শনিবার, ৪ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩ ০০:০০ টা
আজ বিশ্ব ক্যান্সার দিবস

নষ্ট মেশিনে ধুঁকছে ক্যান্সার চিকিৎসা

♦ হাসপাতালের ছয়টি মেশিনের পাঁচটিই নষ্ট ♦ নেই রোগীর সঠিক পরিসংখ্যান ♦ দুই মাসেও মিলছে না রেডিওথেরাপির সিরিয়াল

জয়শ্রী ভাদুড়ী

নষ্ট মেশিনে ধুঁকছে ক্যান্সার চিকিৎসা

জরায়ুমুখ ক্যান্সারে আক্রান্ত জামালপুরের শাহিদা বেগম (৪৫)। রেডিওথেরাপির জন্য তিন মাস ধরে জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে সিরিয়ালের অপেক্ষায় ছিলেন তিনি। তার ছেলে সাইফুল ইসলাম বলেন, মায়ের ক্যান্সার শনাক্ত হলে চিকিৎসার এক পর্যায়ে রেডিওথেরাপি নিতে বলেন চিকিৎসক। কিন্তু এই হাসপাতালে দীর্ঘ সিরিয়াল। নির্ধারিত সময় পার হয়ে তিন মাস চলে গেলেও সিরিয়াল পাইনি। কোনো উপায় না পেয়ে মাকে বাঁচাতে বিভিন্ন জায়গা থেকে টাকা জোগাড় করে বেসরকারিতে রেডিওথেরাপি দিয়েছি।

দেশে ক্যান্সার আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। কিন্তু হাসপাতালের চিকিৎসা অপ্রতুলতায় ধুঁকছেন রোগী। মহাখালীর এই হাসপাতালটিতে ক্যান্সার চিকিৎসায় ব্যবহৃত অন্যতম জরুরি রেডিওথেরাপি মেশিন রয়েছে ছয়টি। কিন্তু প্রায় দুই বছর ধরে এর পাঁচটিই নষ্ট। অন্য হাসপাতালগুলোর এরকমই পরিস্থিতি। অধিকাংশ হাসপাতালে একটি মেশিনে চলছে সেবা। রেডিওথেরাপির সিরিয়ালের অপেক্ষার প্রহর গুনতে গুনতে মারা যাচ্ছেন রোগী। দেশের ক্যান্সার আক্রান্ত রোগীর নেই সঠিক পরিসংখ্যান।

এ পরিস্থিতির মধ্যে আজ পালিত হচ্ছে বিশ্ব ক্যান্সার দিবস। দিবসটি উপলক্ষে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়, কমিউনিটি অনকোলজি সেন্টার ট্রাস্ট, ওয়ার্ল্ড ক্যান্সার সোসাইটি বাংলাদেশ, আহছানিয়া মিশন ক্যান্সার ও জেনারেল হাসপাতাল, বাংলাদেশ ক্যান্সার সোসাইটি ও এইচসিজি ক্যান্সার সেন্টারসহ বেসরকারি হাসপাতাল ও বিভিন্ন সংগঠনের উদ্যোগে গোলটেবিল বৈঠক, র‌্যালি, আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়েছে।

জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে ৩০০ বেডের জনবল নিয়ে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলছে ৫০০ বেডের চিকিৎসা কার্যক্রম। ফলে দিনের পর দিন হাসপাতালটিতে চিকিৎসা নিতে আসা রোগীদের পোহাতে হচ্ছে চরম দুর্ভোগ। সেবা দিতে হিমশিম পরিস্থিতিতে পড়ছেন হাসপাতালের চিকিৎসক, নার্সসহ অন্য স্বাস্থ্যকর্মীরা। গত বৃহস্পতিবার সরেজমিন হাসপাতালে ঘুরে দেখা যায়, ভোর থেকেই রেডিওথেরাপি রুমের সামনে দীর্ঘ লাইন ধরে দাঁড়িয়ে রয়েছেন রোগী ও তাদের স্বজনরা। সিরিয়াল না পেলেও কোনোভাবে যদি সুযোগ পাওয়া যায় সেই অপেক্ষায় সকাল ৭টা থেকে লাইনে দাঁড়িয়ে আছেন স্তন ক্যান্সারে আক্রান্ত কহিনূর বেগমের ছেলে গিয়াস আলম। তিনি বলেন, মাকে নিয়মিত রেডিওথেরাপি দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন চিকিৎসক। কিন্তু বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে এই থেরাপির পুরো কোর্সে খরচ হয় দেড় লাখ টাকার মতো। এমনিতেই মায়ের ক্যান্সারের চিকিৎসা করাতে গিয়ে পুরো পরিবার নিঃস্ব প্রায়। এমন অবস্থায় বেসরকারি হাসপাতালে রেডিওথেরাপি দেওয়া অসম্ভব। সরকারিভাবে খরচ হয় ১০ থেকে ১২ হাজার টাকা। কিন্তু সিরিয়াল পাওয়াই মুশকিল। গত তিন দিন ঘুরে গিয়েছি। আজ আবার লাইনে দাঁড়িয়েছি। সিরিয়াল পাই কি না দেখি।

সিরিয়াল পেতে এমন দেরি কেন জানতে চাইলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিভাগের দায়িত্বরত এক কর্মী জানান, ছয়টি মেশিনের মধ্যে পাঁচটিই নষ্ট হয়ে পড়ে রয়েছে দীর্ঘদিন। একটি মেশিন দিয়ে কজনকে থেরাপি দেওয়া যায় বলেন? আমরা তো বসে নাই। রোগীদের সেবা দিচ্ছি। কিন্তু একটি মেশিনের বিপরীতে এত রোগী যে একেকজনের সিরিয়াল পেতে দীর্ঘ সময় লেগে যায়।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লিনিক্যাল অনকোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. মো. নাজির উদ্দিন মোল্লাহ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘দেশে ক্যান্সার আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। প্রতি বছর দেশে প্রায় ২ লাখ মানুষ ক্যান্সারে আক্রান্ত হচ্ছে। রোগী শনাক্তে স্ক্রিনিং প্রোগ্রামও খুব কম। কিন্তু রোগীদের পর্যাপ্ত চিকিৎসাব্যবস্থা নেই। জরায়ুমুখ ক্যান্সার, ব্রেস্ট ক্যান্সারসহ অন্য অঙ্গের ক্যান্সারে আক্রান্ত রোগীদের রেডিওথেরাপি দিতে হয়।’ তিনি আরও বলেন, ‘দেশে ১৬০টি রেডিওথেরাপি মেশিন প্রয়োজন, অথচ আছে মাত্র ২০টি। সরকারি অধিকাংশ হাসপাতালের মেশিন নষ্ট। বিএসএমএমইউতে একটা সচল আছে আর প্রাইভেটে কিছু চালু আছে। রোগীর চাপ সামলাতে আমরা হিমশিম পরিস্থিতিতে আছি। থেরাপির তারিখের জন্য অপেক্ষা করতে করতে রোগী মারা যায়। ক্যান্সার আক্রান্ত রোগীর চিকিৎসায় পর্যাপ্ত মেশিন এবং দক্ষ জনবল প্রয়োজন। সকালের শিফটের পাশাপাশি বিকালের শিফটে রেডিওথেরাপির ব্যবস্থা করতে হবে।’  

দেশে মরণব্যাধি ক্যান্সারের সঠিক পরিসংখ্যান নেই। আন্তর্জাতিক সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল এজেন্সি ফর রিসার্চ অন ক্যান্সারের (আইএআরসি) অনুমিত হিসাব অনুযায়ী, প্রতি বছর বাংলাদেশে ১ লাখ ২২ হাজার মানুষ নতুন করে ক্যান্সারে আক্রান্ত হন। আক্রান্ত রোগীদের মধ্যে প্রতি বছর মারা যান ৯১ হাজার। কিন্তু দেশে আক্রান্ত ও মৃত রোগীর তথ্য সংগ্রহে কেন্দ্রীয় কোনো উদ্যোগ না থাকায় অনুমাননির্ভর তথ্য দিয়ে চলছে চিকিৎসা পরিকল্পনা।

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের অবস অ্যান্ড গাইনি বিভাগ ও গাইনি অনকোলজি ইউনিটের প্রধান অধ্যাপক ডা. নাজমা হক বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘দেশে ক্যান্সার রোগীর সঠিক পরিসংখ্যান নেই। রোগীর সংখ্যা নির্ধারণে হাসপাতালভিত্তিক কিংবা জনসংখ্যাভিত্তিক নিবন্ধন করা যেতে পারে। জাতীয় পরিচয়পত্র কিংবা জন্মসনদের তথ্য দিয়ে হাসপাতালে আসা রোগী নিবন্ধন করা যেতে পারে। এ জন্য একটা সফটওয়্যার চালু করতে হবে। নির্দিষ্ট একদিনে সব হাসপাতালে ক্যান্সার রোগী রেজিস্ট্রি চালু করতে হবে।’

সর্বশেষ খবর