বুধবার, ১ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩ ০০:০০ টা

মাতৃভাষার মর্যাদাহানি খুবই দুঃখজনক

সেলিনা হোসেন

মাতৃভাষার মর্যাদাহানি খুবই দুঃখজনক

ভাষার জন্য আমরা প্রাণ দিয়েছি। ১৯৫২ সালের আগ পর্যন্ত মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষায় কোনো অঞ্চলে এমন আন্দোলন হয়নি, কোনো জাতিগোষ্ঠী এভাবে প্রাণ দেয়নি। মাতৃভাষার জন্য জীবন দিয়েছিলেন রফিক, সালাম, বরকত, জব্বারসহ অনেকে। কিন্তু রক্তের বিনিময়ে পাওয়া ভাষার মর্যাদা যতটুকু দেওয়ার কথা, ততটুকু আমরা দিতে পারিনি। নানাভাবে মাতৃভাষার মর্যাদাহানি করে চলেছি। এটা খুবই দুঃখজনক।

১৯৪৭ সাল পর্যন্ত বাংলা সাহিত্য ও বাংলা ভাষার একটা মূল স্রোত ছিল। তখন আমাদের যে সাহিত্যের ধারাটি গড়ে ওঠে সেটা আজ পর্যন্ত প্রসারিত। ভাষার মর্যাদার দাবিতে সচেষ্ট থাকার বিষয়টা সব সময়ই ছিল কিন্তু সবখানে সফল হয়েছি সেটা বলা যাবে না। আমরা অনেক ভুল করেছি। তরুণদের মাঝে ভাষা নিয়ে এটা-ওটা করার ইচ্ছা জেগেছে। তারা সেটা করেছে। বাণিজ্যের কারণে যেমন রেডিওতে বাংলার মধ্যে ইংরেজি বা অন্য শব্দ মিশিয়ে বাংলাকে একটি মিশ্রিত ভাষা করেছে। এটা দুঃখজনক ও অমর্যাদাকর। বঙ্গবন্ধু চেয়েছিলেন বাংলা ভাষায় সব পাঠ্যপুস্তক রচিত হবে, সেটার জন্য বাংলা একাডেমিকে দায়িত্বও দিয়েছিলেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর সেটা আর হয়নি। বাংলাকে সর্বস্তরে তো নয়ই, মূল যে জায়গাটা- শিক্ষাব্যবস্থা, সেখানেই প্রতিষ্ঠিত করতে পারিনি। আমাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে তিন পদ্ধতির শিক্ষাব্যবস্থা আছে। কোনোটা ইংলিশ মিডিয়াম, কোনোটা বাংলা মাধ্যম, কোনোটা মাদরাসা। শিক্ষাব্যবস্থার এই দুই-তিন ধারা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয় একটি রাষ্ট্রের জন্য। এতে সমমানে শিক্ষিত করা যাচ্ছে না পরবর্তী প্রজন্মকে। সবগুলোকে একটি ধারার মধ্যে এনে একটা পর্যায়ের পর যে যেদিকে যেতে চায় যাবে। যে ধর্মীয় বিষয় পড়তে চায় সে এক বিভাগে ভর্তি হবে; যে অন্য বিষয় পড়তে চায়, সে অন্য বিভাগে। আজকের দিনে বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় ছেলেমেয়েরা পড়তে যাচ্ছে। তাতে অসুবিধা নেই। ইংরেজি শিখতে হবে। কিন্তু কোনোভাবেই মাতৃভাষাকে উপেক্ষা করে নয়। কেউ ১০টি ভাষা জানলে সেটা তার জ্ঞানের জায়গা। তার মানে নিজের মাতৃভাষা জানবে না, এটা তো হতে পারে না। আগে মাতৃভাষায় দক্ষতা অর্জন করতে হবে, পরে অন্য ভাষায়, অন্য জায়গায়, অন্য বিষয় নির্বাচন করে পড়ার সুযোগ করে দেওয়া উচিত। এসব কারণে আমরা বাংলা ভাষার মর্যাদা সঠিকভাবে রাখতে পারিনি।

ভাষার মর্যাদা রাখার দায়িত্ব সবার। মাতৃভাষার অমর্যাদা করে নিজের জাতিসত্তার অস্তিত্বকে প্রশ্নবিদ্ধ করা কারওই উচিত নয়। সাইন বোর্ডগুলোর অনেকাংশে বাংলা তুলে দিয়ে ইংরেজিতে লেখা হয়। নিজের মাতৃভাষাকে অবহেলা করে অন্য ভাষাকে প্রাধান্য দেওয়া সমর্থনযোগ্য নয়। এর একটা সমাধান দরকার। পর্যটকদের সুবিধার্থে বাংলার নিচে ছোট করে ইংরেজিতে দেওয়া যেতে পারে। অবশ্য বাংলা ভাষার মর্যাদা আমরা একেবারে রাখতে পারিনি সেটা বলা যাবে না। যে একুশে ফেব্রুয়ারি শহীদ দিবস বলে আমরা দীর্ঘ বছর ধরে পালন করে আসছিলাম, সেটা আজ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালিত হচ্ছে। ইউনেস্কো একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ঘোষণা দিয়েছে। আজ দিবসটি বিশ্বের বিভিন্ন দেশে পালিত হচ্ছে। এভাবে ভাষার মর্যাদা আন্তর্জাতিক অঙ্গনে পৌঁছেছে। আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি গানটিও এত বছর ধরে আমাদের কণ্ঠে ধ্বনিত হয়। ১৯৭৪ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর বঙ্গবন্ধু জাতিসংঘে বাংলা ভাষায় ভাষণ দিয়েছিলেন। ২০১৯ সালে এ দিবসটিকে নিউইয়র্কের গভর্নর বাংলাদেশি ইমিগ্রেন্ট ডে ঘোষণা দিয়েছেন। এটাও একটা মর্যাদার জায়গা। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের দেওয়া বাংলায় ভাষণ ইউনেস্কো কর্তৃক ঐতিহ্যিক প্রামাণিক দলিল হিসেবে গৃহীত হয়েছে। এখন আমরা যদি বাংলাকে সাহিত্য ও শিল্পে নানামুখী চর্চার মাধ্যমে বিদেশের দরবারে পৌঁছে দিতে পারি, বাংলা ভাষা থেকে অনুবাদ হয়ে যদি কিছু প্রকাশিত হয়, সেটাও হবে ভাষার মর্যাদাদানের উল্লেখযোগ্য জায়গা। অফিস-আদালতে এখনো বাংলার চর্চা সেভাবে হয় না। একবার শুরু হয়েছিল, আবার বন্ধ হয়ে গেছে। নতুন প্রজন্মকে এগিয়ে আসতে হবে নিজের ভাষার মর্যাদা রক্ষায়। তারা সঠিকভাবে বাংলা বলবে, বাংলা লিখবে। সঠিকভাবে বাংলা বলতে ও লিখতে পারাটাও অনেক বড় যোগ্যতা।

লেখক : কথাসাহিত্যিক ও ঔপন্যাসিক, অনুলেখক : শামীম আহমেদ

সর্বশেষ খবর