বৃহস্পতিবার, ২৮ জুলাই, ২০২২ ০০:০০ টা

সাবেক ওসি প্রদীপের ২০ ও স্ত্রীর ২১ বছরের সাজা

অবৈধ সম্পদ অর্জনে দুদকের মামলার রায় সম্পদ বাজেয়াপ্ত

নিজস্ব প্রতিবেদক, চট্টগ্রাম

সাবেক ওসি প্রদীপের ২০ ও স্ত্রীর ২১ বছরের সাজা

স্ত্রীকে মাছ ব্যবসায়ী সাজিয়ে সেই সম্পদগুলো রক্ষা করতে পারলেন না মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আলোচিত সাবেক ওসি প্রদীপ। তিনি নিজেও অবৈধ সম্পদ অর্জনের কারণে এ মামলায় আটকে গেলেন। স্ত্রী চুমকি কারণের নামে রাখা জায়গাজমি, বাড়ি, গাড়ি ও ফ্ল্যাট কিছুই রক্ষা হলো না। কারণ গতকাল আদালতের রায়ে ‘ঘুষ ও দুর্নীতি’র মাধ্যমে অর্জিত অবৈধ সম্পদ রাষ্ট্রের অনুকূলে বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে এবং সাবেক ওসি প্রদীপকে ২০ বছর ও স্ত্রী চুমকি কারণকে ২১ বছরের সাজা দেওয়া হয়েছে। অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) করা মামলায় চট্টগ্রাম বিভাগীয় বিশেষ জজ আদালতের বিচারক মুনসী আবদুল মজিদ এ রায় দেন বলে জানান দুদকের পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) মাহমুদুল হক মাহমুদ। রায় ঘোষণার সময় দুই আসামি আদালতে উপস্থিত ছিলেন। পরে নিরাপত্তার মধ্য দিয়ে আবার তাদের কারাগারে নিয়ে যাওয়া হয়। পিপি মাহমুদুল হক মাহমুদ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, অবৈধ এসব সম্পদ নিজের কাছে রাখতে স্ত্রী চুমকি কারণের নামে নেন সাবেক ওসি প্রদীপ। গৃহিণী হয়েও তার স্ত্রী ভুয়া মাছ চাষ দেখান। এমনকি নিজের ঘুষের টাকায় তৈরি ছয় তলা বাড়িটি শ্বশুরের দান করা বলে দাবি করেন প্রদীপ। কিন্তু শেষ পর্যন্ত দুর্নীতির এসব সম্পদ রক্ষা করতে পারলেন না। দুদকের তদন্ত ও সাক্ষ্যে দুর্নীতির সব বিষয় উঠে এসেছে। তিনি বলেন, ‘আদালতে ২৪ জন সাক্ষীর মাধ্যমে এসবের প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছি। আদালত সবকিছু বিচার-বিশ্লেষণ করে বলেছেন আসামিরা পরস্পরের যোগসাজশে এ অপরাধ করেছেন। তাই আদালত তাদের শাস্তি দিয়েছেন। রায়ে আমরা সন্তুষ্ট, সেটা দ্রুত কার্যকর চাই।’ অন্যদিকে ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হয়েছেন তাই উচ্চ আদালতে যাবেন বলে জানান আসামির আইনজীবী। প্রদীপ ও তার স্ত্রী চুমকির আইনজীবী অ্যাডভোকেট সমীর দাশগুপ্ত বলেন, ‘মহেশখালী উপজেলার সেলিম এলাহী নামে এক ব্যক্তির অভিযোগের ভিত্তিতে দুদক প্রদীপ ও চুমকির বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু করে। মামলায় সাক্ষী করা হলেও সেলিম এলাহী সাক্ষ্য দেননি। ২৪ জন সাক্ষীর মধ্যে দুজন গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষীকে আদালতে জেরা করা হয়। বাকি ২২ জনের কাগজপত্র যাচাই-বাছাই করেছেন। তারা মামলা সম্পর্কে অবগত নন। তাই আমরা ন্যায়বিচার পাইনি। ন্যায়বিচারের জন্য উচ্চ আদালতে আপিল করা হবে।’

প্রদীপ চুমকির কত বছর কারাদণ্ড : দুদক আইনের ২০০৪-এর ২৬ (২) ধারায় চুমকিকে এক বছর কারাদণ্ড, ১ লাখ টাকা জরিমানা অনাদায়ে এক মাস কারাদণ্ড, ২৭ (১) ধারায় প্রদীপ ও চুমকিকে আট বছর কারাদণ্ড, মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন, ২০১২-এর ৪ (২) ও ৪ (৩) ধারায় প্রদীপ ও চুমকিকে ১০ বছর কারাদণ্ড এবং ৪ কোটি টাকা জরিমানা, ১৯৪৭ সালের দুর্নীতি প্রতিরোধ আইনের ৫ (২) ধারায় প্রদীপ ও চুমকিকে দুই বছর কারাদণ্ড ও ১০ হাজার টাকা জরিমানা ও অনাদায়ে দুই মাস কারাদণ্ড দিয়েছেন আদালত। প্রতিটি কারাদণ্ড একসঙ্গে চলবে।

কোটি টাকা পৃথক জরিমানা : দুদকের এ মামলার রায়ে প্রদীপকে ৪ কোটি ১০ লাখ ১০ হাজার ও চুমকিকে ৪ কোটি ১১ লাখ ১০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়েছে, অনাদায়ে প্রদীপকে দুই বছর আট মাস ও চুমকিকে দুই বছর নয় মাস কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে।

চুমকির এত সম্পদ : মামলার তদন্ত কর্মকর্তা দুদক কক্সবাজারের সহকারী পরিচালক মো. রিয়াজ উদ্দিন বলেন, চুমকি কারণ একজন গৃহিণী। তিনি কমিশন ব্যবসায়ী হিসেবে ২০১৩-১৪ অর্থবছরে প্রথম আয়কর রিটার্ন প্রদান করেন। পরে মাছের ব্যবসা ও বাড়ি ভাড়া থেকে আয় দেখিয়ে রিটার্ন দাখিল করে আসছেন। ২০১৩-১৪ বছরে তিনি ১১ লাখ ২০ হাজার টাকা ও পরবর্তী অর্থবছরে ৩ লাখ ৮০ হাজার টাকা মূলধন দেখিয়েছেন। কিন্তু দুদকের তদন্তে কমিশন ব্যবসার কোনো অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি। চুমকি কারণ কমিশন ব্যবসার লাইসেন্স, ব্যাংক লেনদেনের কোনো প্রমাণ এবং সরকারি কর্মকর্তার স্ত্রী হিসেবে ব্যবসা করার জন্য যথাযথ অনুমোদন দেখাতে পারেননি। তিনি আরও বলেন, মাছের ব্যবসা থেকে দেড় কোটি টাকা আয় দেখালেও আয়কর নথিসহ নানা তদন্তে সঠিক কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। চুমকি কারণ তার স্বামী প্রদীপের অপরাধলব্ধ অর্থ স্থানান্তর, হস্তান্তর ও রূপান্তরের উদ্দেশ্যে ভুয়া মাছের ব্যবসা দেখিয়েছেন।

বাজেয়াপ্ত সম্পদের ব্যবস্থা নিতে জেলা প্রশাসককে নির্দেশ : ওসি প্রদীপ ও চুমকির বায়েজাপ্ত সম্পদের ব্যাপারে ব্যবস্থা নিতে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসককে নির্দেশ দিয়েছেন আদালত। এ সময় আদালতে প্রদীপ কুমার দাশ ও চুমকি কারণ উপস্থিত ছিলেন। আদালতের বেঞ্চ সহকারী মো. মূসা বলেন, প্রদীপ ও চুমকির বাজেয়াপ্ত সম্পদের বিষয়ে দুদকের ২০০৭-এর বিধি ১৮৩(৯) এবং ফৌজদারি কার্যবিধি ধারা ৫১৭/৫২০সহ প্রযোজ্য অন্য বিধানাবলির আলোকে বাজেয়াপ্ত সম্পত্তির বিষয়ে ব্যবস্থা গ্রহণ করবে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন। কক্সবাজার জেলার সম্পত্তির বিষয়ে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসক কক্সবাজার জেলা প্রশাসককে চিঠি দিয়ে ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন বলে জানান তিনি।

রায়ের সময় প্রদীপ চুমকি বিমর্ষ : আদালতের রায়ের সময় প্রদীপ ও চুমকির চোখ পানিতে টলমল করছিল এবং এ সময় দুজন বিমর্ষও ছিলেন। চট্টগ্রাম আদালত ভবনের তৃতীয় তলায় বিভাগীয় বিশেষ জজ আদালতের এজলাস। বেলা ১১টার পরই বিচারক এজলাসে এসে রায় পড়া শুরু করেন। এ সময় প্রদীপ ও চুমকির চোখ পানিতে টলমল করছিল। দুজনই বেশ বিমর্ষ ছিলেন। এরপর রায় ঘোষণার পর প্রদীপকে পুলিশি পাহারায় প্রিজনভ্যানে তোলার সময় উপস্থিত সাংবাদিকদের উদ্দেশে প্রদীপ বলতে থাকেন, ‘আমি দুর্নীতি করিনি। আমি দুর্নীতি করিনি।’ তার কিছুক্ষণ পর চুমকিকেও নিয়ে যাওয়া হয় কারাগারে। সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) চট্টগ্রামের সম্পাদক আখতার কবির চৌধুরী বলেন, প্রদীপের এ ঘটনা থেকে পুলিশসহ সব দুর্নীতিবাজের শিক্ষা নেওয়া উচিত। অনিয়ম, ঘুষ-দুর্নীতির মাধ্যমে এ ধরনের সম্পদ একদিন না একদিন ধরা পড়বেই।

সর্বশেষ খবর