শনিবার, ২৯ অক্টোবর, ২০২২ ০০:০০ টা

প্রকল্পে ধীরগতি, ব্যাহত বিদ্যুৎ বিতরণ

জিন্নাতুন নূর

শতভাগ বিদ্যুতায়নে লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করলেও সঞ্চালন ব্যবস্থার দুর্বলতায় নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ করা যাচ্ছে না। এমনকি বিদ্যুতের চাহিদা বাড়ানোর ক্ষেত্রেও এটি প্রতিবন্ধক হিসেবে কাজ করছে। সরকারের বড় প্রকল্পগুলোর একটি বিদ্যুৎ উৎপাদনের সক্ষমতা নিয়ে দুই বছর অলস বসে রয়েছে। সঞ্চালন লাইন নির্মাণকাজ শেষ না হওয়ায় কেন্দ্রটি থেকে বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে দেওয়া যাচ্ছে না। সরকার সঞ্চালন লাইন নির্মাণসহ এটি শক্তিশালী করতে বেশকিছু প্রকল্প নিয়েছে। তবে এরই মধ্যে অনেক প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হয়ে এলেও অগ্রগতি সন্তোষজনক নয়। পুরনো ও জরাজীর্ণ লাইনে সক্ষমতার বেশি বিদ্যুৎ সঞ্চালনে গ্রিড বিপর্যয়ের আশঙ্কা তৈরি হচ্ছে। জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশে গত একযুগে বিদ্যুৎ খাতে বিনিয়োগের বড় অংশ গেছে বিদ্যুৎ উৎপাদনে। সঞ্চালন ও বিতরণে বিনিয়োগ বাড়েনি। যেসব প্রকল্প নেওয়া হয়েছে তা অনেক দেরিতে। তারা বলেন, সরকার নতুন বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণে যত আগ্রহী, সঞ্চালন লাইন নির্মাণে তত আগ্রহী নয়। অতি পুরনো ও জরাজীর্ণ সঞ্চালন লাইনে সক্ষমতার বেশি বিদ্যুৎ সঞ্চালন করা হলে বিপর্যয় দেখা দিতে পারে। সঞ্চালন লাইনে ত্রুটি বা বিদ্যুৎ সঞ্চালনে ফ্রিকোয়েন্সিতে হেরফের হলে গ্রিড বিপর্যয়ও হতে পারে।

সংশ্লিষ্টরা বলেন, চলতি বছরের নভেম্বর নাগাদ পায়রা তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের সঞ্চালন লাইন নির্মাণকাজ শেষ হবে। এর ফলে বিদ্যুৎ কেন্দ্রটির দুটি ইউনিটের বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে যুক্ত করা যাবে। এর মাধ্যমে রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রের বিদ্যুৎও জাতীয় গ্রিডে যুক্ত করা যাবে। বরিশালের বেসরকারি খাতের ৩০০ মেগাওয়াটের আরেকটি বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে বাড়তি বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে যোগ করা সম্ভব হবে। রূপপুর প্রকল্পের প্রথম ইউনিটের কাজ শেষ হওয়ার আগে সেখানকার সঞ্চালন লাইনটি পুরোপুরি নির্মাণ না হলেও সেখান থেকে বিদ্যুৎ আনার বিষয়ে তারা আশাবাদী।

সংশ্লিষ্টরা আরও বলছেন, সরকারের পরিকল্পনা অনুযায়ী ট্রান্সমিশন নিয়ে কাজ চলছিল। কিন্তু বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও কারিগরি সমস্যায় কোনো কোনো জায়গায় এ কাজ পিছিয়ে গেছে। এর অর্থ এই নয় যে, সঞ্চালন লাইন নির্মাণে বিদ্যুৎ বিভাগ আগ্রহী নয়। এ ছাড়া বিশাল এলাকাজুড়ে একের পর এক বিদ্যুতের টাওয়ার নির্মাণ করতে হলে যে পরিমাণ জমি অধিগ্রহণ করতে হয় তা পাওয়া খুব মুশকিল। সঞ্চালন লাইন নির্মাণে অনেক বাধা থাকে। এ জন্য এর কাজ শেষ হতে দেরি হয়।

বিদ্যুৎ সঞ্চালন অবকাঠামো বাস্তবায়নের দায়িত্ব রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশের (পিজিসিবি)। সংস্থাটির কর্মকর্তাদের মতে, ভূমি অধিগ্রহণ জটিলতা, দরপত্র আহ্বান ও কভিড মহামারির কারণে এ প্রকল্পের কাজ পিছিয়ে গেছে। এখন এ খাতে গুরুত্ব দেওয়ায় বেশির ভাগ প্রকল্পের কাজ দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলছে। পিজিসিবির তথ্যে, ২০২০-২১ অর্থবছরে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির আওতায় সংস্থাটির ২০টি প্রকল্প বাস্তবায়নাধীন রয়েছে। যার সবই নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ ও গ্রিড কানেকটিভিটি বাড়ানোর জন্য। তবে প্রকল্পের ধীরগতির কারণে এর মেয়াদ ও ব্যয় দুটোই বাড়ছে। এসব প্রকল্পের মেয়াদ চলতি বছর ও ২০২৩ সাল নাগাদ শেষ হওয়ার কথা। কিন্তু এর অগ্রগতি দেখে ধারণা করা হচ্ছে এসব প্রকল্পের কাজ শেষ হতে আরও দুই/তিন বছর লেগে যেতে পারে। দেশে ২০৩০ সালের মধ্যে সঞ্চালন লাইন ২৮ হাজার কিলোমিটারে পৌঁছানোর কথা। যা বর্তমানে আছে প্রায় ১৩ হাজার ৮৮৯ কিমি.। গত একযুগে সঞ্চালন লাইন বেড়েছে মাত্র ৫ হাজার ৮৮০ কিমি.।

সঞ্চালন অবকাঠামো নির্মাণ নির্ধারিত সময়ে সম্পন্ন করতে না পারায় বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো পূর্ণ সক্ষমতায় চালানো যাচ্ছে না। পায়রা ১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াট সক্ষমতার কয়লাভিত্তিক তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রটির প্রথম ইউনিট উৎপাদন শুরু করে ২০২০ সালে। দ্বিতীয় ইউনিট উৎপাদন শুরু হয় ২০২১ সালে। কিন্তু সঞ্চালন লাইন না থাকায় দুই বছর ধরে বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি সক্ষমতার অর্ধেক বিদ্যুৎ উৎপাদন করছে। অথচ গত দুই বছরে ক্যাপাসিটি চার্জ বাবদ গুনতে হয়েছে প্রায় সাড়ে ৪ হাজার কোটি টাকা।

করোনা মহামারিতে দেশের সবচেয়ে ব্যয়বহুল রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের কাজ না থামলেও এ বিদ্যুৎ কেন্দ্রে নির্ধারিত সময়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন শুরু করা নিয়ে এরই মধ্যে আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। কারণ এ প্রকল্পের সঙ্গে তাল মিলিয়ে পিজিসিবি কর্তৃপক্ষ সঞ্চালন লাইনের কাজ শেষ করতে পারবে কি না তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। ভারত থেকে ঋণের অর্থ ছাড় ও ঠিকাদার নিয়োগে বিলম্ব হওয়ায় এই বিদ্যুৎ কেন্দ্রের সঞ্চালন লাইন নির্মাণকাজ নির্ধারিত সময়ে শেষ করা যাচ্ছে না। এ প্রকল্পের মেয়াদ আরও এক বছর বাড়ানো হয়েছে। যদিও চলতি বছরের ডিসেম্বরে এর কাজ শেষ হওয়ার কথা ছিল। সম্প্রতি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠকে প্রকল্পটির সঞ্চালন লাইন নির্মাণের অগ্রগতি নিয়ে উপস্থাপন করা প্রতিবেদনে এসব তথ্য তুলে ধরা হয়।

জানা যায়, রূপপুর প্রকল্পের বিদ্যুৎ ইভাকুয়েশনের জন্য ৪০০ কেভি ৪৬৪ কিমি. এবং ২৩০ কেভি ২০৫ কিমি. সঞ্চালন লাইন রয়েছে। এর মধ্যে ২০ কিমি. নদী ক্রসিং। ইভাকুয়েশন প্রকল্পের নদী ক্রসিংয়ের জন্য দরপত্র আহ্বান করা হয়েছে। জমি অধিগ্রহণ শেষ। শুরু হয়েছে মাঠপর্যায়ের কাজ।

দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে নির্মাণ করা হচ্ছে ১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াট সক্ষমতার রামপাল কয়লাভিত্তিক তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র। ভারত ও বাংলাদেশের যৌথ অর্থায়নে নির্মাণাধীন এ প্রকল্পের জন্য আমিনবাজার-মাওয়া-মোংলা ৪০০ কেভি সঞ্চালন লাইন নির্মাণ করা হচ্ছে। চলতি বছরের জুন নাগাদ এ প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু পদ্মা রিভার ক্রসিংয়ের কারণে তা চলতি বছর শেষ নাগাদ লেগে যেতে পারে। এতে রামপালে বিদ্যুৎ উৎপাদন শুরু হলেও সেই বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে যুক্ত করা না গেলে তা কোথায় ব্যবহার করা হবে তা নিয়ে অনিশ্চয়তা রয়েছে।

সঞ্চালন লাইন নির্মাণে পিছিয়ে থাকার কথা স্বীকার করেছেন বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদও। তিনি সম্প্রতি সচিবালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, আমাদের সঞ্চালন ব্যবস্থা অনেক পিছিয়ে আছে। আরও আধুনিকভাবে আমাদের কাজ করতে হবে। আমরা যত দ্রুত অটোমেশনে যাব, তত দ্রুত সমস্যা কমে আসবে।

পাওয়ার সেলের মহাপরিচালক মোহাম্মদ হোসেইন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, বর্তমানে বিদ্যুৎ উৎপাদনে আর কোনো সমস্যা নেই। এখন পুরো ফোকাস সঞ্চালন লাইন নির্মাণে। আমরা লাইন আপগ্রেড করার কাজ করছি। জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ম. তামিম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে গতকাল বলেন, আমাদের সঞ্চালন ও বিতরণ ব্যবস্থাপনায় কখনো বড় ধরনের বিনিয়োগ হয়নি। বিদ্যুতের সিস্টেম ম্যানেজ করতে হলে এ ব্যবস্থার আধুনিকায়ন করতেই হবে। বিদ্যুতের ট্রান্সমিশন ও ডিস্ট্রিবিউশন নিয়ে কাজ করার জন্য অনেক আগে থেকেই বলা হচ্ছে। গত কয়েক বছর ধরে এ জন্য চেষ্টাও করা হচ্ছে। তবে নতুন লাইন স্থাপনেই বেশি অর্থ খরচ হচ্ছে। যে অর্থ খরচ হচ্ছে তার বেশির ভাগই নতুন বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর লাইন নির্মাণে। পুরনো লাইন সংস্কারে বা প্রতিস্থাপনে খুব বেশি প্রকল্প নেই।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর