মঙ্গলবার, ১২ অক্টোবর, ২০২১ ০০:০০ টা

নাট্যজন ইনামুল হক আর নেই

সাংস্কৃতিক প্রতিবেদক

নাট্যজন ইনামুল হক আর নেই

নাট্যাঙ্গনের অগণিত সহকর্মী, সুহৃদ ও দর্শককে শোকের সাগরে ভাসিয়ে না-ফেরার দেশে পাড়ি জমালেন বুয়েটের সাবেক শিক্ষক ও স্বাধীনতা পদকপ্রাপ্ত নাট্যব্যক্তিত্ব ড. ইনামুল হক। গতকাল বিকাল ৩টার দিকে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে বেইলি রোডের  বাসভবনে তিনি শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন। তাঁর বয়স হয়েছিল ৭৮ বছর। তিনি স্ত্রী অভিনেত্রী ও নির্দেশক লাকী ইনাম ও দুই মেয়ে হৃদি হক, পৈতি হকসহ অসংখ্য গুণগ্রাহী ও স্বজন রেখে গেছেন। মৃত্যুর সংবাদ শুনে বেইলি রোডের বাসভবনে ছুটে যান সাংস্কৃতিক অঙ্গনের মানুষেরা।

ড. ইনামুল হকের মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এক শোকবার্তায় প্রধানমন্ত্রী বলেন, নাট্যাঙ্গনে ইনামুল হকের অবদান স্মরণীয় হয়ে থাকবে। প্রধানমন্ত্রী মরহুমের আত্মার মাগফিরাত কামনা করেন এবং শোকসন্তপ্ত পরিবারের সদস্যদের প্রতি গভীর সমবেদনা জানান। আরও শোক প্রকাশ করেন জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জাসদ সভাপতি হাসানুল হক ইনু এমপি ও সাধারণ সম্পাদক শিরিন আখতার এমপি। এক শোকবার্তায় তাঁরা বলেন, ড. ইনামুল হকের মৃত্যুতে দেশের সাংস্কৃতিক অঙ্গনের অপূরণীয় ক্ষতি হলো। তাঁর মৃত্যুতে শোক জানিয়েছেন গণদল চেয়ারম্যান এ টি এম গোলাম মাওলা চৌধুরী।

সন্ধ্যায় সেগুনবাগিচার কোয়ান্টাম মেথডে গোসল শেষে লাশ নেওয়া হয় বেইলি রোডের বাসভবনে। সন্ধ্যা সাড়ে ৭টায় সহকর্মীদের শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য লাশ শিল্পকলা একাডেমিতে আনা হয়। সেখানে সর্বস্তরের নাট্যকর্মী তাঁকে ফুলেল শ্রদ্ধায় সিক্ত করেন।

এরপর লাশ রাখা হয় রাজধানীর একটি বেসরকারি হাসপাতালের হিমাগারে। সর্বস্তরের মানুষের শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য আজ বেলা ১১টায় লাশ নেওয়া হবে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে। দুপুর সাড়ে ১২টা পর্যন্ত কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে শ্রদ্ধাঞ্জলি পর্ব হবে। এরপর বুয়েট খেলার মাঠে জানাজা শেষে মিপুরের শহীদ বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে দাফনের বিষয়ে পরিবারের পক্ষ থেকে চেষ্টা চলছে। তবে এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত দাফনের বিষয়ে বিস্তারিত জানা যায়নি। ১৯৪৩ সালের ২৯ মে ফেনী জেলায় জন্মগ্রহণ করেন ড. ইনামুল হক। তাঁর বাবার নাম ওবায়দুল হক, মায়ের নাম রাজিয়া খাতুন। ফেনী পাইলট উচ্চবিদ্যালয় থেকে মাধ্যমিক ও ঢাকার নটর ডেম কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক পাসের পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি রসায়নে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। এরপর যুক্তরাজ্যের ম্যানচেস্টার বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৬৫ সালে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) রসায়ন বিভাগে প্রভাষক হিসেবে যোগ দেন ড. ইনামুল হক। ১৯৭০ সালে সহকারী অধ্যাপক, ১৯৭৯ সালে সহযোগী অধ্যাপক এবং ১৯৮৭ সালে অধ্যাপক পদে উন্নীত হন। আর বুয়েট থেকেই কর্মজীবনের অবসর নেন। তিনি ছিলেন একাধারে নাট্যকার, অভিনেতা ও লেখক। ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানে জনগণকে উদ্বুদ্ধ করার প্রয়াসে বিভিন্ন আন্দোলনমুখী নাটকে অংশগ্রহণ করেন ইনামুল হক। ১৯৭০ সালে সামরিক শাসন উপেক্ষা করে তৎকালীন অসহযোগ আন্দোলনে যোগ দেন। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে ট্রাকে করে ঢাকা শহরের বিভিন্ন স্থানে পথনাটক করেন।

নটর ডেম কলেজে পড়ার সময় ড. ইনামুল হক প্রথম মঞ্চনাটকে অভিনয় শুরু করেন। ফাদার গাঙ্গুলীর নির্দেশনায় তাঁর প্রথম নাটক ‘ভাড়াটে চাই’। ১৯৬৮ সালে বুয়েট ক্যাম্পাসে নাগরিক নাট্যসম্প্রদায়ের শুরু। এ দলের হয়ে প্রথম তিনি মঞ্চে অভিনয় করেন আতাউর রহমানের নির্দেশনায় ‘বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রো’ নাটকে। এরপর ‘দেওয়ান গাজীর কিসসা’, ‘নূরুলদীনের সারাজীবন’সহ আরও বহু নাটকে অভিনয় করেন। ১৯৯৫ সালে ড. ইনামুল হক নাগরিক নাট্যসম্প্রদায় থেকে বের হয়ে প্রতিষ্ঠা করেন নাগরিক নাট্যাঙ্গন। এ দলের হয়ে ‘জনতার রঙ্গশালা’, ‘সরমা’সহ আরও বেশ কয়েকটি নাটকে অভিনয় করেন ইনামুল হক। ২০০০ সালে ড. ইনামুল হক প্রতিষ্ঠা করেন ‘নাগরিক নাট্যাঙ্গন ইনস্টিটিউট অব ড্রামা’ নামের আরেকটি প্রতিষ্ঠান। তাঁর অভিনীত প্রথম টিভি নাটক মুস্তাফা মনোয়ার পরিচালিত ‘মুখরা রমণী বশীকরণ’। ইতিমধ্যে তাঁর ১৮টি নাটক বিভিন্ন নাট্যপত্রে, বিশেষ ম্যাগাজিনে এবং বই আকারে প্রকাশিত হয়েছে। ইনামুল হকের উল্লেখযোগ্য বইয়ের মধ্যে রয়েছে- নির্জন সৈকতে, গৃহবাসী, মুক্তিযুদ্ধ নাটকসমগ্র, স্ট্রিন্ডবার্গের দু’টো নাটক, মহাকালের ঘোড়সওয়ার, বাংলা আমার বাংলা ইত্যাদি।

নাটকে বিশেষ অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে ২০১২ সালে তিনি একুশে পদক, ২০১৭ সালে স্বাধীনতা পুরস্কার অর্জন করেন।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর