শনিবার, ১০ ডিসেম্বর, ২০২২ ০০:০০ টা

মির্জা ফখরুল-আব্বাস কারাগারে

গোলাপবাগ মাঠে আজ সমাবেশ, রাতেই জড়ো হয়েছেন নেতা-কর্মীরা, পুলিশের নিয়ন্ত্রণে নয়াপল্টন

নিজস্ব প্রতিবেদক

মির্জা ফখরুল-আব্বাস কারাগারে

রাজধানীর গোলাপবাগে গতকাল বিকালে জড়ো হন বিএনপি নেতা-কর্মীরা -বাংলাদেশ প্রতিদিন

বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ও দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাসকে গতকাল কারাগারে পাঠানো হয়েছে। এর আগে বৃহস্পতিবার দিবাগত রাত ৩টার দিকে নিজ নিজ বাসা থেকে শীর্ষ এ দুই নেতাকে আটক করে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশ। রাজধানীর নয়াপল্টনে পুলিশের ওপর হামলার পরিকল্পনা ও উসকানি দেওয়ার অভিযোগে পল্টন থানার মামলায় তাদের গ্রেফতার দেখানো হয়। অন্যদিকে গোলাপবাগ মাঠে বিএনপিকে ২৬ শর্তে সমাবেশ করার অনুমতি দেওয়ার পর গতকাল সন্ধ্যায়ই বিএনপি নেতা-কর্মীরা দলে দলে গোলাপবাগ মাঠে যাওয়া শুরু করেন। রাতেই মাঠে নেতা-কর্মীদের উপস্থিতি ছিল চোখে পড়ার মতো। এ ছাড়া নয়াপল্টনে বিএনপি কার্যালয় রয়েছে পুলিশের নিয়ন্ত্রণে। কোনো নেতা-কর্মীকে সেখানে ঘেঁষতে দেওয়া হয়নি। আজ গোলাপবাগ মাঠে সমাবেশ কেন্দ্র করে রাজধানীজুড়ে ছিল কঠোর পুলিশি তৎপরতা। বিভিন্ন স্থান থেকে পুলিশ ৯৩ জনকে আটক করে। পুলিশ জানিয়েছে, সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে পুলিশের অবস্থান সরিয়ে নেওয়া হয়েছে গোলাপবাগে। এদিকে অবকাঠামোর কোনো ক্ষয়-ক্ষতি হলে সেই ক্ষতিপূরণের শর্তে গোলাপবাগ মাঠে বিএনপিকে সমাবেশের অনুমতি দিয়েছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি)। সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে গত রাতে এ তথ্য জানানো হয়। ডিএসসিসি’র বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, গতরাত সাড়ে ১০টায় বিএনপির ভারপ্রাপ্ত দপ্তর সম্পাদক সৈয়দ ইমরান সালেহ প্রিন্স গোলাপবাগ খেলার মাঠ ব্যবহারের অনুমতি চেয়ে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা বরাবর আবেদন করেন। আবেদনের প্রেক্ষিতে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ভারপ্রাপ্ত প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ও সচিব আকরামুজ্জামান শর্তসাপেক্ষে  এই অনুমতি দেন। বিএনপির দুই শীর্ষ নেতাকে গ্রেফতারের পর ডিবিপ্রধান মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ বলেন, জিজ্ঞাসাবাদের জন্য মির্জা ফখরুল ও মির্জা আব্বাসকে ডিবি কার্যালয়ে নিয়ে আসা হয়। তাদের ডিবি কার্যালয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। ৮ ডিসেম্বর পল্টন থানায় দায়ের করা ১০ নম্বর মামলায় (৪৭০ আসামি) তাদের গ্রেফতার দেখানো হয়েছে। তাদের আদালতে সোপর্দ করা হবে। পুলিশের ওপর বর্বরোচিত হামলা, ককটেল বিস্ফোরণ, জনমালের ক্ষতির পরিকল্পনা, উসকানি, ইন্ধনদাতা হিসেবে তাদের গ্রেফতার দেখানো হয়েছে। আর কোনো কেন্দ্রীয় নেতা নজরদারিতে রয়েছেন কি না- জানতে চাইলে হারুন অর রশীদ বলেন, ‘আমরা খেয়াল রাখছি। এ রকম অপরাধে যাদেরই সংশ্লিষ্টতা পাওয়া যাবে, তারা নজরদারিতে থাকবেন। তাদের বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ নেওয়া হবে।’ বিকাল ৪টা ১০ মিনিটের দিকে মির্জা ফখরুল ও মির্জা আব্বাসকে ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট (সিএমএম) আদালতে হাজির করা হয়। এ সময় মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ অন্যদের মুক্তি দাবিতে আদালতের সামনে স্লোগান দেন বিএনপিপন্থি আইনজীবীরা। তবে এর আগেই আদালত চত্বর এলাকায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিপুল সদস্য অবস্থান নেন। ঢাকার আদালতসংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছেন, পল্টন থানার মামলায় মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ও মির্জা আব্বাসকে কারাগারে আটক রাখার আবেদন করে পুলিশ। পরে আদালত তাদের কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন। নয়টি বিভাগীয় সমাবেশ শেষে আজ ঢাকায় বিএনপির গণসমাবেশ করার কথা রয়েছে। বিএনপি নয়াপল্টনে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে এ সমাবেশ করতে চেয়েছিল। তাদের সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সমাবেশ করার অনুমতি দেয় পুলিশ। তবে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে নয়, নয়াপল্টনেই সমাবেশ করার বিষয়ে অনড় অবস্থানের কথা জানান বিএনপি নেতারা। অনেক আলোচনার পর গোলাপবাগে সমাবেশের অনুমতি পেল বিএনপি।

যা বললেন ডিএমপি কমিশনার : গতকাল বেলা ২টার দিকে ডিএমপি কমিশনার খন্দকার গোলাম ফারুক গোলাপবাগ মাঠ পরিদর্শন করেন। পরিদর্শন শেষে তিনি সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন। ডিএমপি কমিশনার বলেন, ‘ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ ও গোয়েন্দা সংস্থার তথ্যের ভিত্তিতে আমরা এখানে এসেছি। সার্বিক বিষয়গুলো দেখলাম, শুনলাম। এখন এসব বিষয় ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হবে। পরে তারা যেভাবে সিদ্ধান্ত দেবেন, সেভাবেই ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’ সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘মূলত বিএনপির পক্ষ থেকে বৃহস্পতিবার (৮ ডিসেম্বর) রাতের বৈঠকে এ মাঠের প্রস্তাব ছিল। এ কারণেই এখানে আসা। আমরা দেখলাম মাঠে জনসমাবেশ করার মতো অবস্থা আছে কি না। আমরা মাঠ দেখলাম। বিষয়টি নিয়ে আমাদের অফিসার এবং গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলব। তারা যদি মনে করেন মাঠটি সমাবেশ করার জন্য দেওয়া যেতে পারে, তাহলে আমরা তা দিয়ে দেব। কারণ তাদের নিরাপত্তাসহ সার্বিক সহযোগিতা করা আমাদের দায়িত্ব।’

ভেন্যু নিয়ে সৃষ্ট জটিলতার অবসান : গতকাল বেলা পৌনে ২টার দিকে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. এজেডএম জাহিদ হোসেনের নেতৃত্বে তিন সদস্যের একটি দল ডিবিপ্রধান হারুন অর রশীদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। এ সময় তাঁরা ডিবিপ্রধানের কাছে গোলাপবাগ মাঠে সমাবেশের অনুমতি চেয়ে আবেদন করলে ডিএমপি তাতে সায় দেয়। অবসান হয় সমাবেশের ভেন্যু নিয়ে সৃষ্ট জটিলতার।

গত রাতে সরেজমিন গোলাপবাগ মাঠে গিয়ে দেখা যায়, একে একে মাঠের দিকে আসছেন বিএনপি ও এর অঙ্গসংগঠনের কর্মীরা। রাত ১০টার দিকেই মাঠে কর্মীদের উপস্থিতি ছিল চোখে পড়ার মতো। তবে মাঠের চারদিকের বিভিন্ন মোড়ে পুলিশ সদস্য পোশাকে ও সাদা পোশাকে অবস্থান নিয়েছেন।

শেষ মুহূর্তে বিএনপির প্রস্তুতি : গতকাল বিকালে সমাবেশস্থলের অনুমতি পাওয়ার পরপরই দলের শীর্ষস্থানীয় নেতারা গোলাপবাগ মাঠ পরিদর্শন করেন। সন্ধ্যা থেকেই তাঁরা মঞ্চ তৈরি, মাইক লাগানোসহ সংশ্লিষ্ট অন্যান্য কার্যক্রম শুরু করেন। এর আগে বিকালেই নেতা-কর্মীরা মাঠে যাওয়া শুরু করেন। সন্ধ্যা থেকেই নির্ধারিত সভাস্থল পরিপূর্ণ হয়ে ওঠে। রাতভর নেতা-কর্মীরা সেখানে উৎসবমুখর পরিবেশে অবস্থান করেন। অনুষ্ঠানসূচি অনুযায়ী আজ বেলা ১১টায় পবিত্র কোরআন থেকে তিলাওয়াতের মাধ্যমে শুরু হবে সমাবেশের কার্যক্রম। প্রধান অতিথি হিসেবে অংশ নেবেন বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন। ঢাকা মহানগরী উত্তর বিএনপি সভাপতি আমান উল্লাহ আমানের সভাপতিত্বে এবং সদস্যসচিব আমিনুল হক ও মহানগরী দক্ষিণের সদস্যসচিব রফিকুল আলম মজনুর পরিচালনায় সমাবেশে দলের জাতীয় স্থায়ী কমিটি, কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটিসহ অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনের শীর্ষ নেতারা বক্তব্য দেবেন।

কড়া নজরদারিতে নয়াপল্টন : রাজধানীর নয়াপল্টন এলাকা কঠোর নজরদারির মধ্যে রেখেছে পুলিশ। তল্লাশির পাশাপাশি বাড়ানো হয় টহল কার্যক্রমও। গতকাল দিনভর পরিচয় নিশ্চিত না হয়ে ওই সড়ক দিয়ে কাউকে চলাচল করতে দেওয়া হয়নি। বিএনপির কোনো নেতা-কর্মীকেও তাদের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে প্রবেশ করতে দেওয়া হয়নি। পুরো এলাকা নিয়ন্ত্রণে রাখে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। নয়াপল্টনের সামনে থেকে বিএনপির অন্তত পাঁচজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে বলে জানা গেছে। এ ছাড়া রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা থেকে বিএনপি-জামায়াতের ৯৩ সদস্যকে গ্রেফতার করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন ডিএমপির উপকমিশনার মো. ফারুক হোসেন। গতকাল জুমার দিনেও নয়াপল্টন জামে মসজিদে জুমার নামাজ পড়তে যাওয়া মসল্লিদের ভোগান্তিতে পড়তে হয়েছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। যদিও ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) কর্মকর্তারা এ অভিযোগ নাকচ করে দিয়েছেন। জুমার নামাজের পর থেকে নাইটিঙ্গেল মোড়ে দায়িত্বরত পুলিশ সদস্যদের তৎপরতা বৃদ্ধি পেতে দেখা গেছে। এ ছাড়া পুরানা পল্টন মোড় থেকে নাইটিঙ্গেল মোড় পর্যন্ত পুলিশের একটি সাঁজোয়া যান টহল দিতে দেখা গেছে। ডিএমপির মতিঝিল বিভাগের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার (এডিসি) আবুল হাসান বলেন, নিরাপত্তার স্বার্থে সাঁজোয়া যান পুরানা পল্টন মোড় থেকে নাইটিঙ্গেল মোড় পর্যন্ত টহল অব্যাহত রেখেছে। এর আগে দুপুর সাড়ে ১২টায় বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে থেকে মাহবুবুল আলম রবিন ও রহমতুল্লাহ নামে দুজনকে আটক করে পুলিশ। আটকের সময় রবিন নিজেকে ময়মনসিংহের নান্দাইল উপজেলা ছাত্রদলের যুগ্ম আহ্বায়ক বলে পরিচয় দিয়েছেন। বিএনপি কার্যালয়ের সামনে ছবি ও ভিডিও নেওয়ার সময় রহমতুল্লাহ নামে আরেক বিএনপি কর্মীকে আটক করা হয়। আটকের সময় নিজেকে বিএনপি সমর্থক পরিচয় দিলেও পেশায় তিনি একজন গার্মেন্ট কর্মী। এরপর দুপুর ১টায় নাইটিঙ্গেল মোড় থেকে স্লোগান দিয়ে নয়াপল্টন যাওয়ার পথে তিনজনকে আটক করে পুলিশ। আটকদের মধ্যে রূপগঞ্জ উপজেলা যুবদলের সাংগঠনিক সম্পাদক সরফরাজ রয়েছেন। বাকি দুজন হলেন আল-আমিন ও নাজমুল। আল-আমিন সাংবাদিকদের জানান, তিনি পেশায় একজন প্রাইভেটকার চালক। রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় পুলিশ তাকে আটক করেছে। নাজমুলের দাবি, তার বাড়ি ময়মনসিংহে। তিনি ঢাকায় ভাইয়ের বাড়ি বেড়াতে এসেছেন। নাইটিঙ্গেল মোড় দিয়ে যাওয়ার সময় পুলিশকে দেখে দৌড় দেন। এ কারণে পুলিশ তাকে আটক করে। তবে এডিসি আবুল হাসান বলেছেন, আটকরা সবাই বিএনপির নেতা-কর্মী। তারা নাইটিঙ্গেল মোড় হয়ে পল্টনে বিএনপি কার্যালয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। তারা ঘটনাস্থলে অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটাতে এসেছিলেন। এজন্য তাদের আটক করা হয়েছে। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, বিএনপি কার্যালয়ের পাশে নয়াপল্টন জামে মসজিদ থেকে জুমার নামাজ শেষে পুলিশের সঙ্গে বাগ্বিতন্ডায় জড়ান মুসল্লিরা। এ সময় প্রায় ৪০-৫০ জন ‘নারায়ে তাকবির,’ ‘আল্লাহু আকবর’সহ বিভিন্ন স্লোগান দিলে পুলিশ তাদের ধাওয়া দিয়ে ছত্রভঙ্গ করে দেয়। এ বিষয়ে ডিএমপির যুগ্ম কমিশনার (অপারেশন) বিপ্লব কুমার সরকার সাংবাদিকদের জানান, মুসল্লিদের ধাওয়া দেওয়া হয়েছে বলে যারা অভিযোগ করেছেন এটা সম্পূর্ণ মিথ্যা। যারা ধর্মপ্রাণ মুসলমান পবিত্র জুমার দিনে নামাজ আদায় করতে এসেছেন পুলিশ তাদের কোনোভাবেই বাধা দেয়নি। বরং তাদের পুলিশ সহযোগিতা করেছে। আর ‘নারায়ে তাকবির,’ ‘আল্লাহু আকবর’ স্লোগান জামায়াতে ইসলামীর কর্মীরা দিয়ে থাকেন। কাজেই এখানে বিএনপির সঙ্গে জামায়াতের সমর্থকরা একত্র হয়ে ভিতরে প্রবেশের চেষ্টা করেছেন। জামায়াতের কর্মীরা এখানে প্রবেশ করে পুলিশের সঙ্গে ঝামেলা করার চেষ্টা করেছিলেন। তাদের প্রতিহত করা হয়েছে।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর