মঙ্গলবার, ১২ অক্টোবর, ২০২১ ০০:০০ টা

বিএনপিতে মামলার আসামি ৩৫ লাখ

লক্ষাধিক মামলা, বছরজুড়েই আদালতে ব্যস্ত নেতা-কর্মীরা, আসামি খালেদা জিয়া থেকে তৃণমূল কর্মী

মাহমুদ আজহার

বিএনপিতে মামলার আসামি ৩৫ লাখ

বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের বিরুদ্ধে ৮৬টি মামলা। এর মধ্যে ৩৫টি স্থগিত করেছে উচ্চ আদালত। বাকিগুলো চলমান। গতকাল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে তিনি জানান, স্থগিত মামলাগুলোও আবার চালুর চেষ্টা করছে সরকার। কিশোরগঞ্জ সদর উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক খালেদ সাইফুল্লাহ খান। দলের এ তরুণ নেতার বিরুদ্ধে গাড়ি পোড়ানো, পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষসহ নানা অভিযোগে ১৬টি মামলা রয়েছে। এর মধ্যে তিনটি মামলায় তার সাড়ে ১০ বছরের সাজাও হয়েছে। অবশ্য উচ্চ আদালত থেকে জামিন নিয়েছেন তিনি। তিনি জানান, ‘প্রতি সপ্তাহে মামলার আপিল শুনানি হয়। সারা বছরই আমাদের সময় কাটে আদালতের বারান্দায়। দলের চেয়ে বেশি ব্যস্ত থাকি আদালতে।’ ৩৪ মামলার আসামি হয়ে রাজধানীর মোহাম্মদপুর থানার সাবেক আন্তর্জাতিকবিষয়ক সম্পাদক এজাজুল হাসান শিবলী দীর্ঘ সময় ঘরছাড়া ছিলেন। এখন উচ্চ আদালত থেকে জামিন নিয়ে প্রকাশ্যে এসেছেন। তিনি জানান, বছরজুড়েই হাজিরার মধ্যে থাকতে হয় তাকে।

শুধু বিএনপির এ তিন নেতার বিরুদ্ধেই নয়, কেন্দ্র থেকে তৃণমূলের ৩৫ লাখ নেতা-কর্মীর বিরুদ্ধে ১ লাখ ৭ হাজার মামলা রয়েছে। সব মামলা ২০০৯ থেকে ২০২১ সালের জুন পর্যন্ত। এর মধ্যে দলের প্রধান বেগম খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে ৩৪টি মামলা রয়েছে। ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের বিরুদ্ধে মামলা ৬৭টি। দলের সর্বাধিক মামলার আসামি বিএনপির যুগ্ম-মহাসচিব হাবিব-উন নবী খান সোহেল। তার বিরুদ্ধে মামলা ২৫৭টি। সর্বশেষ জুনে রাজধানীর চন্দ্রিমা উদ্যানে বিএনপির সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষের ঘটনায় ৩৫টি মামলা হয়। সেখানে আসামি সহস্রাধিক নেতা-কর্মী।

এ প্রসঙ্গে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘আমাদের ৩৫ লাখ নেতা-কর্মীর বিরুদ্ধে লক্ষাধিক মামলা হয়েছে। আমাদের প্রায় প্রতিদিনই আদালতের দ্বারে দ্বারে ঘুরতে হচ্ছে। দলের প্রধান বেগম খালেদা জিয়া, ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান থেকে শুরু করে তৃণমূল নেতা-কর্মীরা পর্যন্ত এসব মিথ্যা মামলার আসামি। অনেকেই মামলার জালে জড়িয়ে বাড়িঘরছাড়া। এমনও মামলা হয়েছে যেখানে কোনো ঘটনাই ঘটেনি। এমনকি বাদী নিজেও জানেন না। অর্থাৎ বিএনপিকে নির্মূল করাই সরকারের উদ্দেশ্য।’

জানা যায়, মামলাগুলো দেখভালের জন্য বিএনপি সমর্থিত আইনজীবীদের নিয়ে একটি সেল গঠন করা হয়েছে। একইভাবে মামলার হিসাব রাখতে দলের দফতর শাখার পৃথক আরেকটি সেল করা হয়েছে। বিএনপি বলছে, এসব মামলা রাজনৈতিক উদেশ্যপ্রণোদিত। বিশেষ করে পরপর দুই নির্বাচনে আন্দোলনের সময় ভাঙচুর, গাড়ি পোড়ানো, পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষ, সরকারি কাজে বাধাদানসহ নানা অভিযোগে এসব মামলা হয়েছে।

বিএনপির দফতর সূত্র জানান, স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেনের ১১, ব্যারিস্টার জমিরউদ্দিন সরকারের ৪, ব্যারিস্টার রফিকুল ইসলাম মিয়ার ৬, মির্জা আব্বাসের ৫৪, গয়েশ্বর রায়ের ৫৯, নজরুল ইসলাম খানের ৩, আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরীর ১৩, সেলিমা রহমানের ৬, ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকুর ৯ এবং ভারতের শিলংয়ে থাকা সালাহউদ্দিন আহমদের বিরুদ্ধে ১৭টি মামলা রয়েছে।

বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান মেজর (অব.) হাফিজউদ্দিন আহমদের ৪, ব্যারিস্টার শাহজাহান ওমরের ৪, আলতাফ হোসেন চৌধুরীর ৬, আবদুল্লাহ আল নোমানের ৪, বরকতউল্লা বুলুর ২৭, মো. শাহজাহানের ২৮, আবদুল আউয়াল মিন্টুর ৬, অধ্যাপক এ জেড এম জাহিদ হোসেনের ২৪, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা আমানউল্লাহ আমানের ১২৩, আবদুস সালামের ৩৭, মিজানুর রহমান মিনুর ৩৭, জয়নুল আবদীন ফারুকের ২৩, সিনিয়র যুগ্ম-মহাসচিব রুহুল কবির রিজভীর ১৩৪, যুগ্ম-মহাসচিব ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকনের ১৩, মজিবর রহমান সরোয়ারের ৫৭, সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলালের ১৩৪ ও খায়রুল কবীর খোকনের বিরুদ্ধে ৫৭টি মামলা রয়েছে।

এ ছাড়া সাংগঠনিক সম্পাদক রুহুল কুদ্দুস তালুকদার দুলুর ১০৭, আসাদুল হাবিব দুলুর ৫৭, প্রশিক্ষণবিষয়ক সম্পাদক এ বি এম মোশাররফের ৪৭, যুবদল সভাপতি সাইফুল আলম নীরবের ৮৬, সাধারণ সম্পাদক সুলতান সালাউদ্দিন টুকুর ১৫৩, স্বেচ্ছাসেবক দল সাধারণ সম্পাদক আবদুল কাদির ভূইয়া জুয়েলের ৫৩ ও ঢাকা মহানগরী উত্তর বিএনপির সদস্যসচিব ফুটবলার আমিনুল হকের বিরুদ্ধে ১৩টি মামলা রয়েছে।

বিএনপির দায়িত্বশীল তিনজন নেতা জানান, সরকার বিএনপিকে মামলা দিয়েই কাবু রাখতে চায়। তাই শুরু থেকেই কেন্দ্র থেকে তৃণমূল নেতা-কর্মীকে রাজনৈতিক মামলার আসামি করে রেখেছে। আর সারা বছরই নেতা-কর্মীরা এখন ব্যস্ত আদালতপাড়ায়। এমন অনেকেই আছেন গ্রেফতারি পরোয়ানা নিয়ে ঘুরছেন। অনেকেই আছেন যারা জামিন নিতে নিতে ত্যক্তবিরক্ত হয়ে আর আদালতেই যাচ্ছেন না। একপর্যায়ে তাদের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হয়। কখনো কখনো সংশ্লিষ্টদের গ্রেফতারও করা হচ্ছে। সরকারের মূল উদ্দেশ্য বিএনপিকে মামলায় সাজা দিয়ে নির্বাচনে অযোগ্য করা। অবশ্য এরই মধ্যে তারা অনেকটা সফলও। দলের চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া ও ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে দুর্নীতির একাধিক মামলায় সাজাও দিয়েছে। যে কারণে গত নির্বাচনে দলের দুই শীর্ষ নেতা ভোটে অংশ নিতে পারেননি।

বিএনপির আইনজীবী নেতারা বলছেন, দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে ও পরে আন্দোলনে ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ ও হত্যাকান্ডের অভিযোগে রাজনৈতিক মামলার বিচার কার্যক্রম দ্রুতগতিতে চলছে। দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনের আগে এমনকি আগামী দুই মাসের মধ্যে কয়েকটি মামলার রায় হতে পারে। ২০১৩-২০১৫ সালে করা এসব রাজনৈতিক মামলায় বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য, মধ্যমসারি ও তৃণমূলের অনেক নেতাই আসামি। ধারণা করা হচ্ছে, বিচারে অনেকের সাজাও হতে পারে এসব মামলায়।

বিএনপি সমর্থিত আইনজীবী নেতাদের অভিযোগ, আগামী দিনে নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকারের দাবিতে আন্দোলন ঠেকানোর পাশাপাশি নির্বাচনে অযোগ্য করতেই সরকার তড়িঘড়ি করছে। এসব মামলার বিচার কার্যক্রম শেষ করার পেছনে সরকারের দুরভিসন্ধি আছে। একই ধরনের মামলা কোনোটির তারিখ পড়ছে এক থেকে দুই সপ্তাহের মধ্যেই। আবার কোনোটির ২০২২ সালের জানুয়ারিতে। তারিখ দ্রুত পড়ার বিষয়ে আদালত-সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, মামলাগুলো স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে দ্রুত শেষ করতে বলা হয়েছে। বিশেষ উদ্দেশ্যে মামলাগুলোর দ্রুত বিচারকাজ করা হচ্ছে বলে মনে হচ্ছে।

এ প্রসঙ্গে বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য, সিনিয়র আইনজীবী ব্যারিস্টার জমিরউদ্দিন সরকার বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘রাজনৈতিক মামলাগুলোর বিচার কার্যক্রমে দ্রুতগতি দেখে মনে হচ্ছে সরকারের কোনো অসৎ উদ্দেশ্য আছে। বিএনপি নেতাদের সাজা দিয়ে ভোটে অযোগ্য করতে চায় সরকার। এ ছাড়া বিএনপি যখন নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকার দাবিতে আন্দোলনে যাওয়ার কথা ভাবছে তখনই মামলার বিচার কার্যক্রমে গতি আনা হয়েছে। কার্যত আন্দোলন বাধাগ্রস্ত করে বিএনপি নেতাদের ভয়ভীতি দেখাতেই এসব করা হচ্ছে। স্বাভাবিকভাবেই নেতা-কর্মীদের মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করছে।’

দলীয় সূত্র বলছেন, বিএনপি নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে এমনও মামলা হয়েছে যার বাদীও এ সম্পর্কে কিছুই জানেন না। ২০২০ সালের অক্টোবরে খিলক্ষেত থানার একাধিক মামলায় বিএনপির ১১৪ নেতা-কর্মীকে আসামি করা হয়। এজাহারে বাদী হিসেবে যার নাম রয়েছে তার দাবি, মামলা তিনি করেননি। ওই মামলায় আসামিদের মধ্যে রয়েছেন গয়েশ্বর চন্দ্র রায় ও ইশরাক হোসেন। বাস পোড়ানো, ভাঙচুর ও সরকারি কাজে বাধা দেওয়ার ঘটনায় পুলিশ সব মিলিয়ে ১৩টি মামলা করেছে। এতে মোট আসামি ৬৪৭ জন। বাস পোড়ানোর ঘটনায় রাজধানীর খিলক্ষেত থানায় করা একটি মামলায় বিএনপির ১১৪ জন নেতা-কর্মীকে আসামি করা হয়েছে। ওই মামলার এজাহারে বলা হয়েছে, পূর্বপরিকল্পিতভাবে বাসের স্টাফদের হত্যার উদ্দেশ্যে পেট্রোলবোমা ছুড়ে জানালার কাচ ভাঙচুর করেছেন আসামিরা। তবে এজাহারে বাদী হিসেবে নাম থাকা দুলাল হাওলাদারের দাবি, মামলাটি তিনি করেননি। আসামিদেরও চেনেন না। সবকিছু করেছে খিলক্ষেত থানা-পুলিশ।

সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি, বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট জয়নুল আবেদীন বলেন, ‘বিএনপি নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে মামলাগুলোর বিচার কার্যক্রমের অবস্থা দেখেই বোঝা যায় সরকারের কী উদ্দেশ্য। বিএনপি সামনে আন্দোলনে যাবে তা বাধাগ্রস্ত করতে চায় সরকার। তা ছাড়া দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনে বিএনপির সিনিয়র ও মধ্যসারির নেতারা যাতে অংশ না নিতে পারেন সে ধরনের অপতৎপরতাও চলছে। ন্যায়বিচার হলে এসব মামলা ধোপে টিকবে না। আমরাও শেষ পর্যন্ত আইনি লড়াই চালিয়ে যাব।’

সর্বশেষ খবর