যোগাযোগ খাতের নতুন এক অধ্যায়ে প্রবেশ করছে বাংলাদেশ। বহুল কাক্সিক্ষত স্বপ্নের মেট্রোরেল কাল ২৮ ডিসেম্বর উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এর মাধ্যমে মেট্রোরেল যুগের সূচনা হতে যাচ্ছে বাংলাদেশে। কাল উদ্বোধন করা হলেও পরদিন ২৯ ডিসেম্বর বৃহস্পতিবার থেকে যাত্রী চলাচল শুরু হবে। এ লক্ষ্যে এরই মধ্যে প্রায় সব ধরনের প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছে ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেড (ডিএমটিসিএল)। সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের আজ এ উপলক্ষে সংবাদ সম্মেলন ডেকেছেন মেট্রোরেলের আগারগাঁও স্টেশনে।
দিয়াবাড়ী থেকে আগারগাঁও পুরো প্রকল্প এলাকাতেই বিরাজ করছে সাজসাজ রব। নানা ধরনের ফুল দিয়ে সাজানো হয়েছে সড়ক বিভাজক ও স্টেশনগুলোর নিচের অংশ। ধোয়ামোছার কাজও সম্পন্ন হয়েছে। ডিএমটিসিএল কর্তৃপক্ষ জানায়, শুরুতে মাঝের কোনো স্টেশনে থামবে না মেট্রোরেল। সরাসরি দিয়াবাড়ী থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত চলবে রেলকোচ। আপাতত প্রতিদিন ৪ ঘণ্টা হিসাবে সকাল ৮টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত চলবে। এরপর ধীরে ধীরে ট্রেন চলার সময়সীমা বাড়ানো হবে। তবে পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে সিদ্ধান্ত নেবে ডিএমটিসিএল।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, পৃথিবীর যেসব দেশে মেট্রোরেল রয়েছে সেগুলোর প্রায় সবই মাটির নিচে। খুব কম সংখ্যক দেশে এলিভেটেড বা উড়ালপথে চলে মেট্রোরেল। বাংলাদেশেও অবশ্য এমন পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। লাইন-১ এর অর্ধেকের বেশি মাটির নিচ দিয়ে, যার কাজও শুরু হওয়ার কথা রয়েছে শিগগিরই। প্রথম দিকে সপ্তাহে এক দিন মঙ্গলবার বন্ধ থাকবে মেট্রোরেল।
এ প্রসঙ্গে ডিএমটিসিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বলেন, যোগাযোগ খাতে নতুন এক সংযোগ হবে মেট্রোরেল। এটাই দেশের প্রথম মেট্রোরেল। ফলে মানুষের প্রত্যাশাও অনেক বেশি। আমরা আশা করছি জনগণের প্রত্যাশা পূরণে সক্ষম হবে মেট্রোরেল।
জানা গেছে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বুধবার উত্তরায় মেট্রোরেল উদ্বোধনী ফলক উন্মোচন করবেন এবং ভাষণ দেবেন। এরপর মেট্রোরেলে চড়ে তিনি উত্তরা থেকে আগারগাঁও আসবেন। এ জন্য এসব এলাকায় আগাম নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তার ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী নিজে ভ্রমণ করবেন বিধায় সেদিন আর কোনো যাত্রী চলাচল করবে না। পরদিন থেকেই শুরু হবে যাত্রী চলাচল। এ ছাড়া নিরাপত্তার স্বার্থে প্রকল্প এলাকায় যারা বসবাস করেন তাদের জন্য সাত দফা নির্দেশনা দিয়েছে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি)।
এদিকে মেট্রোরেলের নিরাপত্তা দেবে ম্যাস র্যাপিড ট্রানজিট বা এমআরটি পুলিশ। এই নামে পুলিশের বিশেষ একটি ইউনিট গঠনের কথা রয়েছে। তবে এখনো ইউনিটটি গঠিত হয়নি। বিষয়টি নিয়ে গতকাল পুলিশ বিভাগের সঙ্গে ডিএমটিসিএলের একটি বৈঠকও অনুষ্ঠিত হয়েছে। বৈঠকের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী খুব শিগগিরই এমআরটি পুলিশ গঠন করা হবে।
জানা গেছে, যাত্রীদের অভ্যস্ত করাতে শুরুর দিকে মেট্রোরেল স্টেশনগুলোতে যাত্রীদের ওঠানামার জন্য ১০ মিনিট করে থামবে। ১৫ দিন পর পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। তবে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে স্টেশনে ট্রেনগুলো ২ থেকে ৩ মিনিটের মতো সময় দেয় যাত্রীদের ওঠানামার জন্য। জনগণ অভ্যস্ত হয়ে গেলে বাংলাদেশে সেই একই রকম প্র্যাকটিস চালু হবে। প্রথম কিছু দিন চালানোর জন্য ১২ সেট ট্রেন প্রস্তুত রাখা হয়েছে দিয়াবাড়ীর ডিপোতে।
ডিএমটিসিএল কর্তৃপক্ষ জানায়, প্রথম দিকে স্থায়ী ও একক যাত্রার (সিঙ্গেল জার্নি) টিকিট বা কার্ড মেট্রোরেল স্টেশন থেকেই কিনতে হবে, যা বাইরে পাওয়া যাবে না। ১০ বছর মেয়াদি স্থায়ী কার্ড কিনতে হবে ২০০ টাকা দিয়ে। এই কার্ডে যাতায়াতের জন্য টাকা ভরানো (রিচার্জ) যাবে। অন্যদিকে এক যাত্রার কার্ড নির্ধারিত ভাড়া পরিশোধ করে নিতে হবে। ট্রেন থেকে নামার সময় তা রেখে দেওয়া হবে। পরবর্তীতে পর্যায়ক্রমে স্টেশনের বাইরেও মেট্রোরেলের কার্ড বিক্রির জন্য কিছু প্রতিষ্ঠানকে নিয়োগ দেওয়া হবে। এটি বিশ্বের সবচেয়ে অত্যাধুনিক মেট্রোরেলগুলোর একটি। সর্বাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমেই এ প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়েছে। সর্বোচ্চ ১০০ কিলোমিটার গতিতে চলতে সক্ষম এই মেট্রোরেল। তবে দিয়াবাড়ী থেকে মতিঝিল পর্যন্ত যেতে সময় লাগবে ৩৮ মিনিট। এ ছাড়া মেট্রোরেল লাইন-১ এর মূল কাজও শুরু হবে এ মাসেই। মেট্রোরেল চালু হলে মানুষের জীবনমানে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আসবে। সময় বাঁচবে, অর্থের সাশ্রয় হবে। উত্তরা থেকে মতিঝিল পর্যন্ত মেট্রোরেল স্থাপনে চলমান এ প্রকল্পটির ব্যয় দাঁড়িয়েছিল ২১ হাজার ৯৮৫ কোটি টাকা। এরপর কমলাপুর পর্যন্ত মেট্রোরেল এগিয়ে নেওয়ায় মোট ব্যয় বেড়ে হয় প্রায় ৩৩ হাজার ৪৭২ কোটি টাকায়। এ প্রকল্পের দ্বিতীয় ধাপে আগারগাঁও থেকে মতিঝিল পর্যন্ত অংশ ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে এবং তার পর কমলাপুর পর্যন্ত অংশ চালু করা হবে। মেট্রোরেলের ভাড়া নির্ধারণ করা হয়েছে প্রতি কিলোমিটারে ৫ টাকা। সর্বনিম্ন ভাড়া ২০ টাকা। সেই হিসাবে উত্তরা নর্থ স্টেশন থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত ভাড়া হবে ৬০ টাকা। অন্যদিকে, উত্তরা নর্থ স্টেশন হতে কমলাপুর স্টেশন পর্যন্ত হবে ২০ কিলোমিটারে দূরত্বের জন্য সর্বোচ্চ ভাড়া যাত্রীপ্রতি ১০০ টাকা।