রবিবার, ৪ ডিসেম্বর, ২০২২ ০০:০০ টা

ভুয়া অভিযানে আসল পুলিশ

সিআইডির এক পরিদর্শক, তিন কনস্টেবলের নাম

মাহবুব মমতাজী

রাজধানীর লালমাটিয়ায় ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) পরিচয়ে একটি দোকানে অভিযান চালানো হয়। তিন ব্যক্তি সেখানে বিড়ি-সিগারেট বিক্রির কাগজপত্র দেখতে চান। এরপর সেখানে থাকা পাঁচ বস্তা বিড়ি-সিগারেটসহ দোকানদারকে একটি মাইক্রোবাসে তুলে নিয়ে যান তারা। বিভিন্ন এলাকা ঘুরিয়ে তার প্রায় ৬ লাখ টাকা নিয়ে তাকে ছেড়ে দেওয়া হয়। ঘটনাটি ঘটেছে ২৯ অক্টোবর।

শহিদুল ইসলাম নামে ওই ব্যবসায়ী ভুয়া ডিবির অভিযানের বিষয়টি বুঝতে পেরে ১ নভেম্বর রাজধানীর মোহাম্মদপুর থানায় একটি মামলা করেন। মামলা নম্বর-৩।

পরে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, আসলে সেটি ভুয়া ডিবি পুলিশের অভিযান ছিল না। বরং আসল পুলিশই ভুয়া অভিযান পরিচালনা করেছে। পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) এক পরিদর্শকের নেতৃত্বে অভিযানটি চালানো হয়েছিল। ওই পুলিশ পরিদর্শক হলেন মো. সালাউদ্দিন করিম। এমন আরেকটি ঘটনা ধানমন্ডিতেও ঘটেছে।

তবে মোহাম্মদপুরের ঘটনাটিকে ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা চালানো হয় থানা পুলিশের পক্ষ থেকে। মোহাম্মদপুর থানার পরিদর্শক (তদন্ত) শেখ মো. কামরুজ্জামানের সঙ্গে যোগাযোগ করেন এ প্রতিবেদক। তিনি জানান, ওই ঘটনা সম্পর্কে তিনি কিছু জানেন না। আর সেই মামলায় কেউ গ্রেফতারও হননি।

সূত্র বলছে, মোহাম্মদপুরের পর ১ নভেম্বর ধানমন্ডির আওয়ামী লীগ কার্যালয়ের সামনের রাস্তা থেকে মাহবুব আলী খান নামে এক ব্যক্তিকে গ্রেফতার করে নিয়ে যান ১০-১২ জন। সেখানে সিআইডির দুজন সদস্যও ছিলেন। তারা মাহবুবকে শাহবাগ থানার একটি মামলায় আসামি বানিয়ে আদালতে সোপর্দ করেন।

আদালত সূত্রে শহিদুল ইসলামের মামলার কপি সংগ্রহ করা হয়। মামলায় তিনি বলেছেন, ‘লালমাটিয়ায় ফায়ার সার্ভিসের ভিতরে নির্মাণাধীন ভবনের পূর্ব পাশে এক কোনায় একটি স্টিলের বক্সের মধ্যে বিড়ি, সিগারেট ও নগদ টাকাসহ বিভিন্ন মালামাল রাখি। আমার ভাগিনা জাবেদ এসব মালামাল বিক্রিতে সহযোগিতা করে। ২৯ অক্টোবর ডিবি পুলিশ পরিচয়ে লোকজন সেখানে এসে সিগারেট বিক্রির কাগজপত্র দেখতে চায়। এরপর সিগারেটগুলো বস্তায় ভরে মাইক্রোবাসে তুলে আমার বছিলা মেট্রো হাউজিংয়ে বাসায় আসে। এরপর আমার বাসা তল্লাশি করে ওয়্যারড্রপে রাখা নগদ আড়াই লাখ টাকা নিয়ে যায় তারা। আমার ভাগিনা জাবেদকে ছেড়ে দেবে বলে আমার কাছে ১০ হাজার টাকা দাবি করে। পরে আমি মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিস (এমএফএস) বিকাশে ৫ হাজার টাকা পাঠাই। পরে তারা জাবেদকে কলাবাগান মিরপুর রোডে তাজরিন ফার্মেসির সামনে নামিয়ে দিয়ে চলে যায়। এ ছাড়া বিড়ি-সিগারেটগুলোও নিয়ে যায়, যেগুলোর মূল্য ৬ লাখ ২৮ হাজার টাকা।’ আদালত ও থানা পুলিশের বিভিন্ন নথি পর্যালোচনা করে জানা যায়, শহিদুল ইসলামের মামলাটির তদন্ত করেন মোহাম্মদপুর থানার এসআই রাজীব হোসেন। তিনি আসাদগেটে থাকা আড়ং আউটলেটের গেটে স্থাপিত সিসিটিভিতে ২৯ অক্টোবরের ফুটেজ সংগ্রহ করেন। এরপর বছিলা মেট্রো হাউজিংয়ের সি ব্লকের ৪ নম্বর রোডের সিসিটিভি ফুটেজ সংগ্রহ করেন। ফুটেজ বিশ্লেষণ করে ডিবি পরিচয় দেওয়া ব্যক্তিদের গাড়ির নম্বর ঢাকা মেট্রো চ-৫১-৫৯৭৬ পাওয়া যায়। ১৬ নভেম্বর রাত ৮টায় রাজধানীর শ্যামলীতে মোহাম্মদপুর থানার পরিদর্শক (অপারেশন) তোফাজ্জল হোসেনের নেতৃত্বে একটি অভিযান চালায় পুলিশ। সেখানে বিসমিল্লাহ মোটরস-২-এর সামনে মেট্রো চ-৫১-৫৯৭৬ নম্বরের গাড়ির ভিতরে থাকা চারজনকে গ্রেফতার করা হয়। তারা হলেন সিআইডির পুলিশ পরিদর্শক সালাউদ্দিন করিম, গাড়ির চালক বাবু, তাদের সহযোগী মেহেদী হাসান ও বুলবুল চৌধুরী। এ সময় সালাউদ্দিনের কাছে সিআইডির জ্যাকেট এবং কালো রঙের একটি ওয়াকিটকি জব্দ করা হয়। পরে তাদের জিজ্ঞাসাবাদের জন্য সাত দিনের রিমান্ড চেয়ে আদালতে পাঠানো হলে দুই দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন বিচারক। রিমান্ডে আসামিদের জিজ্ঞাসাবাদের পর তাদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী অভিযান চালিয়ে ১৮ নভেম্বর আদাবর থেকে সামিউল আক্তার এবং খিলগাঁও থেকে মনির ও শহিদুল ইসলাম রুবেলকে গ্রেফতার কারা হয়। এদের মধ্যে বাবু আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন।

সিআইডিতে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, পুলিশ পরিদর্শক সালাউদ্দিন করিম সংস্থাটির ঢাকা মেট্রো উত্তর বিভাগে কর্মরত। তার বিষয়ে জানতে চাইলে সিআইডির ঢাকা মেট্রো উত্তরের বিশেষ পুলিশ সুপার খালিদুল হক হাওলাদার বলেন, ‘তার এমন কর্মকান্ডে আমরাও হতভম্ব। তথ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে পুলিশ তাকে গ্রেফতার করেছে। তার বিষয়ে সিআইডি থেকে পুলিশ সদর দফতরে একটি প্রতিবেদন দেওয়া হয়েছে। তাকে ১৬ নভেম্বর থেকে বরখাস্ত করা হয়েছে।’

সাবেক পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) নূর মোহাম্মদ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘সরকারি প্রতিটি প্রতিষ্ঠান নিজস্ব নিয়ম-শৃঙ্খলা মেনে চলে। এটা কেউ ভঙ্গ করলে শাস্তি হিসেবে চাকরি থাকার কোনো সুযোগ নেই। ভুয়া অভিযান চালানোয় জড়িতদের শাস্তির আওতায় আনতে হবে এবং তাদের যারা সুপারভাইজ করেছেন, তাদেরও গাফিলতি আছে। এদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নিতে হবে।’

দক্ষতা বাড়াতে উপদেষ্টা নিয়োগ : এদিকে সংস্থায় বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তার দক্ষতা বাড়াতে কক্সবাজার ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির শিক্ষক খান সরফরাজ আলীকে উপদেষ্টা হিসেবে নিয়োগ দিয়েছে সিআইডি। তিনি অক্টোবর থেকে সিআইডির তদন্ত-সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সভা ও প্রশিক্ষণ পরিচালনা করছেন। এর জন্য তাকে বেতন-ভাতা ও গাড়িসহ বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হয়েছে বলে জানা গেছে। যদিও তার নিয়োগ নিয়ে সিআইডি কিংবা পুলিশ সদর দফতরের কোনো কর্মকর্তাই কথা বলতে রাজি হননি। সিআইডি সূত্র বলছে, তাদের এখানে উপদেষ্টার কোনো পদ নেই। সিআইডির অভ্যন্তরীণ তদন্ত-সংক্রান্ত সভায় এমন উপদেষ্টার উপস্থিতিতে তথ্য পাচারের আশঙ্কায় থাকছেন তদন্ত-সংশ্লিষ্টরা।

এদিকে ধানমন্ডির ৩/এ-তে ১ নভেম্বর সন্ধ্যা ৭টায় প্রকাশ্যে ব্যবসায়ী মাহবুব আলী খানকে তুলে নিয়ে যাওয়ার ঘটনাটি সিনেমার দৃশ্যকেও হার মানিয়েছে। সেখানে আওয়ামী লীগ কার্যালয়ের সামনে শত শত নেতা-কর্মীর উপস্থিতিতে সিআইডি পরিচয়ে আলাপের সুরে ঘিরে ধরে ওই ব্যবসায়ীকে চেংদোলা করে নিয়ে যাওয়া হয়, যা একাধিক সিসি ক্যামেরায় ধরা পড়েছে। লেকপাড়ে নিয়ে গিয়ে চালানো হয়েছে তার ওপর নির্যাতন। হতবিহ্বল মাহবুব তখনো বুঝতে পারেননি কেন তাকে ধরে আনা হলো। ওই রাতে তাকে রাজধানীর মালিবাগে সিআইডি কার্যালয়ে এনে আটকে রাখা হয়। পরদিন ১৯ মে শাহবাগ থানার ২০ নম্বর মামলায় বিশেষ ক্ষমতা আইনের ২৫(এ) ধারায় ঢাকা মুখ্য মহানগর হাকিম (সিএমএম) আদালতে তাকে চালান দেওয়া হয়। ৬ নভেম্বর জামিনে বেরিয়ে আসেন মাহবুব। শাহবাগ থানার ওই মামলা তদন্ত করছে সিআইডি। কিন্তু ওই মামলার এজাহারে মাহবুবের নাম নেই।

এ ঘটনায় মাহবুব বাদী হয়ে ৮ নভেম্বর ধানমন্ডি থানায় মামলা করেন। থানা পুলিশের হাত ঘুরে মামলার তদন্তভার পায় ডিবি। এরপর ৯ নভেম্বর সিআইডির ঢাকা মেট্রো দক্ষিণে কর্মরত মুনশি আবদুর রহমান ও শেখ ফরিদ এবং সুনামগঞ্জের জামালগঞ্জ থানার কনস্টেবল নাজমুল হোসেনকে গ্রেফতার করা হয়। নাজমুল আগে সিআইডিতে কর্মরত ছিলেন। একই সঙ্গে যুবলীগ নেতা বোরহানউদ্দিন রব্বানি ও যোবায়ের শিকদার এবং গাড়িচালক আমিন খানকে গ্রেফতার করা হয়।

সিআইডির ঢাকা মেট্রো দক্ষিণের বিশেষ পুলিশ সুপার আনিচুর রহমান জানিয়েছেন, এরা ভুয়া চালান ও ফরোয়ার্ডিং বানিয়ে ব্যবসায়ী মাহবুবকে আদালতে সোপর্দ করেছিল। দিনের শেষ সময়ে তাকে সোপর্দ করে, যখন আদালত বন্ধ হবে এমন সময়। তখন কাগজপত্র যাচাই করার সুযোগ ছিল না। মাহবুবের মামলায় উল্লেখ করা হয়, ধানমন্ডিতে নির্যাতনের পর তাকে হাতকড়া পরিয়ে সিএনজিচালিত অটোরিকশায় তুলে পল্টনের ইসলাম টাওয়ারের আন্ডারগ্রাউন্ডে নিয়ে যাওয়া হয়। পল্টন থেকে অটোরিকশায় করে কমলাপুর রেলস্টেশনে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে একটি বিকাশ এজেন্ট থেকে প্রথমে তিনি ১ লাখ ১৮ হাজার টাকা উত্তোলন করে তাদের দেন। পরদিন তাকে হাতকড়া পরিয়ে পুরান ঢাকার নবাবপুরের রথখোলা মোড়ের ঈশিতা হোটেলে নিয়ে যাওয়া হয়। মুক্তিপণ হিসেবে তার কাছ থেকে ৩ লাখ ২৮ হাজার ৮৬০ টাকা আদায় করা হয়।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর