বুধবার, ৮ জুন, ২০২২ ০০:০০ টা

বৈরিতা মোকাবিলার বাজেট কাল

মানিক মুনতাসির

বৈরিতা মোকাবিলার বাজেট কাল

চলমান রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ পৃথিবীকে দাঁড় করিয়েছে নতুন এক সংকটের মুখে। জ্বালানি, খাদ্যপণ্যসহ সব ধরনের জিনিসপত্রের দাম বাড়ছে হুহু করে। মূল্যস্ফীতির জাঁতাকলে পিষ্ট হচ্ছে নিম্ন-মধ্য আয়ের মানুষ। বেকারের সংখ্যাও বাড়ছে। বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থানে গতি নেই। ডলারের বাজারের সংকট গভীর থেকে গভীরতর হচ্ছে। বিভিন্ন দেশের মতো বাংলাদেশও স্থানীয় মুদ্রার অবমূল্যায়ন ঠেকাতে ব্যর্থ। ফলে লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে আমদানি ব্যয়। কমছে রেমিট্যান্স আর রপ্তানি আয়। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ওপর চাপ সৃষ্টি হয়েছে। সরকারের চলতি হিসাবে দেখা দিয়েছে নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি। সব মিলিয়ে সামষ্টিক অর্থনীতিতে চরম এক বৈরিতা বিরাজ করছে। ঠিক এমন এক সময়ে নতুন ২০২২-২৩ অর্থবছরের জন্য বাজেট ঘোষণা করতে যাচ্ছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। আগামীকাল জাতীয় সংসদে বাজেট উপস্থাপন করবেন তিনি। দেশের ১৪তম অর্থমন্ত্রী হিসেবে এটি তাঁর চতুর্থ বাজেট। আওয়ামী লীগ সরকারের টানা ১৪তম বাজেট এটি, যা দেশের ইতিহাসে একক কোনো দলের টানা ১৪ বার বাজেট দেওয়ার রেকর্ড। এবারের বাজেট বক্তৃতার প্রধান শিরোনাম ‘কভিডের অভিঘাত পেরিয়ে উন্নয়নের ধারাবাহিকতায় প্রত্যাবর্তন’। এতে আটটি প্রধান চ্যালেঞ্জের কথা বলেছেন অর্থমন্ত্রী, যা মূলত বর্তমান প্রেক্ষাপটে দেশের জন্যই চ্যালেঞ্জ। অর্থমন্ত্রী তাঁর বক্তব্যের মাধ্যমে সংসদে বাজেট তুলে ধরবেন এভাবে- ‘প্রতি বছরের ন্যায় চলতি অর্থবছরও বাজেট প্রণয়নের অংশ হিসেবে আমি দেশের শীর্ষ ব্যবসায়ী সংগঠন, স্বনামধন্য অর্থনীতিবিদ ও মিডিয়া ব্যক্তিত্বদের সঙ্গে আগামী ২০২২-২০২৩ অর্থবছরের বাজেট নিয়ে সংলাপ করেছি। এ ছাড়া মন্ত্রণালয়/বিভাগ এবং বিভিন্ন সংগঠন থেকে বাজেটের ওপর প্রস্তাব পেয়েছি। এজন্য আমি সবার প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করছি। এসব আলোচনা, প্রস্তাব ও আমাদের বিশ্লেষণে আগামী অর্থবছরের প্রধান প্রধান চ্যালেঞ্জ হবে : (১) আমদানিজনিত মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ; (২) তেল, গ্যাস ও সারের মূল্যবৃদ্ধিজনিত বর্ধিত ভর্তুকির জন্য অর্থের সংস্থান; (৩) বেসরকারি বিনিয়োগ অব্যাহত রেখে কর্মসৃজন; (৪) আমদানি সহনীয় পর্যায়ে রেখে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের পরিমাণ স্থিতিশীল রাখা; (৫) ব্যাংকঋণের সুদহার বর্তমান পর্যায়ে রাখা; (৬) রাজস্বের পরিমাণ বাড়ানো ও বাজেট ঘাটতি কমিয়ে আনা; (৭) কম গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পের বাস্তবায়ন পিছিয়ে দেওয়া এবং (৮) সামাজিক সুরক্ষা কার্যক্রমের আওতা বাড়ানো।

এবারের বাজেটের মোট আকার ধরা হচ্ছে ৬ লাখ ৭৮ হাজার ৬৪ কোটি টাকা। মূল্যস্ফীতি ৫ দশমিক ৬ শতাংশে ধরে রাখার চ্যালেঞ্জ নিয়ে ৭ দশমিক ৫ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জনের লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে সরকার। অবশ্য সরকারি হিসাবে এরই মধ্যে মূল্যস্ফীতি ৬ শতাংশ ছাড়িয়েছে। বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলোর দাবি, এর হার আরও বেশি। এ পরিস্থিতিতে ৫ দশমিক ৬ শতাংশের মধ্যে মূল্যস্ফীতি রাখার প্রত্যাশা নিয়ে চূড়ান্ত করা হয়েছে আগামী (২০২২-২৩) অর্থবছরের বাজেট। নিয়ন্ত্রণমূলক মূল্যস্ফীতির জন্য বিপুল অঙ্কের ভর্কুকি বাড়িয়ে পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে যাচ্ছেন অর্থমন্ত্রী। ফলে আসন্ন বাজেটে ভর্তুকি খাতে বরাদ্দ বাড়ছে ব্যাপক হারে। এবার নতুন বাজেটের আকার হচ্ছে ৬ লাখ ৭৮ হাজার ৬৪ কোটি টাকা। এটি বাস্তবায়ন করতে আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৪ লাখ ৩৬ হাজার ২৭১ কোটি টাকা। ফলে ঘাটতি বাজেট (অনুদানসহ) হবে ২ লাখ ৪১ হাজার ৭৯৩ কোটি টাকা। আর অনুদান ছাড়া ঘাটতির অঙ্ক দাঁড়াবে ২ লাখ ৪৫ হাজার ৬৪ কোটি টাকা। ঘাটতি মেটাতে সরকার বৈদেশিক উৎস থেকে ঋণ নেওয়ার পরিকল্পনা করেছে ১ লাখ ১২ হাজার ৪৫৮ কোটি টাকা। অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে ১ লাখ ৪৬ হাজার ৩৩৫ কোটি টাকা ঋণ নেওয়ার পরিকল্পনা করেছেন অর্থমন্ত্রী।

বর্তমান সরকারের টানা তৃতীয় মেয়াদের এটিই পূর্ণাঙ্গ শেষ বাজেট। পরের বছর বাজেট ঘোষণা করতে পারলেও তা বাস্তবায়নের আগেই হবে জাতীয় সংসদ নির্বাচন, যার মধ্য দিয়ে নতুন কোনো সরকার ক্ষমতায় আসবে। ফলে ব্যাপক কর্মসৃজনের বিষয়ে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে এবারের বাজেটে। এজন্য ধরা হয়েছে বিনিয়োগের বড় লক্ষ্যমাত্রা। নতুন জিডিপির ৩১ দশমিক ৫ শতাংশ ধরা হয়েছে বিনিয়োগের লক্ষ্যমাত্রা। এর মধ্যে বেসরকারি বিনিয়োগ ২৪ দশমিক ৯ শতাংশ এবং সরকারি বিনিয়োগ ৬ দশমিক ৬ শতাংশ।

বিশাল এ বাজেটের ব্যয় মেটাতে নতুন বছরে কর আদায় করতে হবে ৩ লাখ ৮৮ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে এনবিআর কর থেকে ৩ লাখ ৭০ হাজার কোটি এবং এনবিআরবহির্ভূত কর থেকে আদায়ের লক্ষ্য ১৮ হাজার কোটি টাকা। এ ছাড়া করবহির্ভূত রাজস্ব আয়ের লক্ষ্য ধরা হয়েছে ৪৫ হাজার কোটি টাকা। পাশাপাশি কভিড-১৯-পরবর্তী এ বছর বৈদেশিক অনুদান পাওয়ার আশা করা হচ্ছে ৩ হাজার ২৭১ কোটি টাকা। বৈদেশিক অনুদান পরিশোধ করতে হয় না। এজন্য এটি সরকারের এক ধরনের আয় মনে করা হয়।

আসছে বছর সরকারের পরিচালনা খাতে ব্যয় ধরা হচ্ছে ৪ লাখ ১১ হাজার ৪০৬ কোটি টাকা। এর বড় অংশ ব্যয় হবে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা খাতে। এ খাতে যাবে ৭৬ হাজার ৪১২ কোটি টাকা। এ ছাড়া ঘাটতি মেটাতে ব্যাংক থেকে বড় অঙ্কের ঋণ গ্রহণের পরিকল্পনাও আছে, যে কারণে আগামী বছরে অভ্যন্তরীণ ঋণের সুদ পরিশোধ করতে হবে ৭৩ হাজার ১৭৫ কোটি টাকা এবং বৈদেশিক ঋণের সুদ খাতে ব্যয় হবে ৭ হাজার ২০০ কোটি টাকা।

বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান চাঙা করতে সরকার আগামী বছর উন্নয়ন খাতে ব্যয় বেশি করার পরিকল্পনা নিয়েছে। নতুন বাজেটে উন্নয়ন খাতে ব্যয় ধরা হয়েছে ২ লাখ ৫৯ হাজার ৬১৭ কোটি টাকা, যার মধ্যে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) আকার ২ লাখ ৪৬ হাজার ৬৬ কোটি টাকা। এডিপিবহির্ভূত বিশেষ প্রকল্পে ৭ হাজার ৭২১ কোটি এবং কাজের বিনিময়ে খাদ্য কর্মসূচিতে ব্যয় করা হবে ২ হাজার ৬৭৫ কোটি টাকা। এদিকে বাজেট ঘাটতি জিডিপির ৫ দশমিক ৫ শতাংশের মধ্যে ধরে রাখার পরিকল্পনা করা হচ্ছে। ফলে আগামী বাজেটে ঘাটতি (অনুদানসহ) হবে ২ লাখ ৪১ হাজার ৭৯৩ কোটি টাকা। বড় অঙ্কের এ ঘাটতি পূরণ করাই চ্যালেঞ্জ হবে সরকারের জন্য। এ ঘাটতি মেটাতে ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়া হবে ১ লাখ ৬ হাজার ৩৩৪ কোটি এবং সঞ্চয়পত্র থেকে নেওয়া হবে ৩৫ হাজার কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরে ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়ার লক্ষ্য ৮৭ হাজার ২৮৭ কোটি এবং সঞ্চয়পত্র থেকে ৩২ হাজার কোটি টাকা। যদিও শেষ পর্যন্ত সঞ্চয়পত্র থেকে লক্ষ্যমাত্রার বেশি নেওয়া হচ্ছে। এ ছাড়া ঘাটতি পূরণে বিদেশ থেকে ঋণ গ্রহণ করা হবে ৯৫ হাজার ৮৪৫ কোটি টাকা। অন্যান্য খাত থেকে ঋণ নেওয়া হবে ৫ হাজার ১ কোটি টাকা।

কভিড-পরবর্তী সব ধরনের অর্থনৈতিক কর্মকান্ড শুরু হলেও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ অর্থনীতিকে সংকটের মধ্যে ফেলেছে। ফলে বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থানও থেমে গেছে। তবু আসছে বছর উচ্চতর প্রবৃদ্ধি অর্জনের পরিকল্পনা করা হচ্ছে। এ কারণে আগামী অর্থবছরও ৭ দশমিক ৫০ শতাংশ অর্জনের প্রত্যাশা করছে সরকার।

যদিও এর সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করেছেন অর্থনীতিবিদরা। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ড. হোসেন জিল্লুর রহমান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেছেন, ‘প্রবৃদ্ধি কত হবে সেটা পরের বিষয়, প্রথমে তো জিনিসপত্রের দাম কমাতে হবে। মানুষকে কাজ দিতে হবে। বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। অথচ আমাদের অর্থনীতির প্রায় প্রতিটি সূচকই এখন নেতিবাচক রয়েছে।’ তাই প্রবৃদ্ধির চেয়ে বরং দারিদ্র্য বিমোচন আর বিনিয়োগ-কর্মসংস্থানকেই অধিক গুরুত্ব দেওয়া উচিত বলে মনে করেন তিনি।

সর্বশেষ খবর