শনিবার, ৩০ জুলাই, ২০২২ ০০:০০ টা

লোকসানেই সর্বনাশ বিপিসির

প্রতিদিন ১১০ কোটি, চার মাসে প্রায় ৫ হাজার কোটি টাকার ক্ষতি

জিন্নাতুন নূর

লোকসানেই সর্বনাশ বিপিসির

দেশে জ্বালানি তেল আমদানির একমাত্র দায়িত্বপ্রাপ্ত রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি) আবারও ভয়াবহ লোকসানে পড়েছে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ পরিস্থিতি এবং কভিড সংক্রমণ কমে আসায় বিশ্বব্যাপী জ্বালানি তেলের চাহিদা বেড়ে গেছে। এতে তেলের দাম সর্বকালের রেকর্ড ভেঙেছে। আর এর প্রভাব এরই মধ্যে পড়তে শুরু করেছে বিপিসির ওপর।

বিপিসি সূত্রে জানা যায়, বর্তমানে প্রতিদিন ১১০ কোটি টাকার বেশি লোকসান দিতে হচ্ছে। আর ফেব্রুয়ারি-মে পর্যন্ত চার মাসে প্রায় ৫ হাজার কোটি টাকার লোকসান হয়েছে। বিপিসি কর্তৃপক্ষ জানান, গত পাঁচ মাসে প্রতিষ্ঠানটিকে তেল আমদানিতে অতিরিক্ত ৭ হাজার কোটি টাকা ব্যয় করতে হয়েছে। শিগগিরই বিপিসিকে সরকারের কাছে ভর্তুকি চাইতে হতে পারে বলে কর্তৃপক্ষ আশঙ্কা করছেন। আর এ পরিস্থিতি মোকাবিলায় এবং লোকসান ঠেকাতে জ্বালানির মূল্য সমন্বয় করার কথাও ভাবছে সরকারের জ্বালানি বিভাগ।

বিপিসি সূত্রে জানা গেছে, প্রতিষ্ঠানটির চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে ২৮৩ কোটি, মার্চে ১৩২৩ কোটি, এপ্রিলে ১৪৯৮ ও মে মাসে ১৪৯৫ কোটি টাকা লোকসান হয়েছে। সব মিলিয়ে গত চার মাসে প্রায় ৫ হাজার কোটি টাকা লোকসান হয়েছে। ভর্তুকির বোঝামুক্ত হয়ে কয়েক বছর ধরে রাষ্ট্রীয় এই প্রতিষ্ঠান মুনাফা করলেও ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের কারণে আবারও বড় ধরনের ধাক্কা খেয়েছে বিপিসি। লোকসানে পড়েছে সংস্থাটি। চড়তে থাকা আন্তর্জাতিক বাজারের কারণে বিপিসিকেও চড়া মূল্য দিতে হচ্ছে। বিশ্ববাজার অনেক বেশি ঊর্ধ্বমুখী হয়ে পড়ায় বেশি দামে কিনে দেশের বাজারে কম দামে বিক্রির সেই পুরনো ধারায় ফিরতে হয়েছে বিপিসিকে। এতে অনেকদিন ভর্তুকি ছাড়া চললেও আবার প্রতিষ্ঠানটি ভর্তুকি দিতে শুরু করেছে।

সাধারণত তেলের দাম ৮০ ডলার ছাড়িয়ে গেলেই বিপিসির লোকসান গুনতে হয়। গত বছরের শেষে তেলের মূল্যবৃদ্ধি শুরু হলে নভেম্বরে সরকার ডিজেল ও কেরোসিনের দাম প্রতি লিটারে ১৫ টাকা বাড়িয়ে ৮০ টাকা করে। এরপর ফেব্রুয়ারিতে ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের কারণে তেলের বাজার আরও তেতে ওঠে। জানুয়ারিতে দৈনিক বিপিসি ২০ কোটি টাকার লোকসান করলেও চলতি জুনে এসেই তা ১১০ কোটিতে ঠেকেছে।

বিপিসির চেয়ারম্যান এ বি এম আজাদ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, আমাদের আর্থিক অবস্থা ক্রমান্বয়ে কমে আসছে এবং সেটা আর কতদিন যাবে তা নিখুঁতভাবে বলা না গেলেও এই আর্থিক অবস্থা আরও খারাপ হতে যাচ্ছে। এখনো আমরা সরকারের কাছে কোনো ভর্তুকির জন্য অর্থ চাইনি। তবে বিপিসির অর্থ মানেই সরকারের অর্থ। বিপিসি এরই মধ্যে ভর্তুকি দিয়ে ফেলেছে। গত পাঁচ মাসে আমাদের সব মিলিয়ে প্রায় ৭ হাজার কোটি টাকা অতিরিক্ত ব্যয় হয়েছে জ্বালানি তেলের অতিরিক্ত উচ্চমূল্যের কারণে। সরকার সে অর্থ এরই মধ্যে ভর্তুকি দিচ্ছে। বিপিসির অর্থ মানে সরকারি প্রতিষ্ঠান হিসেবে সরকারের অর্থ। সরকারের কাছ থেকে এখনো না নিলেও বিপিসির এ পর্যন্ত যা সামর্থ্য ছিল তা দিয়ে সরকারের পক্ষে ভর্তুকি দিয়েছে। এ অবস্থা চলতে থাকলে নিজস্ব ব্যয় দিয়ে সামনে চলা কঠিন হয়ে যাবে। তখন সরকারের কাছে ভর্তুকি চাইতে হতে পারে। বর্তমান বিশ্ব পরিস্থিতিতে উচ্চমূল্যের জ্বালানির জন্য বিপিসির অর্থও লাগছে বেশি। জ্বালানির খরচ মেটাতে এতদিনের লাভের টাকা বেরিয়ে যাচ্ছে প্রতিষ্ঠানটির। জানা গেছে, ভর্তুকির কারণে বছরের পর বছর লোকসান গোনা রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাটি ২০১৪-১৫ থেকে ২০২০-২১ পর্যন্ত সাত অর্থবছরে জ্বালানি তেল বিক্রি করে মুনাফা করে প্রায় ৪৭ হাজার কোটি টাকা। চলতি বছরের প্রথমার্ধের শেষেও ভালো মুনাফাতেই ছিল। তবে অর্থবছর শেষে লোকসান গোনার শঙ্কা প্রকাশ পেয়েছে বিপিসির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরের ৮ মে পর্যন্ত হিসাবে দেখা যায় সংস্থাটির মুনাফা কমে ১২৬৩ কোটি ৭৮ লাখ টাকায় নেমেছে। এখন প্রতিদিন ১০৮ থেকে ১১০ কোটি টাকা লোকসান দিতে হচ্ছে। বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদও বলেছেন, বিশ্বে জ্বালানি তেলের দাম অস্বাভাবিক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে বিপিসিকে প্রতিদিন শত কোটি টাকা লোকসান দিতে হচ্ছে। আমরা এই সময়ে জ্বালানি তেলের দাম সমন্বয় করব কি না, সেটা আগে ভাবতে হবে। এ নিয়ে কাজ করছে সরকার। বিপিসি কর্তৃপক্ষ জানান, বর্তমানে দেশের জ্বালানি তেলের চাহিদা ৬৫ লাখ মেট্রিক টন। এর মধ্যে এক-চতুর্থাংশের কিছুটা কম তথা ১৫ লাখ মেট্রিক টন অপরিশোধিত তেল দেশে এনে ইস্টার্ন রিফাইনারিতে পরিশোধন করা হয়। এরপর তা থেকে বিভিন্ন ধরনের জ্বালানি যেমন- পেট্রোল, অকটেন, ডিজেল, কেরোসিনসহ বিভিন্ন পেট্রোলিয়াম পণ্য উৎপাদন করা হয়। বাকি চাহিদা পরিশোধিত জ্বালানি তেল আমদানি করে মেটানো হয়।

সর্বশেষ খবর