শিরোনাম
রবিবার, ২১ আগস্ট, ২০২২ ০০:০০ টা

মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে দুঃসহ জীবন

রফিকুল ইসলাম রনি

আজ ২১ আগস্ট। রক্তস্নাত ভয়াল-বিভীষিকাময় দিন। বারুদ আর রক্তমাখা বীভৎস রাজনৈতিক হত্যাযজ্ঞের ১৮তম বার্ষিকী। ২০০৪ সালের এদিনে রাজধানীর ২৩ বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের ‘সন্ত্রাস, জঙ্গিবাদ ও দুর্নীতিবিরোধী’ শান্তির শোভাযাত্রাপূর্ব সমাবেশে নারকীয় গ্রেনেড হামলায় ঝরে যায় ২৪টি প্রাণ। আহত হন দলীয় ৫ শতাধিক নেতা-কর্মী। বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের সময় এ হত্যাকা  চালানো হয়। সেদিন রক্তঝড়ের প্রচণ্ডতায় মলিন হয়ে গিয়েছিল বাংলা ও বাঙালির মুখ। জীবন্ত বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ের আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয় প্রাঙ্গণ সেদিন মুহূর্তেই পরিণত হয়েছিল মৃত্যুপুরীতে। ঘাতকদের প্রধান লক্ষ্যই ছিল শেখ হাসিনা। পরিস্থিতির তাৎপর্য বুঝতে পেরে ট্রাকে অবস্থানরত নেতৃবৃন্দ ও শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত নিরাপত্তা কর্মকর্তারা মানবঢাল রচনা করে মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা করেন বঙ্গবন্ধুকন্যাকে। নেতা ও দেহরক্ষীদের আত্মত্যাগ এবং পরম করুণাময়ের অশেষ রহমতে মৃত্যুজাল ছিন্ন করে অল্পের জন্য প্রাণে রক্ষা পান বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। শত শত মানুষের আর্তচিৎকার, ছড়িয়ে থাকা ছিন্নভিন্ন দেহ, রক্ত আর পোড়া গন্ধ সব মিলিয়ে বীভৎস অবস্থার সৃষ্টি হয় পুরো এলাকায়। সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে শান্তির মিছিলে সেদিন যারা মারাত্মক আহত হয়েছিলেন, তাদের চোখে-মুখে আজও ভেসে ওঠে সেই বিভীষিকাময় দুঃসহ স্মৃতি। আজও অনেকে পঙ্গুত্ব নিয়ে জীবন যাপন করছেন। কারও কারও রাতে ঘুম হয় না। আবার রাতের আঁধারে আঁতকে ওঠেন কেউ। ভয়াবহ গ্রেনেড হামলার পরদিন পত্রিকায় মৃতদের যেসব ছবি ছাপা হয়েছিল তার সঙ্গে ছিল সাভারের মাহবুবা আকতারের ছবি। সেই দিনের স্মৃতিচারণ করে মাহবুবা বলেন, ‘শরীরে দেড় হাজার স্প্রিন্টার। রাতে এক ঘণ্টা ঘুম হয়। বাকি সময়টা এপাশ-ওপাশ করেই কাটাই। চোখ বুজলেই এখনো শুনতে পাই সেই ভয়াবহ নারকীয় গ্রেনেডের শব্দ। রাত ২টা বাজলেই ঘুম ভেঙে যায়।’ তিনি আরও জানান, শরীরে যে ১ হাজার ৮০০ স্প্রিন্টার তার মধ্যে মাথার দুটি স্প্রিন্টার খুব যন্ত্রণা দেয়। মাঝে-মধ্যেই তিনি পাগলের মতো হয়ে যান। তার শারীরিক অবস্থা ভালো নয়।’ কথা হয় মাদারীপুরের পাঁচখোলা গ্রামের সম্রাট আকবর সবুজের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘নেত্রী (আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা) বক্তব্য শেষ করলেন, আমি মাকে ডাকব, এমন প্রস্তুতি নিচ্ছি। এ সময় প্রচ  বিস্ফোরণ। কানে তালা লেগে গেছে। পায়ের দিকে তাকিয়ে দেখি রক্তে ভিজে যাচ্ছে। আহত-নিহত অনেকে পড়ে আছেন। জ্ঞান হারিয়ে পড়ে গেলাম। এরপর কী হয়েছে জানি না।’ ‘ঘটনার পরের দিন বুঝতে পারি আমি ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। কিন্তু পুলিশ আমাকে চিকিৎসা নিতে দেয়নি। বাধ্য হয়ে হলি ফ্যামিলি হাসপাতালে আসি। সেখানেও একই পরিস্থিতি। অ কোষ ও শরীরে এখনো অসংখ্য স্প্রিন্টার। ঘুমাতে পারি না। চোখ বন্ধ করলেই পুরো ঘটনা ভেসে ওঠে।’ সেদিনের সন্ত্রাসবিরোধী শান্তি সমাবেশ ডেকেছিল ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগ। সমাবেশের সভাপতি ছিলেন ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের তৎকালীন সভাপতি মোহাম্মদ হানিফ আর সমাবেশ সঞ্চালনা করেছিলেন যৌথভাবে সাধারণ সম্পাদক মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া এবং সাংগঠনিক সম্পাদক শাহে আলম মুরাদ। দেহে স্প্রিন্টার নিয়ে ভুগতে ভুগতে হানিফ চিরবিদায় নেন। সেদিনের ঘটনার বর্ণনা দিয়ে মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া বলেন, সারা বাংলাদেশে সিরিজ বোমা হামলা, সমাবেশে হামলা, সন্ত্রাসী কর্মকান্ডে মানুষ দিশাহারা। তারই প্রতিবাদে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা আমাদের মহানগর আওয়ামী লীগকে নির্দেশ দেন সমাবেশ ও মিছিল করার জন্য। আমরা মুক্তাঙ্গনে সমাবেশ করার জন্য সিটি করপোরেশন, পুলিশ কমিশনার, ডিসি অফিসে আবেদন দিই। কিন্তু ২০ তারিখ পর্যন্ত কোনো উত্তর দেয়নি। তখন দলীয় কার্যালয়ের সামনে সমাবেশ করার প্রস্তুতি গ্রহণ করি। সাবেক মন্ত্রী মায়া বলেন, ‘মিটিংয়ের শেষের দিকে নেত্রী এসে বক্তব্য শেষ করলেন, ঠিক এমন সময় সাংবাদিক গোর্কিসহ কয়েকজন বলল আমরা ছবি পাইনি। পরে একটু ঘুরে এসে আমার হাত থেকে মাইকটা নিয়ে নেত্রী আবার এক মিনিটের মতো মাইকের সামনে ছিলেন। নেত্রী ঘুরে নামার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন, এমন সময় বিকট শব্দ। আমরা ভাবছিলাম হয়তো ট্রাকের চাকা ব্লাস্ট হয়েছে। কিন্তু কয়েক সেকেন্ডের মাথায় আরেকটা ব্লাস্ট হলো। এরপর একটা বিকট শব্দ আর চারদিকে ধোঁয়া, চিৎকার। তখন আপাকে (শেখ হাসিনা) ধরে আমি আর হানিফ ভাই টেবিলের নিচে দিয়ে আমরা কয়েকজন ওপরে পড়ে থাকি। তখন ট্রাকের অনেকেই যে যেভাবে পেরেছে নিচে নেমে গেছে। যখন দেখলাম বন্ধ হয়েছে তখন আপাকে ধরে ট্রাক থেকে নামিয়ে গাড়িতে নিয়ে যাই। আপা তখন বলেন, ‘তোরা আমারে কই নিয়া যাস, আমার নেতা-কর্মীরা এখানে পইড়া আছে’। আমি বলেছি, আপা আপনাকে আগে নিয়া যাই পরে দেখি কী হচ্ছে। এর মধ্যেই মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সামনে থেকে সমানে গুলি শুরু। এরপর আপাকে সুধাসদনে রাখি। আপা বললেন, ‘জাহাঙ্গীর (শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত সহকারী), মায়া তোরা দেখ পার্টি অফিসে কী হইতাছে’। আমরা গাড়ি নিয়ে ঢাকা ক্লাবের সামনে পর্যন্ত আসতে পারলাম, এরপর আর আসতে দেয় না। তখন দৌড়ে পার্টি অফিসে আসি। দেখি আরেক কা , মানুষের রক্ত চারদিকে, চিৎকার। আর পুলিশ শুরু করেছে লাঠিচার্জ ও টিয়ার গ্যাস ছোড়া। এর মধ্যেই যে যেভাবে পারছে আহত নেতা-কর্মীদের হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে। সেই ঘটনা মনে পড়লে আজও আঁতকে উঠি।’ সমাবেশে পল্লবী থেকে ৮৪টি ট্রাকে লোকজন নিয়ে উপস্থিত হন পল্লবী থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও বর্তমান ঢাকা-১৬ আসনের সংসদ সদস্য ইলিয়াস উদ্দিন মোল্লাহ। গ্রেনেড হামলায় গুরুতর আহত হন তিনি। এখনো শরীরে বয়ে বেড়াচ্ছেন স্প্রিন্টার। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘শরীরে অসংখ্য স্প্রিন্টার বহন করছি। মাঝে-মধ্যে পা ব্যথা করে। অস্থায়ী মঞ্চ ‘বিবা-ঢাকা মেট্রো ট-১১-৩০৯৮’-এর পাশেই ছিলাম। নেত্রী মঞ্চ থেকে নামবেন এমন সময় গ্রেনেড হামলা। কিছু বুঝে ওঠার আগেই মানুষের আহাজারি ও আর্তনাদ। আমার জীবনে এমন মৃত্যু ও রক্ত কখনো দেখিনি।  স্বেচ্ছাসেবক লীগের তৎকালীন সভাপতি বর্তমানে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম গুরুতর আহত হন। তিনি বলেন, আমি তিন দিন আইসিইউতে ছিলাম, তিন দিন পর আমার জ্ঞান ফিরে আসে। ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে উঠলাম। এরপর অস্ত্রোপচারের জন্য বিদেশে গিয়েছিলাম। একটি গ্রেনেডে প্রচুর পরিমাণে স্প্রিন্টার থাকে, যখন আঘাত করে তখন বোঝা যায় না কিন্তু যখন রক্ত ঝরতে থাকে, তখন বোঝা যায় তার বিষক্রিয়া। এখনো শরীরে অনেক স্প্রিন্টার।

 তিনি বলেন, এ ধরনের নারকীয় হামলা পৃথিবীর ইতিহাসে এই প্রথম। রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় এমন ঘটনা যেন আর না ঘটে। আওয়ামী লীগের অন্য নেতাদের সঙ্গে সেদিন গুরুতর আহত হন ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি, বর্তমান পানিসম্পদ উপমন্ত্রী এ কে এম এনামুল হক শামীম। তাকে প্রথমে নেওয়া হয় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। সেখানে তাকে ভর্তি করা হয়নি। এরপর নিয়ে যাওয়া হয় সিকদার মেডিকেলে। তিনি জানালেন এখনো শরীরে ২৪টি স্প্রিন্টার বয়ে বেড়াচ্ছেন। অমাবস্যা, পূর্ণিমার রাতে কিংবা আকাশে মেঘ জমলে প্রচণ্ড ব্যথা করে। সেদিনের স্মৃতি কোনো দিন ভুলবার নয়। গ্রেনেড হামলার শিকার আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক এস এম কামাল হোসেনের খাদ্যনালির ৯ ইঞ্চি কেটে ফেলা হয়েছিল। সেই দুঃসহ স্মৃতিচারণ করে এস এম কামাল হোসেন বলেন, ‘মানুষের দোয়ায় এবং আল্লাহর রহমতে এখন ভালো আছি। সেদিনের সেই ভয়ঙ্কর ঘটনা মনে পড়লে এখনো দুই চোখ বন্ধ হয়ে আসে।’ তিনি বলেন, শেখ হাসিনাকে হত্যা করাই ছিল ঘাতকদের উদ্দেশ্য। ’৭৫-এর ঘাতকের প্রতিনিধিরাই একুশে আগস্ট ঘটিয়েছিল। ‘এই হামলা যে শুধু আওয়ামী লীগকে নেতৃত্বশূন্য করার জন্য করা হয় তা নয়, ১৫ আগস্টের কুশীলবরা এ হামলার মাধ্যমে দেশকে গণতন্ত্রশূন্য করতে চেয়েছিল।’ গুরুতর আহত হন ঢাকা মহানগর উত্তর আওয়ামী লীগের বর্তমান সভাপতি শেখ বজলুর রহমান। তিনি বলেন, শরীরের অসংখ্য স্পি­ন্টার। আমি এখনো থেরাপি নিই। শরীরের ক্ষত অনেকটা শুকিয়েছে, কিন্তু মনের ক্ষত শুকায়নি। কারণ বিচারের রায় আংশিক হয়েছে, পূর্ণাঙ্গ রায়টি হয়নি। এখন রায় এবং শাস্তি দেখে যেতে চাই। যারা বিচার কাজে সংশ্লিষ্ট তাদের কাছে একটাই দাবি, শুধু সামনাসামনি যারা করেছে, তারাই নয়, এর পেছনে কারা ছিল তাদের মুখও যেন উন্মোচন করা হয়।

গ্রেনেড হামলায় আহত সবুজবাগ থানা আওয়ামী লীগের সাবেক সদস্য বখতিয়ার উদ্দিন বলেন, দলীয় সভানেত্রী শেখ হাসিনার বক্তব্য শেষ করলেন। এক সাংবাদিক বললেন, আপা ছবি পাইনি। আপা দাঁড়ালেন। তখনই একটা গ্রেডেন পড়ে। ওদিক-ওদিক ছোটাছুটি শুরু হয়। প্রয়াত আইভী আপাসহ অনেকেই আমার গায়ের ওপর পড়েন। এরপর লাশ আর লাশ দেখতে পেলাম। তখন আমার শ্বাসকষ্ট হতে লাগল, প্রচ  ব্যথা পেয়েছি বুকে। হাত দিয়ে দেখি আমার পেট ঠিক আছে কিন্তু সমস্ত শরীর ভিজে গেল। আমি তখন বাঁচাও বলে চিৎকার শুরু করি। আমাকে বাঁচানোর জন্য কেউ এগিয়ে না এলেও আমি হামাগুড়ি দিয়ে চাচ্ছি যে এই স্থলটা ত্যাগ করব। তখন দুই ভদ্রলোক আমাকে টেনে নিয়ে রিকশায় উঠাবে ঠিক তখন দেখি পুলিশে গুলি ছুড়ছে। হলিফ্যামিলি হাসপাতালের দিকে যেতেই কাকরাইলে প্রধান বিচাপতির বাড়ি পার হয়ে আমি সেন্সলেস হয়ে যাই। রাত ১২টা বাজে জ্ঞান ফিরে দেখি একহাত মতিয়া আপা আর এক হাত মায়া ভাই ধরে বসে আছেন। আমার অবস্থা সিরিয়াস হয়ে যায়। এভাবে আমি আট-দশ দিন হাসপাতালে মানবেতর জীবন কাটিয়েছি। সেই দুঃসহ স্মৃতি আজও আমায় তাড়া করে।

সর্বশেষ খবর