শুক্রবার, ১১ মার্চ, ২০২২ ০০:০০ টা

ক্লাস বন্ধ করতে গ্রেনেড ছুড়ি

মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন

ক্লাস বন্ধ করতে গ্রেনেড ছুড়ি

১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশ লিবারেশন ফ্রন্টের (বিএলএফ) অধীনে আমি রাজনৈতিক, সামরিক ট্রেনিং নিয়েছি। ভারতের হাফলং এবং দেরাদুনে আমাদের ট্রেনিং হয়েছিল। আমি মুজিব বাহিনীর চার নেতা শেখ ফজলুল হক মণি, সিরাজুল আলম খান, আবদুর রাজ্জাক, তোফায়েল আহমেদের সঙ্গে ছিলাম। এ ছাড়া ছিলেন হাসানুল হক ইনু, ছাত্রলীগের তৎকালীন ট্রেজারার ফারুক। আমাদের প্রশিক্ষক ছিলেন মেজর জেনারেল এস এস উবান। আমাদের চার নেতাকে উনি বাসায় রাখতেন। আমাদের ট্রেনিংয়ের বিষয়ে উনি সবকিছু জানতেন। গেরিলা ট্রেনিংয়ে তার অভাবনীয় অভিজ্ঞতা ছিল। আমি যখন ট্রেনিং নিয়ে ঢাকায় আসলাম তখন কেরানীগঞ্জ, ডেমরা, মাতুয়াইলে থাকতাম। ভারতে এক মাস ট্রেনিং নিয়েছি। এরপর মে-জুনে আগরতলায় আসি। আমি তখন কেরানীগঞ্জে আছি। হঠাৎ শুনলাম ঢাকা মেডিকেল কলেজে সব ক্লাস স্বাভাবিকভাবে চলছে। শিক্ষকরা ক্লাসে আসছেন, শিক্ষার্থীরা নিয়মিত ক্লাস করছেন। দেশে মুক্তিযুদ্ধ চলছে, লাখো মানুষ শহীদ হচ্ছেন। আর তারা পাকিস্তান সরকারের নিয়ম মেনে ক্লাস করবে, এটা আমার সহ্য হলো না। তখন আমাদের ওপর নির্দেশনা এলো, কিছু একটা কর যাতে কলেজ, হাসপাতাল বন্ধ হয়ে যায়। তখন পরিকল্পনা করে আমরা ঢাকা মেডিকেল কলেজের ডিসেকশান হলের পাশ দিয়ে মোটরসাইকেল নিয়ে গিয়ে গ্রেনেড ফাটাই। এতে আমার এক সহপাঠী আহত হয়। তার পায়ের কিছু অংশ উড়ে যায়। এ ঘটনায় ক্লাস, ক্যাম্পাস, হাসপাতাল বন্ধ হয়ে যায়। মুজিব বাহিনীর ছেলেরা এসব অপারেশনে সঙ্গে ছিলেন। আমি তখন মাতুয়াইলে থাকতাম। পাকিস্তানি সেনারা একবার আমাকে ধরতে অভিযান চালাল। অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে খেতের আইল দিয়ে দৌড়াতে দৌড়াতে নারায়ণগঞ্জের পাগলায় গিয়ে উঠলাম। ওখানে আজিজের বাসায় উঠলাম। ওই এলাকায় মুক্তিযোদ্ধারা আমাকে সহযোগিতা করেছেন। আর্ট কলেজে একইভাবে আমরা অভিযান পরিচালনার পরিকল্পনা করেছি। সবাইকে বলেছি ঠিক ১০টায় মোটরসাইকেল নিয়ে আসতে। গ্রেনেড আমার কাছে ছিল। আমার লালবাগের বাসার দরজায় হঠাৎ কড়া নাড়ল। আমি ভেবেছি মুজিব বাহিনীর ছেলেরা এসেছে। কিন্তু দরজা খুলে দেখি পাকিস্তানি সেনারা অস্ত্র হাতে দাঁড়িয়ে। তারা ঘরে ঢুকেই অস্ত্র উঁচিয়ে আমাকে হাত তুলে দাঁড়াতে বলল। আমাদের বাড়ি থেকে বের হওয়ার চারটা রাস্তা ছিল। নিচের তিন রাস্তাতেই তারা সেনা মোতায়েন করে রেখেছিল। রেকি করে তারা সব খবর নিয়ে রেখেছিল। আমি দৌড়ে দোতালায় উঠে পাশের বাসাতে লাফ দেই। ওই এলাকার ছাদগুলো এক সমান্তরালে ছিল। আমি দৌড়ে অনেক দূর গিয়ে উঠি। আমাকে ধরতে না পেরে তারা গুলি ছোড়ে। আমার বড় বোন বন্দুকের বাট উঁচিয়ে রাখায় আমার মাথার ওপর দিয়ে গুলি চলে যায়। আমাকে না পেয়ে তারা আমার বড়ভাই মোস্তফা কামাল মহিউদ্দিনকে ধরে নিয়ে যায়। সে তখন জগন্নাথ কলেজের বিকম ফাইনাল ইয়ারের ছাত্র। পরে দেশ স্বাধীন হয়ে যাওয়ার পরে আমরা ওই দলে থাকা ইঞ্জিনিয়ারিং কোরের এক সিপাহির কাছে আমার ভাইকে মেরে ফেলার মর্মান্তিক ঘটনা শুনেছি। 

লেখক : আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী পরিষদের সদস্য ও বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) সভাপতি।

সর্বশেষ খবর