বৃহস্পতিবার, ১৭ নভেম্বর, ২০২২ ০০:০০ টা

সড়ক দাপিয়ে বেড়াচ্ছে অপ্রাপ্তবয়স্ক চালক

♦ নেই ড্রাইভিং লাইসেন্স বা প্রাতিষ্ঠানিক প্রশিক্ষণ ♦ ইজিবাইক, লেগুনা, নসিমন, করিমনে অপ্রাপ্তবয়স্ক চালক বেশি ♦ দাপিয়ে বেড়াচ্ছে শিশু বাইকার ♦ বাড়ছে দুর্ঘটনা।

শামীম আহমেদ

সড়ক দাপিয়ে বেড়াচ্ছে অপ্রাপ্তবয়স্ক চালক

রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে সড়ক দাপিয়ে বেড়াচ্ছে ড্রাইভিং লাইসেন্সবিহীন অপ্রাপ্তবয়স্ক চালক। নিরাপত্তাহীন করে তুলেছে সড়ক-মহাসড়ক। হামেশা দুর্ঘটনায় প্রাণ যাচ্ছে মানুষের। লেগুনা, থ্রি-হুইলার, নসিমন, করিমন, ভটভটি, মাটি-ইট-বালু বহনকারী ট্রাকে শিশু চালকের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। গ্রামে-মফস্বলে স্কুলগামী শিক্ষার্থীরা  মোটরসাইকেল নিয়ে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে সড়কে। দুর্ঘটনায় নিজের প্রাণই দিচ্ছে না, ঝুঁকিতে ফেলছে অন্যদের। সড়ক পরিবহন আইনটি কাগজে থাকলেও বাস্তবে না থাকায় অনিয়ম বেড়েই চলেছে।

সরেজমিন রাজধানীর মিরপুর-১ নম্বর চত্বর, গুলিস্তান, বাসাবো, মাদারটেক, যাত্রাবাড়ী, পুরান ঢাকা, টিঅ্যান্ডটি অফিসের সামনে, কাপ্তানবাজার এলাকায় মুরগি মার্কেটের সামনে, মতিঝিলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সামনে বিভিন্ন লেগুনায় অসংখ্য অপ্রাপ্তবয়স্ক চালকের দেখা মিলেছে। তবে বাসে এমন চালক চোখে পড়েনি। গত সোমবার মিরপুর-১ চত্বরে দাঁড়িয়ে থাকা লেগুনায় চালকের আসনে বসা ১৫-১৬ বছরের রাকিবের ড্রাইভিং লাইসেন্স আছে কি না জানতে চাইলে সে জানায়, ‘আমি ড্রাইভার না। লাইসেন্সও নাই। দুপুরে ওস্তাদ (চালক) ভাত খাইতে বাসায় যায়। তখন আমি ট্রিপ মারি।’

খিলক্ষেত এলাকায় চলাচলকারী মোটরচালিত থ্রি-হুইলারের অনেক চালকের বয়স ১৫ বছরের কম। আইন অনুযায়ী ড্রাইভিং লাইসেন্সের আবেদনকারীর ন্যূনতম শিক্ষাগত যোগ্যতা অষ্টম শ্রেণি পাস হতে হবে। অপেশাদার লাইসেন্সের জন্য ন্যূনতম ১৮ বছর এবং পেশাদার ড্রাইভিং লাইসেন্সের জন্য বয়স ন্যূনতম ২১ বছর হতে হবে। অথচ ১৪-১৫ বছরেই পেশাদার হিসেবে চালকের আসনে বসে যাচ্ছে অনেক শিশু-কিশোর। সড়কের নিয়ম-কানুন না জানা, প্রশিক্ষণের অভাব, কম বয়সের কারণে প্রতিযোগিতার মানসিকতায় হরহামেশা দুর্ঘটনা ঘটাচ্ছে এসব চালক। জানা গেছে, ঢাকা মহানগরীর চেয়ে অপ্রাপ্তবয়স্ক চালকের সংখ্যা বেশি মফস্বলে। স্বেচ্ছাসেবী গবেষণা সংস্থা সেভ দ্য রোড-এর তথ্যানুযায়ী, সারা দেশে বর্তমানে পরিবহন খাতে শ্রম দিচ্ছে প্রায় ১ লাখ ৫৫৫ জন শিশু-কিশোর। এর একটি অংশ চালক, একটি অংশ চালকের সহকারী। এদের নেই প্রশিক্ষণ বা ড্রাইভিং লাইসেন্স। প্রতিদিন গড়ে এখন ৯০০-এর ওপরে ছোট-বড় দুর্ঘটনা ঘটছে, যার বড় অংশই শিশু শ্রমিকদের অংশগ্রহণের কারণে। সংস্থাটির মহাসচিব শান্তা ফারজানা বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, আমরা সর্বস্তরের স্বেচ্ছাসেবীদের দিয়ে সরেজমিন তথ্য সংগ্রহ করে প্রতিবেদন তৈরি করেছি। তাতে পরিবহন খাতে রাজধানী ঢাকায় ৩৬ হাজার ৫০, চট্টগ্রামে ১৯ হাজার ৫০, খুলনায় ১৪ হাজার ৩৮০, বরিশালে ৮ হাজার ২৬০, সিলেটে ৮ হাজার ৩৪০, রাজশাহীতে ৬ হাজার ৩৫০, রংপুরে ৫ হাজার ৫৬৫ এবং ময়মনসিংহে ৪ হাজার ১৬০ জন শিশু-কিশোর পেয়েছি। তিনি বলেন, করোনায় অনেক শিশু-কিশোর স্কুল থেকে ঝরে পড়েছে। অভাবের সংসারে অর্থের জোগান দিতে ঝুঁকিপূর্ণ পরিবহন খাতে শ্রম দিচ্ছে। ঝুঁকিপূর্ণ শ্রম থেকে সরিয়ে তাদের শিক্ষাজীবন ফিরিয়ে দিতে হবে। আর্থিক নিরাপত্তার বিষয়টিও দেখতে হবে।

বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির পরিসংখ্যানে প্রায় ৭৩ শতাংশ লেগুনা চালায় অপ্রাপ্তবয়স্করা। অন্যান্য যানবাহনে বিশেষ করে মোটরচালিত রিকশায় অপ্রাপ্তবয়স্ক চালকের সংখ্যা প্রায় ৫০ শতাংশ। বাসে এই সংখ্যাটা কম।

এদিকে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকার ভিতরের সড়কগুলোতে বাইক চালাতে দেখা গেছে অনেক স্কুল-কলেজগামী কিশোরকে। প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হতে দেখা গেছে ৩০০ ফুট পূর্বাচল এক্সপ্রেসওয়েতে। মফস্বলে ১০-১২ বছরের শিশুর হাতেও বাইক তুলে দিচ্ছেন অনেক অভিভাবক। ভাড়ায় মোটরসাইকেল চালাচ্ছে হাজারো অপ্রাপ্তবয়স্ক চালক। এসব কিশোর বয়সীরা সড়কে গতির প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হতে গিয়ে প্রাণ দিচ্ছে। অন্যকে প্রাণে মারছে। গত ৩ নভেম্বর বরগুনার বেতাগীতে মাহফিল থেকে বাড়ি ফেরার পথে  মোটরসাইকেলের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে প্রাণ যায় তিন কিশোরের। তাদের বয়স ছিল ১৩ থেকে ১৬ বছরের মধ্যে। গত ১৫ অক্টোবর মধ্যরাতে ভাঙ্গায় মোটরসাইকেলের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে জনি মাতুব্বর নামে ১৬ বছরের এক কিশোরের মৃত্যু হয়। আগের মাসের ৯ তারিখ রাতে কুষ্টিয়া-ঝিনাইদহ মহাসড়কের বটতৈল এলাকায় মোটরসাইকেল চালানোর প্রতিযোগিতা করতে গিয়ে দুর্ঘটনায় তিন কিশোর নিহত হয়। আহত হয় একজন। প্রতিনিয়ত এমন দুর্ঘটনায় ঝরে যাচ্ছে তাজা প্রাণ। অথচ নিয়মানুযায়ী, ১৮ বছরের নিচে কারও যানবাহন চালানোর সুযোগই নেই। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) হিসাবেই দেশে ১৩ লাখের বেশি লাইসেন্সবিহীন বাইকার আছে।

রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক সাইদুর রহমান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, শিশু চালক বেশি দেখা যায় লেগুনা, ভটভটি, নসিমন, করিমন, ইজিবাইকে। এ ছাড়া মফস্বলে মাটি-ইট-বালু পরিবহন করা ট্রাক-পিকআপেও প্রচুর অপ্রাপ্তবয়স্ক চালক রয়েছে। এদের কারণে ব্যাপকভাবে দুর্ঘটনা বাড়ছে। মহাসড়কে শিশু চালক কম। রাজধানীর বাসেও তেমন নেই, তবে রাজধানীতে চলাচলকারী লেগুনা, ইজিবাইকে প্রচুর অপ্রাপ্তবয়স্ক চালক রয়েছে। তিনি বলেন, প্রশিক্ষণহীন অপ্রাপ্তবয়স্কদের কাছে যানবাহন দিয়ে তাদের হাতে মানুষ মারার অধিকার তুলে দেওয়া হচ্ছে। সড়ক পরিবহন আইনটি কঠোরভাবে বাস্তবায়ন হলে রাস্তায় অপ্রাপ্তবয়স্ক চালকও থাকত না, দুর্ঘটনাও কমে যেত। আইন শুধু কাগজে থাকলে তো লাভ হবে না। বিআরটিএ চেয়ারম্যান নূর মোহাম্মদ মজুমদার বলেছেন, সড়ক পরিবহন আইন বাস্তবায়নে তারা কাজ করে যাচ্ছেন। গত মাসেও ১৭১টি ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করে বিভিন্ন অপরাধে ৯০২টি মামলা, ২৬ জনকে কারাদন্ড ও ৩৩ লাখ ৭১ হাজার ৪০০ টাকা জরিমানা আদায় করা হয়েছে। ডাম্পিং করা হয়েছে ১৮টি যানবাহন। যেসব যানবাহন মালিক অপ্রাপ্তবয়স্কদের দিয়ে গাড়ি চালান, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেবেন। এটা নিয়ে পুলিশও কাজ করছে। এ ছাড়া নতুন যারা পেশাদার লাইসেন্স নিতে আসছেন তাদের বাধ্যতামূলক ডোপ টেস্ট করা হচ্ছে।

সর্বশেষ খবর