শনিবার, ১৩ আগস্ট, ২০২২ ০০:০০ টা
তেলসহ দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি ও মন্ত্রীদের লাগামহীন কথাবার্তা

দায় নিতে নারাজ ১৪ দলের শরিকরা

রফিকুল ইসলাম রনি

জ্বালানি তেলসহ দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি ও সরকারের মন্ত্রীদের লাগামহীন কথাবার্তা আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪-দলীয় জোটের শরিকরা ভালোভাবে নিচ্ছেন না। টানা তৃতীয় মেয়াদে ক্ষমতার অংশী জোট শরিক দলের নেতারা প্রকাশ্যে বিরোধিতার পাশাপাশি ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করছেন। তারা মন্ত্রীদের বক্তব্য ও সরকারের সিদ্ধান্তের দায় নিতে নারাজ। দায়িত্বশীল পদে থেকে মন্ত্রীদের আরও সংযত হয়ে জনগণের ‘পালস’ বুঝে কথা বলার পরামর্শ দিচ্ছেন তারা। 

সূত্রমতে, গত সপ্তাহে সরকারের দায়িত্বশীল কয়েকজন মন্ত্রী বেফাঁস কথাবার্তা বলেছেন। তাদের কেউ কেউ বলেছেন, ‘সবার গায়ে জামাকাপড় আছে, খুব খারাপ আছি মনে করি না’, ‘দাম বাড়ায় কেউ না খেয়ে মারা যায়নি, আশা করি যাবেও না’, ‘বৈশ্বিক মন্দায় অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশের মানুষ বেহেশতে আছে’। জ্বালানি তেলসহ দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে সাধারণ মানুষের নাভিশ্বাস অবস্থা। সবাইকে পাশে নিয়ে ঐক্যবদ্ধভাবে সংকট মোকাবিলা করার পরিবর্তে কিছু কিছু মন্ত্রীর অতিকথন সরকারকে বেকায়দায় ফেলছে। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে ২০০৫ সালে ২৩ দফার ভিত্তিতে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী দলগুলোকে নিয়ে ১৪-দলীয় জোট গঠন করা হয়। দীর্ঘদিন এ জোটকে আদর্শিক জোট বলা হলেও পরশু একজন মন্ত্রী বললেন, ১৪-দলীয় জোট আদর্শিক জোট নয়, এটা নির্বাচনী জোট। দায়িত্বশীল ওই মন্ত্রীর কথায় ক্ষোভ ঝেড়েছেন জোট শরিকরা।

এ প্রসঙ্গে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি-ন্যাপ (মোজাফ্ফর)-এর ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব ইসমাইল হোসেন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, কিছু মন্ত্রীর উদ্ভট কথাবার্তা সরকারকে চরম বেকায়দার দিকে নিয়ে যাচ্ছে। কেউ বলছেন, বাংলাদেশের মানুষ বেহেশতে আছেন। কেউ বলছেন, কেউ না খেয়ে মারা যাননি। কেউ বলছেন, এখনো মানুষের গায়ে জামা আছে। কেউ কেউ আবার ১৪-দলীয় জোটকে ‘নির্বাচনী জোট’ হিসেবে আখ্যায়িত করছেন। এসব অসংলগ্ন কথাবার্তা দায়িত্বশীল পদে থেকে বলা মোটেও সমীচীন নয়। বৈশ্বিক বা জাতীয় সংকটের সময়ে ধীরস্থিরভাবে কীভাবে এগুলো থেকে পরিত্রাণ পাওয়া যায় সেদিকে না গিয়ে বেফাঁস কথাবার্তা সংকট ডেকে আনছে। এসব অসংলগ্ন কথাবার্তা দেশের মানুষকে ক্ষেপিয়ে তুলবে। কাজেই সংযত হয়ে কথাবার্তা বলা উচিত। তিনি আরও বলেন, ১৪-দলীয় জোট যদি আদর্শিক জোট না হয় তাহলে কেন জোট রাখা হচ্ছে? সরকারে তো জোটের শরিকরা কেউ নেই। আবার সব দল তো নির্বাচনে অংশও নেয় না। তাহলে কেন নির্বাচনী জোট বলা হচ্ছে? একটি আদর্শের ভিত্তিতে এই জোট করা হয়েছিল, সেই আদর্শেই জোট টিকে আছে।’

গত শুক্রবার রাতে হঠাৎ করেই ডিজেল, কেরোসিন, পেট্রোল ও অকটেনের মূল্যবৃদ্ধির ঘোষণা দেয় সরকার। মূল্যবৃদ্ধির হার ৪২ থেকে ৫১ শতাংশ। এ রকম বড় মূল্যবৃদ্ধি দেশে আর কখনো দেখা যায়নি। জ্বালানি তেলের এই মূল্যবৃদ্ধি নিয়ে জনমনে অসন্তোষ দেখা যাচ্ছে। বেড়েছে বাসের ভাড়া। প্রভাব পড়েছে পণ্যমূল্যে। জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির প্রতিবাদে সরব রাজনৈতিক দলগুলো। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের জোটসঙ্গী ও সংসদের বিরোধী দল জাতীয় পার্টি কর্মসূচিও দিয়েছে। সংসদের বাইরে বিরোধী দল বিএনপি ও বামধারার রাজনৈতিক দলগুলোও মাঠে উত্তাপ ছড়াচ্ছে। এর মধ্যে কোনো কোনো মন্ত্রী ‘আগুনে ঘি’ ঢালছেন তাদের বেফাঁস কথাবার্তায়। এসব মন্ত্রীদের অতিকথনকে অরাজনৈতিক বলছেন জোট শরিকরা। এ প্রসঙ্গে সাম্যবাদী দলের সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক শিল্পমন্ত্রী দিলীপ বড়ুয়া বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘রাজনৈতিক সরকারের অরাজনৈতিক মন্ত্রীরা লাগামহীন কথাবার্তা বলছেন। তারা অনেকেই ঘটনাক্রমে মন্ত্রী হয়েছেন। রাজনৈতিক ত্যাগ থাকলে, জনগণের মনের ভাষা বুঝে এমপি-মন্ত্রী হলে এমন অসংলগ্ন কথাবার্তা বলতে পারতেন না।’ তিনি বলেন, ‘দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে সাধারণ মানুষের কাহিল অবস্থা। প্রত্যেক জিনিসের দাম দ্বিগুণ হয়েছে। এমন অবস্থায় কিছু মন্ত্রী বলছেন, গায়ে জামা আছে, সবাই ইস্ত্রি করা শার্ট পরে, দেশে গরিব মানুষ নেই। এগুলো জাতির সঙ্গে তামাশা। এ তামাশা বন্ধ করতে হবে। জনগণের মনের ভাষা বুঝে কথা বলতে হবে।’

১৪-দলীয় জোটের শরিকরা বলছেন, জোটের মধ্যে দূরত্ব নতুন কিছু নয়। ২০১৮ সালের নির্বাচনের পর মন্ত্রিসভায় শরিকদের না রাখার কারণে শরিকরা মনঃক্ষুণ্ন হয়ে নিজেরাই কিছুটা দূরত্ব বজায় রাখছে। সম্প্রতি জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি নিয়ে সরকারের প্রতি অসন্তুষ্ট তারা। তারা সরকারের সিদ্ধান্তের দায় নিতে নারাজ। কোনো কোনো শরিক দলের নেতা এই মূল্যবৃদ্ধির সিদ্ধান্তের প্রকাশ্য বিরোধিতা করছেন। কেউ কেউ বলছেন, দাম রেকর্ড হারে বাড়িয়ে দেওয়া কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। কারণ, দেশে এমনিতেই নিত্যপণ্যের দাম ব্যাপক চড়া, মানুষ কষ্টে রয়েছে। এ প্রসঙ্গে জাসদ সভাপতি ও সাবেক তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের প্রভাব ছাড়াও প্রশাসনের অভ্যন্তরীণ এবং সরকারের দুর্নীতি অনিয়মের কারণে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি। একদিকে ডলার কারসাজি, অন্যদিকে জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধি দেশকে সংকটের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। যারা দায়িত্বে আছেন, তাদের অসংলগ্ন কথাবার্তায় লাগাম টানা দরকার। দেশের জনগণের জন্য সঠিক পদক্ষেপ না নিয়ে স্ববিরোধী কথাবার্তা জনগণকে ক্ষুব্ধ করছে। দেশের অর্থনীতি এখনো ভালো আছে। সঠিক পদক্ষেপ গ্রহণ করলে পরিস্থিতির উত্তরণ সম্ভব। তিনি বলেন, ‘১৪-দলীয় জোট আদর্শিক জোট নয়, নির্বাচনী জোট-এ কথা যিনি বলেছেন, তার তথ্যের ঘাটতি আছে। ২৩ দফার ভিত্তিতে ১৪-দলীয় জোট গঠন করা হয়েছিল। একসঙ্গে আন্দোলন, ভোট করার অঙ্গীকার ছিল। সরকারে থাকা না থাকা কোনো বিষয় নয়। ১৪-দলীয় জোটের নেতৃত্বেই বাংলাদেশকে পাকিস্তানি ভাবধারা থেকে বাংলাদেশের ধারায় নিয়ে আসার কাজ চলমান আছে। সে কাজ এখনো শেষ হয়ে যায়নি। কাজেই এটা নির্বাচনী জোট বলে জোটের ঐক্য হালকা করা হচ্ছে।’ তরিকত ফেডারেশন বাংলাদেশ’-এর সভাপতি সৈয়দ নজিবুল বশর মাইজভান্ডারী বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, দায়িত্বশীল মন্ত্রীরাও যেমন উল্টা-পাল্টা বলছেন, তেমনি আমরা যারা জোট শরিক আছি তারাও কেউ কেউ বিরোধী দলের মতো কথা বলছি, যা ঠিক হচ্ছে না। কারোরই দায়িত্বহীন কথা বলা উচিত না। দ্রব্যমূল্য ও বিদ্যুৎ বিভ্রাট নিয়ে মানুষ কষ্টে আছে। মানুষের পালস বুঝে কথা বলা উচিত। এমন কোনো কথা বলা উচিত নয়, যা স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি ১৪-দল ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

সর্বশেষ খবর