শিরোনাম
শনিবার, ৪ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩ ০০:০০ টা

মাতৃভাষার অন্তর্নিহিত শক্তি দিয়েই এগোতে হবে

ড. অনুপম সেন

মাতৃভাষার অন্তর্নিহিত শক্তি দিয়েই এগোতে হবে

মাতৃভাষা বাংলার মর্যাদা রক্ষার ক্ষেত্রে সরকারের দায়বদ্ধতার চেয়ে নাগরিক সমাজের কাছে প্রত্যাশাটা অনেক বেশি। সরকারি লেনদেন তো বাংলাতেই হচ্ছে। কিন্তু আমাদের বিত্তশালীদের মনমানসিকতার পরিবর্তনটা জরুরি। নব্য ধনীরা মনে করেন, ইংরেজি শিখতে পারলে বিরাট কিছু হয়ে গেলাম। আসলে বিষয়টি তা নয়। ইংরেজি শিখলেই বিরাট কিছু হয়ে যায় না। সমাজে জ্ঞানের সঞ্চালন করতে পারলেই জীবনের সফলতা। আর জ্ঞানের সঞ্চালনের জন্য মাতৃভাষাই প্রধান বাহন।

প্রশাসক হওয়াটা বড় কথা নয়। জ্ঞানী হওয়াটা বড়। বর্তমান বিশ্ব জ্ঞানের বিশ্ব। আর জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চা করতে হবে মাতৃভাষার মাধ্যমেই। অন্ন বস্ত্র বাসস্থানের মতো মাতৃভাষা ব্যবহারের অধিকার একটি মৌলিক অধিকার। প্রতিটি নৃগোষ্ঠীরও নিজস্ব ভাষা ব্যবহারের অধিকার আছে। প্রতিটি জাতিসত্তার মানুষের ভাষার মর্যাদা সমুন্নত রাখতেই বাংলা ভাষার জন্য প্রাণ বলিদানের দিনটিকে অর্থাৎ ২১ ফেব্রুয়ারিকে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। পৃথিবীতে বাঙালিই সর্বপ্রথম ভাষার জন্য এভাবে প্রাণ দিয়েছে। বাংলা ভাষার স্বীকৃতি আদায়ের সংগ্রামে সাংবাদিকদের বিশাল অবদান রয়েছে। সংবাদপত্র বা গণমাধ্যমের অবদান ভুলবার মতো নয়। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ভিত তৈরি হয়েছিল ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়েই। গণমাধ্যম সে ক্ষেত্রেও বিশেষ ভূমিকা রেখেছে। আমাদের মুক্তিসংগ্রামের নেতৃত্বদানকারী মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ভাষাসংগ্রামের সময় দফায় দফায় কারাবন্দি হন।

১৯৪৭-এ দেশ বিভক্তির পর তৎকালীন পূর্ব বাংলার প্রতি বৈষম্যের চিত্র অনুধাবন করেছিলেন বঙ্গবন্ধু। তিনি উপলব্ধি করেছিলেন, দেশ ভাগ হয়েছে ঠিকই কিন্তু বৈষম্য রয়ে গেল। তৎকালীন পূর্ববঙ্গের সব কিছুই করা হলো করাচিতে। সেনা, নৌঘাঁটি, পুলিশ হেডকোয়ার্টার্স, এমনকি গণপরিষদ বসল করাচিতে, পূর্ব বাংলা বা বর্তমান বাংলাদেশে নয়।

বঙ্গবন্ধু পাকিস্তান আন্দোলনে কলকাতাতেই ছিলেন। ১৯৪৮-এ দেশে ফিরে দেখলেন পূর্ব বাংলাকে শোষণের ক্ষেত্র করা হচ্ছে। এর প্রতিবাদে ছাত্রসমাজকে সুসংগঠিত করতে তিনি ৪ জানুয়ারি ‘পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ’ গঠন করলেন। সেই ছাত্রলীগ থেকেই পরবর্তীতে ‘ভাষাসংগ্রাম পরিষদ’ গঠন করা হয়। সেই সংগ্রাম পরিষদ ১৯৪৮-এর ১১ মার্চ হরতালের ডাক দেয়। সেদিন হরতালে বঙ্গবন্ধু ৭০ জন সহযোদ্ধা নিয়ে গ্রেফতার হন। সেটাই ছিল বঙ্গবন্ধুর পূর্ব পাকিস্তানের ২৩ বছরের শাসনকালের ১৩ বছরের জেলজীবনের সূচনা। পরে ১৯৫২-এর ২১ ফেব্রুয়ারি যখন ছাত্রজনতা প্রাণ বলি দেয়, তখনো বঙ্গবন্ধু জেলে ছিলেন। সেই ভাষাসংগ্রামী বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বেই স্বাধীন বাংলাদেশ পাই আমরা। কিন্তু স্বাধীনতার পর গত ৫০ বছরে বাংলাদেশে আমরা কি ভাষাশহীদদের মর্যাদা জানাতে পেরেছি? এ ক্ষেত্রে কি কোনো বিচ্যুতি আছে? এমন প্রশ্নে বলতেই হয় মুক্তিযুদ্ধের পর ১৯৭২-এর সংবিধান রচনার সময় বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘এই সংবিধান বাংলায় রচিত প্রথম এবং একমাত্র সংবিধান।’ বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে সরকারি স্বীকৃতি মূলত তখনই দেওয়া হয়।

উচ্চ আদালতে বাংলা ভাষার ব্যবহারের বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বাংলা আমাদের সাংবিধানিক ভাষা হলেও উচ্চ আদালতে এখনো পুরোপুরি ব্যবহার হচ্ছে না। উচ্চ আদালতে কোথাও বাংলা ব্যবহারে কোনো বাধাও নেই। তবে কোনো কোনো বিচারপতি আছেন যারা বাংলায় লিখতে পারেন না। অথচ সাধারণ মানুষ ইংরেজি রায়ের কারণে অনেক কিছু বুঝতে পারে না। ভুল বুঝে আইনের মারপ্যাঁচে ভুগতে হয় তাদের। ভাষাকে যারা ভালোবাসেন, দেশকে যারা ভালোবাসেন সেসব মানুষ আশা করে বাংলা হোক সর্বস্তরে ব্যবহারের বাহন। এটি উপযুক্ত জনদাবিও।

জ্ঞানের বিশ্বে এগিয়ে যাওয়ার পথে বাংলা হোক প্রধান বাহন। তবে দ্বিতীয়, তৃতীয় ভাষাও জেনে রাখা ভালো। নরওয়ের লোক যেমন নিজেদের ভাষা ব্যবহার করে এগিয়ে গেছে, চীন ও জাপানের লোকজন যে রকম নিজেদের ভাষায় এগিয়েছে, একইভাবে বাংলা ব্যবহার করেও আমরা বিশ্বে এগিয়ে চলতে পারি। এ বিশ্বাসটুকু ধারণ করতে হবে।

উনবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগেও জাপানের মাথাপিছু আয় ছিল বাংলাদেশের থেকে কম ছিল। তারা জ্ঞানের জগতে এগিয়ে গেছে। আর এ জ্ঞান অর্জন করেছে তারা মাতৃভাষার মাধ্যমেই। আমরা কেন পারব না! প্রায় ৩০ কোটি লোক বাংলায় কথা বলে। অথচ জাপানি ভাষায় কথা বলে মাত্র ১২ কোটি লোক। সুতরাং কেন বাংলা ভাষাকে আমরা পিছিয়ে রাখব? জ্ঞান জ্ঞানই। ইংরেজিতে কথা বললেই যে এগিয়ে যাওয়া যায় তা-ও নয়। আমেরিকার অনেক লোক আছে মূর্খ। অথচ তারা গড়গড় করে অনর্গল ইংরেজিতে কথা বলে। সুতরাং সে অর্থে ইংরেজি ভাষাচর্চাই জ্ঞান অর্জনের জন্য মুখ্য নয়, বরং নিজের মায়ের ভাষা ব্যবহার করে তাতে জ্ঞান অর্জন ও বিকিরণ করতে পারাতেই সাফল্য সহজতর হয়।

প্রফেসর . অনুপম সেন : একুশে পদকপ্রাপ্ত সমাজবিজ্ঞানী, প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ও বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য।

অনুলিখন : রিয়াজ হায়দার চৌধুরী।

সর্বশেষ খবর