রাণহানি হলে তার পরিবার ধ্বংস হয়ে যায়। পাচারকারীদের মিথ্যা আশ্বাসে, কোনো যাচাই-বাছাই না করে বিদেশ যাচ্ছে। সব সময় যে জোর করে পাচার হয় বিষয়টি এমন নয়। অধিকাংশই স্বেচ্ছায় যাচ্ছেন। দুই ধরনের ভুক্তভোগী দেশ থেকে পাচার হচ্ছেন। একটি হলো গৃহকর্মী হিসেবে নিম্নবিত্ত পরিবারের নারী আর অন্যটি তরুণ-যুবক। তাদের এক দেশের কথা বলে অন্য দেশে নিয়ে ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে।

সিআইডির সিরিয়াস ক্রাইম ইউনিটের অতিরিক্ত বিশেষ পুলিশ সুপার এ কে এম আক্তারুজ্জামান এ প্রতিবেদককে জানান, মানব পাচারকারী চক্রের সদস্যরা নতুন নতুন রুট ব্যবহার করছেন। মামলা তদন্তে এসব রুট সম্পর্কে তথ্য পাচ্ছেন তারা। নরসিংদীর একটি চক্র ইউরোপের কথা বলে তরুণদের আফ্রিকার দেশ টোগোতে নিয়ে যাচ্ছে। সম্প্রতি প্রায় দুই বছর টোগোতে আটক থাকার পর পালিয়ে এসেছেন চার যুবক। তাদের করা মামলা তদন্ত করতে গিয়ে অনেক চাঞ্চল্যকর তথ্য পেয়েছেন তারা। কয়েকজন গ্রেফতার হয়েছেন, আরও বেশ কয়েকজন শনাক্ত হয়েছেন। তাদের গ্রেফতার অভিযান অব্যাহত রয়েছে।

 

শরীয়তপুর, মাদারীপুর, কিশোরগঞ্জ, সিলেটসহ দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে অবৈধ পথে ইউরোপের দেশে যাওয়ার চেষ্টা করছেন। অবৈধভাবে সবচেয়ে বেশি যাওয়ার চেষ্টা করছে মাদারীপুরের শিবচর ও শরীয়তপুরের নড়িয়া উপজেলার লোকজন। লাখ লাখ টাকা খরচ করে বিদেশ যেতে গিয়ে অনেকেই নিঃস্ব হয়ে যাচ্ছে। বৈধ পথে বিদেশ যাওয়ার জন্য আহ্বান জানান সিআইডির এ কর্মকর্তা।

র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, ইউরোপে পাঠানোর নাম করে মানুষ পাচার করা অধিকাংশ দালাল মাদারীপুর, গোপালগঞ্জ, সিলেট, সুনামগঞ্জ, নোয়াখালী ও শরীয়তপুর এলাকার। এরা আন্তর্জাতিক মানব পাচার চক্রের এজেন্ট হিসেবে কাজ করে। বিভিন্ন কাজের প্রলোভন দেখিয়ে মোটা অঙ্কের টাকা বেতনের ফাঁদে ফেলে নারী-পুরুষদের পাচার করা হচ্ছে। চক্রের মূল হোতারা দেশের বাইরে বসে থেকে অনলাইন ভিসা ও বিমানের টিকিটের ব্যবস্থা করে। তিনি জানান, এখন পর্যন্ত মানব পাচার বিরোধী সাড়ে ৩০০ অভিযান করেছে র‌্যাব। অভিযানে দালাল চক্রের প্রায় ১ হাজার জন গ্রেফতার হয়েছে। ভুক্তভোগীর তথ্যের ভিত্তিতে মানব পাচারকারীদের তালিকা তৈরি করে প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়েও দেওয়া হয়েছে। ইউরোপে পাচারের জন্য মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোকে ব্যবহার করছে। তথ্য-প্রযুক্তির সহায়তা নিয়েও মানব পাচার করা হচ্ছে। এদের আইনের আওতায় আনতে আমরা তৎপর।

ব্র্যাকের অভিবাসন প্রোগ্রামের প্রধান শরিফুল হাসান বলেন, বিদেশ গিয়ে সব সমস্যার সমাধান করে ফেলব এমন আশা নিয়ে অনেকে দেশ ছাড়ছেন। বিদেশ যাওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে উঠছেন। জেনে-না বুঝে দেশ ছাড়ার পর পাচারকারীদের হাতে পড়ে প্রতারিত হচ্ছেন। ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিচ্ছেন। অবৈধভাবে ইউরোপে যাওয়ার ক্ষেত্রে পৃথিবীর মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান শীর্ষে। এতে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণœ হচ্ছে।

চক্রে জড়িত এয়ারলাইনস ও ব্যাংকের কর্মকর্তা : সিআইডির তদন্তসংশ্লিষ্টরা জানান, অন অ্যারাইভাল ভিসার সুযোগে টোগোতে মানব পাচার করছে চক্রটি। এই চক্রে রয়েছে একটি এয়ারলাইনসের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ও ব্যাংকার। পদ্মা ব্যাংকের নরসিংদী শাখার ওই কর্মকর্তার নাম এ্যানী। তিনি চক্রের হোতা সুমনের স্ত্রী। তার নামে করা ওই শাখার একটি অ্যাকাউন্টে প্রায় ৫০ লাখ টাকার সন্ধান পেয়েছে সিআইডি। এ ছাড়া একটি এয়ারলাইনসের কর্মকর্তা হাসান আহমেদও এই চক্রে আছেন। মামলায় তাকে অভিযুক্ত করা হয়েছে। বিষয়টি টের পেয়ে গত ১৪ জুন আমেরিকায় চলে যান হাসান। তাকে দেশে ফিরিয়ে আনতে পুলিশ সদর দফতরের এনসিবির মাধ্যমে ইন্টারপোলের কাছে চিঠি দিয়েছে সিআইডি।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর