বুধবার, ৮ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩ ০০:০০ টা
তীব্র ঝুঁকিতে বাংলাদেশের চার জেলা, বিল্ডিং কোডে গুরুত্বের তাগিদ

ভূমিকম্প ঝুঁকিতে প্রস্তুতি অপ্রতুল

শামীম আহমেদ

ভূমিকম্পে বিধ্বস্ত তুরস্ক ও সিরিয়া। দুই দিনে পাঁচ হাজারের বেশি মানুষের লাশ উদ্ধার হয়েছে। ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে ভূমিকম্পের ঝুঁকিতে রয়েছে বাংলাদেশও। বাংলাদেশের উত্তর ও পূর্বাঞ্চলের জেলাগুলো রয়েছে ভূমিকম্পের উচ্চ ঝুঁকিতে। রাজধানী ঢাকা ভূমিকম্পের উৎসস্থল থেকে ১০০ কিলোমিটারের বেশি দূরে থাকলেও বিল্ডিং কোড না মানায় ৭ বা ৮ মাত্রার ভূমিকম্প ধসিয়ে দিতে পারে ঘনবসতিপূর্ণ এই শহরের হাজার হাজার ভবন। ঘটতে পারে ব্যাপক প্রাণহানি।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক সৈয়দ হুমায়ূন আক্তার বলেন, সাধারণত প্রতি ১০০ বছর পর বড় ধরনের ভূমিকম্প হয়ে থাকে। সবশেষ ১৮২২ এবং ১৯১৮ সালে মধুপুর ফল্টে বড় ভূমিকম্প হয়েছিল। সে হিসাবে আরেকটি বড় ভূমিকম্পের দ্বারপ্রান্তে বাংলাদেশ।

বুয়েট ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের এক যৌথ গবেষণায় দেখা যায়, ভারতের আসামে ১৮৯৭ সালে রিখটার স্কেলে ৮ মাত্রার বেশি ভূমিকম্প আঘাত হানলে ২৫০ কিলোমিটার দূরে ঢাকার ১০ ভাগ ভবন ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দুর্যোগবিজ্ঞান ও ব্যবস্থাপনা বিভাগের অধ্যাপক এ এস এম মাকসুদ কামালের গবেষণায় বলা হয়েছে, ঢাকা শহরের ৩০৫ বর্গকিলোমিটার এলাকার ৩৫ শতাংশ মূলত লাল মাটি। বাকি ৬৫ শতাংশ এলাকা নরম কাদামাটি ও বালুমাটি এলাকা। ৫-৬ মাত্রার ভূমিকম্প হলেই ঢাকার নরম মাটিতে তৈরি এসব ভবন ভেঙে বা হেলে পড়তে পারে। আর্থ অবজারভেশন সেন্টারের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ইন্ডিয়ান, ইউরেশিয়ান ও মিয়ানমার- এই তিনটি প্লেটের সংযোগস্থলে অবস্থিত বাংলাদেশের ঘনবসতিপূর্ণ শহর ঢাকার ঝুঁকি কমাতে এ বিভিন্ন প্রকল্প ও পরিকল্পনা নেওয়া হলেও তা আলোর মুখ দেখেনি। ফলে বড় কোনো ভূমিকম্পে এই শহরে মানবিক বিপর্যয় দেখা দেওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। ২০০৯ সালে সমন্বিত দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কর্মসূচি-সিডিএমপি ও জাইকার যৌথ জরিপে জানা গেছে, ঢাকায় সাত বা তার বেশি মাত্রার ভূমিকম্প অনুভূত হলে শহরের ৭২ হাজার ভবন ভেঙে পড়বে এবং ১ লাখ ৩৫ হাজার ভবন ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তৈরি হবে ৭ কোটি টন কংক্রিটের স্তূপ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিজাস্টার সায়েন্স অ্যান্ড ক্লাইমেন্ট রেজিলিয়েন্স বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মো. জিল্লুর রহমান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, বাংলাদেশে ১৮৮৫ সালে ৭ মাত্রার বড় ভূমিকম্প হয়েছে মানিকগঞ্জে। এতে ঢাকার তেমন ক্ষতি না হলেও টাঙ্গাইল, শেরপুর, সিরাজগঞ্জ, ময়মনসিংহ শহরে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল। ১৯১৮ সালে আরেকটা হয়েছে শ্রীমঙ্গলে। এতে উৎপত্তিস্থলের আশপাশে বেশ ক্ষয়ক্ষতি হয়। ১৮৯৭ সালে ‘দ্য গ্রেট ইন্ডিয়ান আর্থকোয়াক’ ভারতবর্ষে আঘাত হানে। ওই ভূমিকম্পের কেন্দ্রস্থল ভারতের মেঘালয়ের শিলং শহরে হলেও ক্ষতিগ্রস্ত হয় ঢাকা। বাংলাদেশ তিনটি প্লেটের বাউন্ডারির কাছে। অতীতে বড় ধরনের ভূমিকম্প বাংলাদেশ ও আশপাশে হয়েছে। বাংলাদেশের আশপাশে ভূমিকম্পের কেন্দ্র থাকায় ৭ মাত্রার বেশি ভূমিকম্পের ঝুঁকিতে আছে বাংলাদেশ। তিনি বলেন, ভূমিকম্পের বেশি ঝুঁকিতে রয়েছে রংপুর, দিনাজপুর, ময়মনসিংহ, সিলেট, মৌলভীবাজার, সুনামগঞ্জসহ দেশের উত্তর এবং পূর্বাংশের জেলাগুলো। ঢাকায় প্রাকৃতিকভাবে ঝুঁকি তেমন ছিল না। তবে এখানে অধিকাংশ ভবনই বিল্ডিং কোড মেনে ভূমিকম্পসহনশীল করে তৈরি না করে ঝুঁকি তৈরি করা হয়েছে। এখানে বড় কোনো ভূমিকম্প হলে ভয়াবহ পরিস্থিতি হবে। এক রানা প্লাজা ধসে পড়লে সব বাহিনী লাগিয়েও ১৫ দিনের বেশি লেগেছিল উদ্ধার কাজে। সেখানে শত শত ভবন ধসে পড়লে পরিস্থিতি ভয়াবহ হবে। অনেক এলাকায় উদ্ধার কার্যক্রম দূরের কথা, রাস্তার কারণে প্রবেশই করা যাবে না। যুক্তরাষ্ট্রের কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয় ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন শিক্ষকের গবেষণার তথ্যানুয়ায়ী, দেশের ১৩টি এলাকা ভূমিকম্পের ঝুঁকিতে রয়েছে। সবচেয়ে তীব্র ঝুঁকিতে আছে পার্বত্য চট্টগ্রামের তিনটি জেলা ও সিলেটের জৈন্তাপুর এলাকা। ঢাকা এসব এলাকা থেকে ১০০ কিলোমিটারের বেশি দূরে হলেও অপরিকল্পিত স্থাপনা, সরু সড়ক, অধিক জনসংখ্যার কারণে ওইসব এলাকায় ৭ মাত্রার ভূমিকম্প হলে ঢাকায় ক্ষয়ক্ষতি ও প্রাণহানি বেশি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পুরকৌশল বিভাগের হিসাবে ঢাকা শহরে মোট ভবন আছে ২১ লাখ। এর মধ্যে ছয় লাখ ভবন ছয় তলা বা তার চেয়ে বেশি উঁচু। রানা প্লাজা ধসের পর বুয়েটের পক্ষ থেকে ঢাকার ভবনগুলোর ভূমিকম্প সহনশীলতা যাচাই করে লাল, হলুদ ও সবুজ রং দিয়ে চিহ্নিত করার প্রস্তাব দেওয়া হলেও তা বাস্তবায়ন হয়নি। এদিকে নগর পরিকল্পনাবিদ আদিল মুহাম্মদ খান বলেছেন, ভবন নির্মাণ বিধিমালা না মানার কারণে সব বিভাগীয় শহরই ঝুঁকিতে আছে। সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে আছে ঢাকা। এ ছাড়া সুউচ্চ ভবনের পাশাপাশি মাটির নিচ দিয়ে নেওয়া বিদ্যুৎ ও গ্যাসের লাইনও ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় আছে। ভূমিকম্পের পর এগুলো থেকে আগুন ছড়িয়ে পড়তে পারে। স্বেচ্ছাসেবকদের জন্য উদ্ধার তৎপরতা চালানোও কঠিন হবে। খোলা জায়গা না থাকায় ভূমিকম্পের সময় ভবন ছেড়ে বের হয়েও দুর্ঘটনার হুমকিতে থাকবেন মানুষ। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদফতরের মহাপরিচালক মো. মিজানুর রহমান বলেছেন, ভূমিকম্পসহ যে কোনো দুর্যোগ মোকাবিলায় দেশের সবগুলো বাহিনী প্রস্তুত আছে। ভূমিকম্প সহনশীল ভবন নির্মাণে নতুন ইমারত নির্মাণ বিধিমালা করা হয়েছে। এটি মানা হলে দুর্যোগের ক্ষয়ক্ষতি কমিয়ে আনা যাবে।

সর্বশেষ খবর