মঙ্গলবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২২ ০০:০০ টা
সাংবাদিকদের সঙ্গে মতবিনিময়

অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনে আস্থার সংকট কমানোর পরামর্শ

জোর করে কাউকে ভোটে আনা সম্ভব নয় : সিইসি

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল বলেছেন, কেউ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে কি করবে না এতে জোর (ফোর্স) করা নির্বাচন কমিশনের পক্ষে সম্ভব নয়। তবে কমিশনের দায়িত্ব থাকবে সবাইকে নির্বাচনে অংশ নিতে আহ্বান জানানো। সব দল নির্বাচনে অংশ না নিলে তা প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হবে না। গণতন্ত্র বিকশিত হবে না। গতকাল ইলেকট্রনিক ও অনলাইন মিডিয়ার সিনিয়র সাংবাদিকদের সঙ্গে আয়োজিত সংলাপের সমাপনী বক্তব্যে সিইসি এ কথা বলেন। সংলাপে সিইসি বলেন, একটি সুন্দর ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য সবাইকে চেষ্টা করতে হবে। ইসি যে সংলাপ করছে তা অর্থহীন নয়। রাজনৈতিক দলগুলোকে নির্বাচনে আনার ক্ষেত্রে ইসির ভূমিকা নিয়ে আজকের সংলাপে দুই ধরনের মত উঠে আসে। কেউ কেউ বলেছেন, সব দলকে নির্বাচনে আনতে সচেষ্ট হতে হবে। আস্থার পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে। আস্থার সংকট ইসির মূল চ্যালেঞ্জ। তবে কেউ কেউ বলেছেন, কোনো দল নির্বাচনে আসবে কি আসবে না তা সে দলের রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। এখানে ইসির কিছু করণীয় নেই।

ইসিসূত্র জানান, সংলাপে দেশের বিভিন্ন ইলেকট্রনিক গণমাধ্যমের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা, হেড অব নিউজ, প্রধান বার্তা সম্পাদক, বার্তা সম্পাদকসহ ৩৯ জন সিনিয়র সাংবাদিককে আমন্ত্রণ জানানো হয়। তবে উপস্থিত ছিলেন ২৭ জন।

অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনে আস্থার সংকট কাটানোর পরামর্শ : রাজনৈতিক দলগুলোকে ভোটে আনতে আস্থার সংকট কাটিয়ে উদ্যোগী হতে নির্বাচন কমিশনকে পরামর্শ দিয়েছেন সিনিয়র সাংবাদিকরা। সেই সঙ্গে সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের লক্ষ্যে বিদ্যমান আইনের দৃশ্যমান পদক্ষেপ নেওয়ার তাগিদ দিয়েছেন তাঁরা। কেউ কেউ ইসি কর্মকর্তাদের সংসদ নির্বাচনে রিটার্নিং অফিসার হিসেবে নিয়োগের কথাও বলেন। তবে প্রধান নির্বাচন কমিশনারও আশ্বস্ত করেছেন, কমিশনের প্রতি আস্থার সংকট কাটিয়ে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন করতে চায় ইসি। ‘ফোর্স’ করা সম্ভব না হলেও দলগুলোকে আনতে ‘আহ্বান’ করার দায়িত্ব কমিশনের। প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ নির্বাচন চান তাঁরা। শিক্ষাবিদ, বিশিষ্ট নাগরিক ও প্রিন্ট মিডিয়ার সাংবাদিকদের সঙ্গে সংলাপের পর গতকাল ইলেকট্রনিক সংবাদমাধ্যমের সম্পাদক ও সিনিয়র সাংবাদিকদের সঙ্গে বৈঠক করে নির্বাচন কমিশন। প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়ালের সভাপতিত্বে আগারগাঁওয়ের নির্বাচন ভবনের সম্মেলন কক্ষে এ বৈঠক হয়। এ সময় চার নির্বাচন কমিশনার আহসান হাবিব খান, রাশেদা সুলতানা এমিলি, মো. আলমগীর ও আনিছুর রহমানও উপস্থিত ছিলেন। সংলাপে অংশ নিয়ে বাসসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান সম্পাদক আবুল কালাম আজাদ বলেন, ‘দলকে আহ্বান করার দায়িত্ব ইসিরও না, সরকারেরও না। জামাই আদর করে নির্বাচনে ডেকে আনতে হবে না। কমিশনের দায়িত্ব নির্বাচন করা।’ সিনিয়র সাংবাদিক মনজুরুল আহসান বুলবুল বলেন, ‘আপনাদের নিয়ে কেউ প্রশ্ন তোলেনি, সেটিই আমরা প্রত্যাশা করেছিলাম। আপনারা জানেন আপনাদের কাজটা কী? ডানে-বাঁয়ে কিছুই নেই ভালো নির্বাচন করা ছাড়া। সহিংসতা না ঘটানো নিশ্চিত করা, সবাই যেন নির্বাচনের ফলাফল মেনে নেয় তা নিশ্চিত করা।’ ইসিকে উদ্দেশ করে তিনি বলেন, ‘আস্থার সংকট দূর করা দরকার। ইভিএম নিয়ে আস্থার সংকট দূর করা প্রয়োজন। এনআইডি যদি সংশোধন না করেন তাহলে কিন্তু অসংখ্য মানুষ খুনের দায়ে দায়ী হবেন।’

একাত্তর টিভির প্রধান সম্পাদক ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোজাম্মেল বাবু বলেন, ‘৫০ বছরে নির্বাচন কমিশন বিতর্কিত হয়েছে। কখনো কখনো দলগুলো ইচ্ছাকৃত ইসিকে বিতর্কিত করেছে। এটা একটা রাজনৈতিক উদ্দেশ্য। আপনাদের এর ঊর্ধ্বে থাকতে হবে। ড. শামসুল হুদা কমিশন বিএনপিকে ভাঙার জন্য মেজর হাফিজের নেতৃত্বাধীন অংশকে ধানের শীষ প্রতীক দিতে চেয়েছিল। এটিই বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে জঘন্যতম নির্বাচন কমিশন ছিল। কাজেই পারসেপশন একটা অদ্ভুত খেলা। কাউকে নির্বাচনে আনা বা না আনা, দল ভাঙার কাজ তো আপনাদের না।’ তিনি বলেন, ‘ইভিএম ইজ দ্য সলিউশন, ইভিএম ইজ দ্য প্রবলেম। পেপার টেইল চালু করা গেলে ইভিএমের প্রতি আস্থা বাড়বে।’

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের প্রধান সম্পাদক তৌফিক ইমরোজ খালিদী বলেন, ‘বিশ্বাসযোগ্যতার একটা সংকট রয়েছে। তা যদি কাটিয়ে উঠতে পারেন সেটাই হবে আপনাদের বড় সাফল্য। তাহলে সবাই নির্বাচনে আসবে। সাধারণ মানুষের আপনাদের বিশ্বাস করতে হবে, গণমাধ্যমের আপনাদের বিশ্বাস করতে হবে। রাজনৈতিকগুলো আপনাদের ওপর আস্থা রাখতে বাধ্য হবে।’

মাছরাঙা টিভির হেড অব নিউজ রেজোয়ানুল হক রাজা বলেন, ‘নির্বাচনকালীন সরকারের বিষয়টি রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত, ইসির বিষয় নয়। তবে রাজনৈতিক দলগুলোকে নির্বাচনে আনার ক্ষেত্রে ইসির ভূমিকা থাকতে হবে।’ তিনি জানান, ইভিএমের ‘পেপার ট্রায়াল’ ব্যবস্থা চালু করলে অর্ধেক সমালোচনা করে যাবে।

ইনডিপেনডেন্ট টিভির চিফ নিউজ এডিটর আশিস সৈকত বলেন, ‘নির্বাচন কমিশনের দৃঢ়তাই খুব বেশি গুরুত্বপূর্ণ। সংবিধানে ক্ষমতা দেওয়া রয়েছে আপনাদের, সরকারে কে থাকল তা গুরুত্বপূর্ণ নয়।’ তিনি বলেন, ‘ইভিএম আমাদের লাগবে। বিতর্ক নিরসনে উদ্যোগ নিতে হবে।’

এটিএন বাংলার প্রধান নির্বাহী সম্পাদক জ ই মামুন বলেন, ‘সোজা কথায় বলতে চাই আওয়ামী লীগ ও বিএনপি না এলে নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক হবে না। আপনারা চেষ্টা করবেন বিএনপি যাতে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে পারে। সে রকম একটি আস্থার পরিবেশ তৈরি করতে হবে।’ তিনি বলেন, ‘সংলাপে আমার সহকর্মী, বন্ধু, ভাইদের বক্তব্য শুনে মনে হচ্ছিল আমি কোনো পলিটিক্যাল প্রোগ্রামে এলাম নাকি! এখানে বিএনপির বক্তব্য হচ্ছে, আওয়ামী লীগের বক্তব্য হচ্ছে। গণমাধ্যমেও এ ধরনের বিভক্তি আছে।’ তবে জ ই মামুনের এমন বক্তব্যের সঙ্গে ভিন্নমত প্রকাশ করেন একাত্তর টিভির প্রধান সম্পাদক ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোজাম্মেল বাবু। তিনি বলেন, ‘আওয়ামী লীগ যখন সিদ্ধান্ত নিল ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারির নির্বাচন করবে না। নির্বাচন কমিশন কি তাদের আনতে পেরেছিল? নির্বাচন কমিশন কীভাবে অংশগ্রহণ নিশ্চিত করবে? আমরা তো একেকজন একেক রকম বলছি।’ এ সময় তাদের পাল্টাপাল্টি বক্তব্যে উষ্ণতা ছড়ায়।

নাগরিক টিভির হেড অব নিউজ দীপ আজাদ বলেন, ‘নির্বাচন কমিশনকে যে ক্ষমতা দেওয়া আছে চাইলে সে ক্ষমতাবলে সুষ্ঠু নির্বাচন করতে পারে। তবে সে ক্ষমতা তাঁরা ব্যবহার করতে চান কি না এটা একটা বড় প্রশ্ন। ভোট কেন্দ্রের দায়িত্বে কে থাকবে- পুলিশ নাকি প্রিসাইডিং অফিসার। গণমাধ্যমের জন্য সবচেয়ে বড় একটি বাধা হয়ে দাঁড়ায় যখন পুলিশ কেন্দ্রের দায়িত্বে থাকে।’

আলোচনায় আরও অংশ নেন টেলিভিশনগুলোর মধ্যে ডিবিসি নিউজের প্রধান সম্পাদক ও সিইও মঞ্জুরুল ইসলাম, গ্লোবাল টিভির এডিটর ইন চিফ সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা, আরটিভির সিইও সৈয়দ আশিক রহমান এবং যমুনা টিভির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ফাহিম আহমদ, নিউজ ২৪-এর নির্বাহী সম্পাদক রাহুল রাহা, স্পাইস টিভির এডিটোরিয়াল হেড তুষার আবদুল্লাহ, একুশে টিভির হেড অব নিউজ রাশেদ চৌধুরী, চ্যানেল আইয়ের প্রধান বার্তা সম্পাদক জাহিদ নেওয়াজ খান, এনটিভির বার্তাপ্রধান জহিরুল আলম, বাংলাভিশনের হেড অব নিউজ আবদুল হাই সিদ্দিক, মাইটিভির হেড অব নিউজ শেখ নাজমুল হক সৈকত, সময় টিভির হেড অব নিউজ মুজতবা দানিশ, চ্যানেল টোয়েন্টি ফোরের নির্বাহী পরিচালক তালাত মামুন, এশিয়ান টিভির হেড অব নিউজ মানস ঘোষ, মোহনা টিভির হেড অব নিউজ মুহা. আহসান উদ-দৌলা মারুফ, দেশ টিভির চিফ নিউজ এডিটর বোরহানুল হক সম্রাট, জাগো নিউজের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক কে এম জিয়াউল হক প্রমুখ।

দলকে ফোর্স নয়, আহ্বান জানাব : সিইসি : সাংবাদিকদের বক্তব্য শেষে প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়াল বলেন, অংশগ্রহণমূলক ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য তাদের প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকবে। এ ক্ষেত্রে দলকে আহ্বান জানাবে কমিশন। রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপের কথা জানান তিনি।

সিইসি জানান, ‘ইভিএম নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে কথা বলেছেন। অধিকাংশই ইভিএমের পক্ষে মত দিয়েছেন। এ যন্ত্রে পেশিশক্তির ব্যবহার করা যায় না, জালিয়াতি করার সুযোগ নেই। আরও কতগুলো ভালো দিক রয়েছে। কেউ কেউ বিপক্ষে বলেছেন। সবকিছু স্টাডি করছি। আমরা কতগুলো সভা করেছি। আমরা ওপেন হতে চাই। একেবারেই বিপেক্ষ বলেননি অনেকে। কাজেই যদি ত্রুটি থাকে সেগুলো কাটিয়ে আপনারা ব্যবহার করতে বলেছেন। অবশ্যই আমরা সেটা দেখব।’

 

 

সর্বশেষ খবর