বুধবার, ১২ জানুয়ারি, ২০২২ ০০:০০ টা

ধরপাকড় নারায়ণগঞ্জে

রফিকুল ইসলাম রনি ও আরাফাত মুন্না, নারায়ণগঞ্জ থেকে

ধরপাকড় নারায়ণগঞ্জে

নির্বাচন ঘনিয়ে আসতেই উত্তাপ ছড়িয়ে পড়ছে নারায়ণগঞ্জে। সিটি ভোটে স্বতন্ত্র প্রার্থী তৈমূর আলম খন্দকারের প্রচার-প্রচারণায় বাধাসহ তার কর্মী-সমর্থকদের ব্যাপক ধরপাকড় ও হয়রানির অভিযোগ উঠেছে। শুধু স্বতন্ত্র মেয়র প্রার্থীই নন, বিএনপির বিভিন্ন পদে থাকা কাউন্সিলর প্রার্থী, এমনকি আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীদের বাড়িতেও অভিযানের অভিযোগ উঠেছে। গত কয়েক দিনে জেলা বিএনপির আহ্বায়ক মনিরুল ইসলাম রবিসহ ১৭ নেতা-কর্মীকে আটকের দাবি করা হয়েছে সদ্য বিএনপি থেকে অব্যাহতি পাওয়া এই স্বতন্ত্র মেয়র প্রার্থীর পক্ষ থেকে। একইভাবে ৩৭ নেতা-কর্মীর বাড়িতে তল্লাশির নামে বাড়িছাড়া করার অভিযোগ উঠেছে।

সদ্য বিলুপ্ত নারায়ণগঞ্জ মহানগর ছাত্রলীগ সভাপতি রিয়াদসহ বিভিন্ন ব্যক্তির বাড়িতে পুলিশের অভিযানে নির্বাচনের সুষ্ঠু পরিবেশ নিয়ে শঙ্কা তৈরি হয়েছে। স্বতন্ত্র প্রার্থীর অভিযোগ- আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতা, দলীয় প্রার্থীর পক্ষে ভোটের মাঠে প্রভাব খাটাতেই এটা ঘটানো হচ্ছে। অন্যদিকে এ অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করে আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থী সেলিনা হায়াৎ আইভী বলেছেন, ‘নির্বাচনে প্রভাব বিস্তার করার মতো লোকবল ও প্রশাসন আমার নেই।’ এ প্রসঙ্গে নারায়ণগঞ্জের পুলিশ সুপার মোহাম্মদ জায়েদুল আলম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘তৈমূরের অভিযোগ ভিত্তিহীন। কাউকে আটক বা গ্রেফতারের বিষয়ে আমার কিছুই জানা নেই। বিষয়টি আপনাদের কাছ থেকেই শুনলাম।’

গতকাল সকালে সংবাদ সম্মেলনে স্বতন্ত্র প্রার্থী অ্যাডভোকেট তৈমূর আলম খন্দকার অভিযোগ করেন, মনিরুল ইসলাম রবি সিদ্ধিরগঞ্জে তাঁর নির্বাচন সমন্বয়ক। তার কাছে নির্বাচনের সব এজেন্টের নিয়োগসহ অন্যান্য কাগজপত্র রয়েছে। সোমবার তাকে গ্রেফতার করা হয়। রবিকে আগে গ্রেফতার করা হলো না কেন- এমন প্রশ্ন রেখে তৈমূর বলেন, ‘আমি যেদিন মনোনয়নপত্র কিনেছিলাম সেদিন তিনি পাশে ছিলেন। যেদিন জমা দিই সেদিনও তিনি ছিলেন, যেদিন বাছাই হয় সেদিনও রবি পাশে ছিলেন। মার্কা বরাদ্দের দিনও আমার সঙ্গে ছিলেন। তখন তো তাকে গ্রেফতার করা হয়নি।’ তৈমূর দাবি করেন, সোমবার রাতেও তাঁর ৩৭ নেতা-কর্মীর বাড়িতে তল্লাশি এবং ১৭ জনকে আটক করা হয়েছে। রাতে পোশাকে, সাদা পোশাকে বাড়ি বাড়ি তল্লাশি চলছে। বাড়ি থেকে তুলে নেওয়ার পর থানায় যোগাযোগ করলে জানানো হয় তারা কিছু জানেন না।

নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনে আওয়ামী লীগের প্রার্থীর পক্ষে কাজ করছেন এমন কয়েকজন স্থানীয় নেতা জানিয়েছেন, নির্বাচনের আগমুহূর্তে ধরপাকড় ভোটের সুষ্ঠু পরিবেশ নষ্ট করছে। এমনিতে নারায়ণগঞ্জ নৌকার ঘাঁটি। নৌকার পক্ষে কাজ করাতে জোরজবরদস্তি কিংবা স্বতন্ত্র প্রার্থীর কর্মী-সমর্থকদের এমন হয়রানির কারণে নির্বাচনী ফলাফল অনুকূলে না-ও আসতে পারে।

ছাত্রলীগ নারায়ণগঞ্জ মহানগর কমিটি শনিবার দুপুরে বিলুপ্ত করা হয়। সেদিন রাতেই ওই বিলুপ্ত কমিটির সভাপতি হাবিবুর রহমান রিয়াদের বাড়িতে হানা দিয়েছে পুলিশ। ওই দিন তিনি সাংবাদিকদের বলেছিলেন, ‘তারা (পুলিশ) আমাকে মেয়র আইভীর পক্ষে কাজ করার জন্য চাপ প্রয়োগ করে।’ একই দিন নিতাইগঞ্জে ছাত্রলীগ নেতা কাউসার আহমেদ, বিএনপি নেতা মো. জুলহাস, বন্দরের ধামগড় ইউনিয়নের নবনির্বাচিত চেয়ারম্যান জেলা যুবসংহতির সদস্যসচিব কামাল হোসেনের বাসায় অভিযান চালায় পুলিশ। কামাল হোসেনকে না পেয়ে তার বাড়ির কেয়ারটেকার খোরশেদ আলমকে আটক করা হয়। এ ছাড়া পুলিশ পরিচয়ে আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের অনেকের কাছে ফোন করে নৌকার প্রার্থীর পক্ষে প্রচারণায় নামতে বলা হয় বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।

নির্বাচনে ধরপাকড়ের শঙ্কার কথা জানিয়ে ‘আমরা নারায়ণগঞ্জবাসী’ সংগঠনের সভাপতি হাজী নূরউদ্দিন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘নির্বাচনে প্রচার-প্রচারণা নিয়ে কোনো প্রার্থী, বিশেষ করে তৈমূর বা আইভী কাউকে বাধা দেওয়া হচ্ছে না। তৈমূরের নির্বাচনী কর্মীকে আটক করা হয়েছে। আবার ছাত্রলীগ নেতার বাড়িতেও পুলিশ গিয়েছে। এটাও কিন্তু তাদের জন্য আঘাত। তবে আমি মনে করি ভোটের আর মাত্র চার দিন বাকি। এ সময়টার মধ্যে উচিত হবে দ্বন্দ্ব-সংঘাত ছাড়া একটি সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য সবাইকে সুযোগ করে দেওয়া। এসব ধরপাকড় বন্ধ করতে হবে। নির্বাচনী পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে হবে।’এদিকে যুবদলের প্রধান সমন্বয়ক মাজাহারুল ইসলাম জোসেফ, বন্দর থানা বিএনপি সাধারণ সম্পাদক মাজাহারুল ইসলাম ভূঁইয়া হিরণ, নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের ৬ নম্বর ওয়ার্ড বিএনপি সভাপতি অখিল উদ্দিন ভূঁইয়া, মহানগর শ্রমিক দল সভাপতি এস এম আসলাম, ৪ নম্বর ওয়ার্ড বিএনপি সভাপতি টি এইচ তোফা, বন্দর ২২ নম্বর ওয়ার্ড যুবদল সভাপতি কাজী সোহাগ, বন্দর থানা যুবদলের সহসভাপতি সোহেল খান বাবুসহ ৩৭ নেতা-কর্মীর বাড়িতে তল্লাশি চালানোর পাশাপাশি হুমকি-ধমকি দেওয়া হয়েছে। গতকাল সকালে তৈমূর আলম খন্দকারের সংবাদ সম্মেলনে রেশমী আক্তার নামে একজন অভিযোগ করেন, সোমবার দিবাগত রাত ৩টার দিকে তাদের বাড়িতে পোশাক ও সাদা পোশাকে চার গাড়ি পুলিশ যায়। বাড়ি থেকে তার স্বামী মোশারফ হোসেনকে তুলে নিয়ে গেলেও তার কোনো খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। তৈমূরের পক্ষে নির্বাচনী প্রচারণা চালানোয় তার স্বামীকে এর আগে কয়েক দফা হুমকি দেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ করেন তিনি। এ বিষয়ে স্বতন্ত্র মেয়র প্রার্থী তৈমূর আলম খন্দকারের প্রধান নির্বাচনী এজেন্ট ও নারায়ণগঞ্জ মহানগর বিএনপি সাধারণ সম্পাদক এ টি এম কামাল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘সরকারি দলের মেয়র প্রার্থীর নির্বাচনী দায়িত্বে থাকা আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতা জাহাঙ্গীর কবির নানক কয়েক দিন ধরেই বলে আসছেন ‘ঘুঘু দেখেছ ফাঁদ দেখনি, ২৪ ঘণ্টার মধ্যে দেখতে পাবে, তৈমূরকে মাঠে নামতে দেওয়া হবে না।’ মূলত নারায়ণগঞ্জে তৈমূরের কর্মী-সমর্থকদের আটক ও বাড়ি বাড়ি তল্লাশির পেছনে নানকের সেই হুমকির প্রতিফলনই ঘটছে। প্রশাসন কী করছে তা আর বুঝতে বাকি নেই। সরকার মূলত ভোট উৎসবের নামে একটি প্রহসনের ভোট আয়োজন করতে যাচ্ছে। আমরা সত্যি এ নির্বাচন নিয়ে সংশয় ও শঙ্কার মধ্যে আছি।’ এ বিষয়ে স্বতন্ত্র মেয়র প্রার্থী এ বি এম সিরাজুল মামুন (দেয়ালঘড়ি) বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘কয়েক দিন ধরেই নির্বাচনের পরিবেশ খুব খারাপ হয়ে যাচ্ছে। বিশেষ করে সরকারি দলের দুজন নেতার মধ্যে অন্তর্দ্বন্দ্ব ও বিভিন্ন ধরনের কথাবার্তা চলছে। এ নিয়ে ভোটারদের মধ্যে বিরূপ প্রভাব পড়ছে। কয়েক দিন ধরে দেখতে পাচ্ছি নির্বাচনের সুষ্ঠু ও সুন্দর পরিবেশ নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। আমরা আসলেই এ বিষয়ে বিভিন্ন সমস্যার মধ্যে আছি। সরকারের উচিত হবে নির্বাচন কমিশনের মাধ্যমে অচিরেই এ অবস্থার পরিবর্তন ঘটিয়ে সুষ্ঠু ও সুন্দর পরিবেশে নির্বাচনের ব্যবস্থা করা।’ এ বিষয়ে নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের ২ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর প্রার্থী, বিএনপি নেতা ইকবাল হোসেন বলেন, ‘নির্বাচন নিয়ে কিছুটা শঙ্কার মধ্যে আছি। কারণ আমার প্রতিদ্বন্দ্বী দুই প্রার্থী আমার কর্মী-সমর্থকদের নানা ধরনের হুমকি-ধমকির মধ্যে রাখছেন এবং চাপ প্রয়োগ করছেন। আমি এ নিয়ে নির্বাচন কমিশনের হস্তক্ষেপ কামনা করছি এবং আশা করি সুষ্ঠু-সুন্দর পরিবেশে নির্বাচন সম্পন্ন হবে।’

করোনার ঝুঁকি থাকলেও নাসিক নির্বাচন যথাসময়ে হবে : করোনাভাইরাসের প্রকোপ বেড়ে যাওয়ার পর সরকার কিছু বিধিনিষেধ জারি করলেও তফসিল ঘোষিত সময়ে নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন (নাসিক) অনুষ্ঠান করতে চায় নির্বাচন কমিশন। আগামী ১৬ জানুয়ারি এই সিটিতে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা। নির্ধারিত সময়েই তা অনুষ্ঠিত হবে বলে জানিয়েছেন ইসির অতিরিক্ত সচিব অশোক কুমার দেবনাথ। অবশ্য করোনা পরিস্থিতির অবনতি হলে তফসিল ঘোষিত ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) নির্বাচনের বিষয়ে ইসির নতুন সিদ্ধান্ত আসতে পারে বলে জানা গেছে।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর