বুধবার, ২ নভেম্বর, ২০২২ ০০:০০ টা

বিদ্যুৎ-জ্বালানি নিয়ে উত্তপ্ত সংসদ

নিজস্ব প্রতিবেদক

বিদ্যুৎ-জ্বালানি নিয়ে উত্তপ্ত সংসদ

দেশের বিদ্যুৎ ও জ্বালানি পরিস্থিতি নিয়ে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী এবং বিরোধী দল জাতীয় পার্টি ও বিএনপির এমপিদের বাহাসে গতকাল উত্তপ্ত হয়ে উঠেছিল সংসদ। সংসদের বিরোধী দল জাতীয় পার্টির এমপি মুজিবুল হক চুন্নু বলেন, রেন্টাল-কুইক রেন্টাল কোম্পানিকে ৮৬ হাজার কোটি টাকা দেওয়া হয়েছে। আবার সঞ্চালন লাইনের অভাবে তাদের কাছ থেকে বিদ্যুৎ নেওয়া যাচ্ছে না। প্রকৃত পরিস্থিতি আসলে কী জানতে চান তিনি। আর বিএনপির সংসদীয় দলের নেতা মো. হারুনুর রশীদ অভিযোগ করেন, ‘দেশের বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে হরিলুট চলছে। প্রতিমন্ত্রী মহোদয় প্রশ্নোত্তরে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের কথা ৫০ বার বলেছেন। দয়া করে তিনি কি জানাবেন বিএনপি আমলে বিদ্যুতের দাম, চালের দাম, তেলের দাম, ডিমের দাম কত ছিল, গ্যাসের দাম কত ছিল? দায়মুক্তি কেন এখনো বহাল রেখেছেন?’ এ সময় তিনি বিষয়টি নিয়ে এক দিন সংসদে সাধারণ আলোচনার দবি জানান। জবাবে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেন, ‘বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার আমলে দিনে ১৭ ঘণ্টা দেশ অন্ধকারে ছিল। বিদ্যুৎ চাওয়ায় গুলি করে মানুষ হত্যা করা হয়েছে। আর উনি বিদ্যুতের দামের কথা বলেন? আমিও চাই সংসদে এক দিন সময় দেওয়া হোক। জ্বালানি নিয়ে আলোচনা হোক। নাইকো মামলা নিয়ে যে পরিমাণ তথ্য আমাদের হাতে আছে, তাদের নেতা তারেক জিয়ার বন্ধু যে পরিমাণ সাক্ষাৎকার এফবিআইর কাছে দিয়েছেন, এর রেকর্ড আমরা তুলে ধরতে চাই।’ স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীর সভাপতিত্বে সংসদের ২০তম অধিবেশনের তৃতীয় দিনের বৈঠকের প্রশ্নোত্তর পর্বে সম্পূরক প্রশ্নের সময় মন্ত্রী ও এমপিদের মধ্যে এ বাহাস অনুষ্ঠিত হয়। সম্পূরক প্রশ্ন করতে গিয়ে বিএনপির এমপি ব্যারিস্টার রুমিন ফারহানাও জ্বালানি বিষয়ে সরকারের সমালোচনা করেন। হারুনুর রশীদের বক্তব্যে সরকারদলীয় সদস্যরা প্রতিবাদ করতে থাকেন। এর মধ্যেই হারুনুর রশীদ বক্তব্য চালিয়ে যান। ফলে হইচইয়ের সৃষ্টি হয়। এ পর্যায়ে হারুনুর রশীদকে থামানোর চেষ্টা করেন স্পিকার। তিনি বিএনপি এমপিকে প্রশ্ন করার অনুরোধ জানান। হারুনুর রশীদ বলেন, ‘আমি জোট সরকারের আমলে চালের দাম, তেলের দাম, ডিমের দাম, বিদ্যুতের দাম কত ছিল তা জানতে চাই।’ এর আগে সম্পূরক প্রশ্ন করতে দাঁড়িয়ে হারুনুর রশীদ বলেন, ‘বিদ্যুৎ-জ্বালানি খাতে লুটপাট চলছে, ভয়ানক অরাজকতা চলছে। এক দিন সময় দিন, সংসদে আলোচনা হোক। আমরা আলোচনা করব।’ তিনি বলেন, ‘আমি স্পষ্ট জানতে চাইছি, বিএনপি সরকার যে গ্যাসের চুক্তি করেছিল, এমন কোনো চুক্তির প্রমাণ আপনার কাছে আছে কি না। থাকলে সেটা এ সংসদে উপস্থাপন করবেন।’ দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির সমালোচনা করে হারুনুর রশীদ বলেন, ‘বিএনপির আমলে চালের দাম কত ছিল? একটি ডিমের দাম কত ছিল? দুধের কেজি কত ছিল? এ উত্তরগুলো সংসদে দিন। শুধু দায়ী করলে হবে না। মাননীয় স্পিকার, আপনি সময় নির্ধারণ করে দিন। শুধু জ্বালানি খাত নিয়ে আলোচনা হোক। আজকে দেশের মানুষ হাহাকার করছে। তারা বিদ্যুৎ পাচ্ছে না। আজকে জ্বালানি উপদেষ্টা বলছেন, দিনের বেলায় বিদ্যুৎ পাওয়া যাবে না। এটা কী হচ্ছে! আগামীতে বিদ্যুৎ-গ্যাসের দাম আর বাড়ানো হবে না, আপনি সেই আশ্বাস দিন।’ জবাবে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেন, ‘সংসদ সদস্য অনেক উত্তেজিত হয়েছেন। সত্য কথা অনেকে সহজভাবে নিতে পারেন না। সিদ্ধিরগঞ্জ পাওয়ার প্লান্টে যে পরিমাণ চুরি হয়েছে, সেই তথ্য-প্রমাণও আমাদের হাতে আছে। আমরা সেগুলো এ সংসদের স্ক্রিনে দেখাতে চাই। খাম্বা কোম্পানি তৈরির পর লুটপাটের হিসাবও আমাদের কাছে আছে। নির্বাচন সামনে আসছে, প্রস্তুত থাকুন, সবকিছু আমরা দেশবাসীকে দেখাব।’ তিনি বলেন, ‘জোট সরকারের সময় বিদ্যুতের অপচয় ছিল ৪৪ শতাংশ। এ অপচয়টা দুর্নীতির মধ্যে পড়ে। পাঁচবার দুর্নীতিতে চ্যাম্পিয়ন হয়েছেন তারা। বিদ্যুৎ চাওয়ার কারণে কানসাটে গুলি করে মানুষ হত্যা করা হয়েছে। খাদ্যই তো দিতে পারেননি, দাম নিয়ে আলোচনা কী হবে! ঘণ্টার পর ঘণ্টা আলোচনা চলবে। লজ্জাশরম নেই বলেই তারা এ আলোচনা করেন।’ এরপর সম্পূরক প্রশ্ন উত্থাপনকালে জাপা মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু বলেন, ‘আমরা লোডশেডিংয়ের মধ্যে আছি। আশা করেছিলাম এ পরিস্থিতির উন্নতি হবে। কিন্তু এর মধ্যে প্রধানমন্ত্রীর জ্বালানি উপদেষ্টা জানালেন আগামীতে দিনের বেলায় বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ হতে পারে। জানি না কী পরিস্থিতি তৈরি হবে! পত্রপত্রিকায় দেখলাম বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য বেসরকারি রেন্টাল-কুইক রেন্টাল কোম্পানিকে ৮৬ হাজার কোটি টাকা দেওয়া হয়েছে। আবার সঞ্চালন লাইনের অভাবে তাদের কাছ থেকে বিদ্যুৎ নেওয়া যাচ্ছে না।’ আসলে পরিস্থিতি কী তা জানানোর অনুরোধ জানান তিনি। জবাবে প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেন, ‘বেসরকারি কোম্পানিকে ক্যাপাসিটি চার্জ বাবদ কত দেওয়া হয়েছে তা জানার জন্য চিঠি দিতে হবে। জ্বালানি উপদেষ্টা পরিস্থিতি খারাপ হলে দিনের বেলা বিদ্যুৎ বন্ধের কথা বলেছেন। কিন্তু সে অবস্থা এখনো তৈরি হয়নি। আমরা ভালোর দিকে যাচ্ছি।’ তিনি বলেন, ‘সঞ্চালন লাইনের কোনো সমস্যা নেই। সমস্যা জ্বালানির। সেই সমস্যা সমাধানের চেষ্টা চলছে।’ বিএনপির রুমিন ফারহানা বলেন, ‘রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণে বাংলাদেশের ব্যয় হচ্ছে সোয়া ১ লাখ কোটি টাকা। আর একই ধরনের একটি বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণে ভারতের ব্যয় হচ্ছে ২৮ হাজার কোটি টাকা। পাকিস্তান আমলে ভূমি অধিগ্রহণ সত্ত্বেও কেন চার গুণ বেশি ব্যয় হচ্ছে?’ কাতারসহ অন্য দেশ থেকে সুযোগ থাকা সত্ত্বেও স্পট মার্কেট থেকে কেন জ্বালানি কেনা হচ্ছে তা জানতে চান তিনি। এর আগে সরকারি দলের সদস্য শহীদুজ্জামান সরকারের লিখিত প্রশ্নের জবাবে প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেন, দেশে মোট উত্তোলনযোগ্য প্রমাণিত ও সম্ভাব্য গ্যাসের মজুদ (২পি) ২৮ দশমিক ৫৯ ট্রিলিয়ন ঘনফুট। তবে শুরু থেকে চলতি বছর ৩০ জুন পর্যন্ত দেশে ক্রমপুঞ্জীভূত গ্যাস উৎপাদনের পরিমাণ ১৯ দশমিক ৫৩ ট্রিলিয়ন ঘনফুট। সে হিসাবে বর্তমানে উত্তোলনযোগ্য অবশিষ্ট মজুদের পরিমাণ ৯ দশমিক ০৩ ট্রিলিয়ন ঘনফুট। দেশি গ্যাস ক্ষেত্র থেকে বর্তমানে দৈনিক গড়ে প্রায় ২ হাজার ৩০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস উৎপাদন বিবেচনায় অবশিষ্ট মজুদ গ্যাস ১০ দশমিক ৮ বছর ব্যবহার করা সম্ভব হবে।

সর্বশেষ খবর